‘দুর্গতিনাশিনী’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

এসো এসো মাগো

দেবী দশভূজা
এসো মা শারদজননী
এসো মা ভবানী
পিনাকধারিনী
এসো মা ভুবনমোহিনী ।

এই যে আগমনী গান , একি শুধু গানের জন্য গান ? শুধু কি কথা ও সুর , তাল ও লয় , আর ছন্দের নন্দিত বন্দনা ? এর সঙ্গে কি জড়িয়ে নেই হাজারো পেশার অগণ্য মানুষের রুটিরুজি , সারা বছরের অন্নসংস্থান ? একি শুধু কথার পিঠে কথা বসিয়ে মাকে তুষ্ট করার অভিসন্ধি?

এসো মা আশ্বিনে শারদপ্রাতে
এসো শুভ্র মেঘের রথে
দুঃখের সংসারে
খুশি নিয়ে এসো
এসো দুর্গতিনাশিনী ।

যাঁরা বিষাক্ত সাপের ছোবল উপেক্ষা করে প্রাণ হাতে নিয়ে পদ্ম তোলেন মায়ের পূজার অর্ঘ্য সম্পূর্ণ করার অভিপ্রায়ে , সে কি শুধুই কিছু বাড়তি রোজগারের আশায় ?

এতে কোনো সমর্পণ নেই ? সন্তানকে দুধেভাতে রাখার বাসনা কি মিশে নেই অমূল্য পদ্ম আহরণে ? শুধু কি পদ্ম ? আমাদের তথাকথিত সভ্য নাগরিক সমাজে একপ্রকার ব্রাত্য বারাঙ্গনা তকমাপ্রাপ্ত অসংখ্য মা-বোনