Monday, August 25, 2025

মমতার মাস্টারস্ট্রোকে বিজেপির ‘মিম-সিদ্দিকি’ কৌশল ব্যাকফুটে, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

Date:

Share post:

কণাদ দাশগুপ্ত

প্রধানমন্ত্রীর চোখের সামনে সেদিন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শ্রীরামচন্দ্রের নাম ব্যবহার করার অভব্য ঘটনায় এখন বিপাকে বিজেপি৷ সমান বিব্রত কেন্দ্রীয় সরকারও৷ বোধোদয় বিলম্বিত হলেও প্রধানমন্ত্রী বুঝেছেন, ওই ঘটনায় বাংলায় বিজেপির আম এবং ছালা, দুটোই হাতছাড়া হয়েছে৷ সূত্রের খবর, এই ঘটনা প্রসঙ্গে ঘনিষ্ঠ মহলে আক্ষেপও করেছেন নরেন্দ্র মোদি। সেদিনের ঘটনা যে ‘বাঙালি আবেগ’-কে আঘাত করেছে’, প্রতিবাদের বহর দেখে তা বুঝতে পেরেছেন তিনি৷ তাই ফাটা বাঁশে আটকে বিজেপি এবং কেন্দ্র কার্যত কাঁদতেই বসেছে এখন৷ ভোটের মুখে জোরকদমে শুরু হয়েছে ‘মেন্ডিং অপারেশন’৷ বোঝাই যাচ্ছে, দিন কয়েকের মধ্যেই ‘অপরাধী চিহ্নিত’ করে তাদের দলগতভাবে ‘শাস্তি’ দেওয়ার সলতে পাকানোর পর্ব চলছে৷

ভিক্টৌরিয়া-কাণ্ডে কেন্দ্রের একাধিক প্রশাসনিক এবং দল হিসেবে বিজেপির ফাঁক-ফোকরের পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও ভয়ঙ্কর এক চাপে পড়েছে বিজেপি৷ এই চাপের অন্য নাম, ‘ফাঁদে পড়ে বগা কাঁদে’৷ এই চাপ কাটানোর ‘ভ্যাকসিন’-এর হদিশ এখনও অধরা৷ কী সেই চাপ ?

সেদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণের মুখে একদল ভক্ত যেভাবে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়েছেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে ওই ধর্মীয় ধ্বনির প্রতিবাদ করেছেন, তাতে গেরুয়া- ‘মহা’কৌশল কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে৷

আরও পড়ুন-রাষ্ট্রপতি ভবনে ছবি কার? নেতাজি নাকি চরিত্রাভিনেতা প্রসেনজিৎ, জোর বিতর্ক

একুশের ভোটে তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক লুঠ করতে বিজেপি সযত্নে ওয়েইসি আর আব্বাসউদ্দিন সিদ্দিকিকে মাঠে নামিয়েছে৷ অথচ ভিক্টোরিয়ার ঘটনার পুরো ফায়দা তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি পথে বসিয়ে দিয়েছেন মোদি-শাহের দলকে৷ ধর্মীয় ধ্বনির প্রতিবাদে মমতার স্ট্যাণ্ডে শতগুনে দৃঢ় হয়েছে তাঁর মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক৷ দেরিতে হলেও মোদি-শাহ এটা বুঝেছেন৷ বিজেপির যেসব নেতা-কর্মী-সমর্থক কিছুই না বুঝে ওই ঘটনাকে হালকাভাবে নিয়েছেন, নিজেদের বোধশক্তিকে নিজেরাই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছেন তাঁরা৷ মমতার ভাষন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন, তা বোঝার ক্ষমতাই তাদের নেই৷ শীর্ষ পদ্ম-নেতৃত্ব এখন বিষয়টি ধরে ফেলেছেন, ওই ঘটনা সামাল দেওয়ার যোগ্যতা মিম বা সিদ্দিকিদের আর নেই৷ এটাও বুঝেছেন, ধর্মীয় ধ্বনির প্রতিবাদ জানিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের ৯০ শতাংশ মুসলিম ভোট কবজা করে ফেলেছেন৷
শীর্ষ গেরুয়া-নেতারা আজ টের পেয়েছে দলের কিছু বালখিল্য নেতার দেওয়া বল সপাটে মাঠের বাইরে পাঠিয়েছেন মমতা৷ ভোটের মুখে হারিয়ে যাওয়া ওই বল আদৌ কি আর খুঁজে পাবেন মোদিজি- শাহজি- নাড্ডাজিরা ?

রাস্তা একটাই, সেদিন ভিক্টোরিয়া- কাণ্ড যাদের মস্তিষ্কপ্রসূত, এই মুহুর্তেই সেই নেতাদের দল থেকে বহিষ্কার করা৷ কিন্তু এই ‘সাহস’ কি দেখাতে পারবেন অমিত শাহ-জে পি নাড্ডা?

দুর্ভাগ্যজনক ওই ঘটনার দিনেই ‘বিশ্ব বাংলা সংবাদ’-এ প্রকাশিত হয়েছিলো, “একদল বাঁদরের হাতে খোলা তরবারি তুলে দিলে যা যা হওয়ার, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে নেতাজি জয়ন্তী পালনের অনুষ্ঠানে ঠিক সেটাই হয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রী নিজে যে সরকারি অনুষ্ঠানে উপস্থিত, সেই অনুষ্ঠানের তাল কেটে দিয়ে ওই রামভক্তরা খোদ মোদিকেই হাস্যকর জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে৷ নেতাজি সুভাষকে শ্রদ্ধা জানাতে নয়, ঠিক যে কাজ করতে তাদের পাঠানো হয়েছিলো,’গভীর নিষ্ঠার’ সঙ্গে সেই কাজ করে তারা বোঝালেন বাঙালি হৃদয়ে চিরশ্রদ্ধার আসনে থাকা নেতাজি সুভাষচন্দ্রে তাদের এবং তাদের মেন্টরদের আদৌ কোনও আগ্রহ নেই৷” প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো, “প্রধানমন্ত্রী কলকাতায় এসেছিলেন তাঁর ‘নেতাজি-প্রেম’-কে সামনে রেখে ভোট-বৈতরণী অতিক্রম করার রসদ সংগ্রহের জন্য৷ কিন্তু একদল চরম অশিক্ষিত ভক্ত মোদির সাজানো ছকে জল ঢেলে দিল রামচন্দ্রকে সামনে রেখে৷ বাঙালির একরাশ ঘৃণা সঙ্গে নিয়ে ফিরে গেলেন মোদি৷”

আরও পড়ুন-‘তরুণ প্রজন্মের ওপর রাষ্ট্রের গুরুভার’, বাল পুরস্কার প্রাপকদের সঙ্গে খোশমেজাজে মোদি

ফিরে গিয়েই বুঝেছেন তিনি৷ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে কেন্দ্রীয় সরকারের নেতাজি-স্মরণ অনুষ্ঠানে কেন ওই অভব্য ঘটনা ঘটলো, কারা করলো, তা জানতে এবার আসরে নামতে বাধ্য হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক৷ নির্ভরযোগ্য সূত্রের খবর, বিজেপির জাতীয় সাধারণ সম্পাদক বি এল সন্তোষ ভিক্টোরিয়া-ইস্যুতে তাঁর উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে৷ দিল্লি বুঝেছে, বিষয়টি ওই একদিনেই শেষ হয়ে যায়নি৷

ওদিকে ওই চরম অশোভন ঘটনার পরমুহুর্ত থেকেই কিছুই না বুঝে একদল অর্ধশিক্ষিত সেই ঘটনাকে “দলের স্বার্থে” ‘জাস্টিফাই’ করতে বাজারে নেমেছেন৷ ব্যতিক্রম, বিজেপি নেতা, প্রাক্তণ বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য৷ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রকাশ্যে ওই ঘটনার প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি৷ কিন্তু যারা ওই ঘটনায় আমোদ পেয়েছিলেন, কেন্দ্রের তদন্তে নামার সিদ্ধান্তে তাদের মুখের কালি তুলে ফেলবেন কীভাবে ? এই তালিকায় তো তথাগত রায়ও আছেন৷ বাংলায় গেরুয়া শিবিরের সাম্প্রতিক নীতি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রীরামচন্দ্রের নাম শুনলে না’কি রেগে যান৷ তাই বিজেপির নেতা-কর্মীরা সর্বত্রই ওই ধ্বনি দেবেন৷ কিন্তু এই বুদ্ধি হয়নি, মোদির সামনে কেন্দ্রের নেতাজি- জয়ন্তী অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীকে বিপাকে ফেলতে তোলা ওই ধ্বনি বাঙালি ভালোভাবে যেমন নেয়নি, তেমনই ভোটের মুখে বিজেপির কিছু কৌশলেও জল ঢেলেছে৷ ইতিমধ্যেই এই রিপোর্ট পৌঁছে গিয়েছে অমিত শাহের দফতরে৷ তাই সময় নষ্ট না করে দ্রুত ‘ব্যবস্থা’ নিতে চাইছেন উদ্বিগ্ন শাহ-নাড্ডা।

এই ঘটনায় দল হিসেবে বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসন একাধিক প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়েছে৷

(১) প্রধানমন্ত্রী ওই অনুষ্ঠানে হাজির থাকায় গোটা ভিক্টোরিয়া চত্বর ছিলো
স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপ বা SPG কভারেজে৷ SPG-কে আঁধারে রেখে, তাদের নজরদারির ফাঁক গলে কীভাবে এত ‘বাইরের’ লোক ভিক্টোরিয়ায় ঢুকলো ? কোন SPG নিরাপত্তায় প্রধানমন্ত্রী আছেন ?

(২) দল হিসেবে বিজেপি শিখিয়ে- পড়িয়ে যাদের অসভ্যতা করতে পাঠিয়েছিলো, তাদের ভিড়ে মিশে থাকা কেউ তো আরও বড় বা দুর্ভাগ্যজনক কোনও ঘটনা ঘটাতে পারতো ! বিজেপির কোন অংশ তার দায় নিতো ? খোদ প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতখানি কাছাখোলা কেন হলো ?

(৩) ওই অনুষ্ঠানে লোক জড়ো করার জন্য কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিমন্ত্রক বঙ্গ- বিজেপিকে গোছা গোছা ‘পাস’ দিয়েছিলো৷ ঢোকার ‘পাস’ বিলি নিয়ে দলের অন্দরে প্রথম থেকেই ছিলো তীব্র অসন্তোষ, দলের অন্দরে চরম গোষ্ঠীবাজি, দুর্নীতি হয়েছে ‘পাস’ বিলি নিয়ে৷ এক গোষ্ঠী ‘পাস’ পেয়েছে চাহিদার কয়েকগুণ বেশি৷ অন্য অংশের বহু নেতা নিজেদের জন্যও ‘পাস’ পাননি৷ কেন্দ্রীয় এজেন্সির মাধ্যমে তদন্ত শুরু হয়েছে৷ রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর দলের শীর্ষমহল কৈফিয়ত তলব করতে চলেছে বঙ্গ-বিজেপির এই অংশের কাছে, যারা ‘পাস’ বিলি করেছেন, কেন তারা সঠিকভাবে করেননি ?

(৪) দেখা গিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর ওই অনুষ্ঠানে যত আসন ছিল,তার থেকে অনেক বেশি লোক ঢুকেছিলো। এরা যত্রতত্র ঘুরছিলেন, মনের সুখে ছবি বা সেলফিও তুলছিলেন৷ দলের অনেক স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীও ছবি তুলতে ব্যস্ত ছিলেন৷ কারন সেই সব ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দলে নিজেদের গুরুত্ব বাড়ানোর তাগিদ ছিলো এদের৷ কে বা কারা এইসব অবাঞ্ছিতদের ওখানে প্রবেশাধিকার দিলেন ?

আরও পড়ুন-প্রজাতন্ত্র দিবসের আগে রাজ্যজুড়ে নাশকতার ছক, রেড অ্যালার্ট জারি

(৫) ভিক্টোরিয়ায় ঢোকা নিয়েও বঙ্গ-বিজেপির আদি-নব লড়াই তুঙ্গে৷ দলের একাংশের বক্তব্য,
তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়া এক নেতা এবং তাঁর অনুগামীরা শনিবার দুপুর থেকে ভিক্টোরিয়ায় দাপাদাপি করেছেন৷ এমনকী SPG-কে উপেক্ষা করে, ধমক দিয়ে প্রধানমন্ত্রী সভাস্থলে আসার পরেও ওই লোকজনই প্রচুর লোক ঢুকিয়েছে। তদন্ত হচ্ছে, এরা কারা ? ঠিক কোন কারনে সেদিন এদের ভিক্টোরিয়ায় ঢোকানো হয়েছিলো ?
SPG-কে সেদিন ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ বানিয়ে এততো লোককে ভিক্টোরিয়া প্রাঙ্গনে কারা ঢুকিয়ে দিলো ?
এসব নানা প্রশ্নের কৈফিয়ত তলব করেছে বিজেপির শীর্ষস্তর এবং অমিত শাহের মন্ত্রক৷

Advt

spot_img

Related articles

কলকাতার সর্বজনীন পুজো ডিরেক্টারি: দু-মলাটে বাংলার দুর্গোৎসবের ৪৩৪ বছরের ইতিহাস

রবিবার সন্ধেয় গড়িয়াহাটে আড্ডার আবহে প্রকাশিত হল কলকাতার সর্বজনীন পুজো ডিরেক্টারি। উপস্থিত ছিলেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ দোলা সেন,...

তৃণমূল–সমাজবাদী পার্টির পথে এবার আম আদমি পার্টি! জেপিসিতে থাকছে না আপও 

সংবিধান সংশোধনী বিল খতিয়ে দেখতে গঠিত যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি) থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিল আম আদমি পার্টি।...

মোদির বিরুদ্ধে সরব! হিটলারি কোপে লাদাখের সোনম ওয়াংচু

দফা এক দাবি এক। লাদাখের জন্য একই দাবিতে আজও অনড় সমাজকর্মী সোনম ওয়াংচু (Sonam Wangchuk)। লাদাখের জমি, যা...

শান্তিপুরে মহিলা স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর ভোটে গোহারা বিজেপি! ২৬-৪-এ জয়ী তৃণমূল 

এসআইআর ইস্যু নিয়ে রাজ্যে বিজেপির মাতামাতির মধ্যে নদিয়ার শান্তিপুরে মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ক্লাস্টার কমিটির নির্বাচনে বড় সাফল্য পেল...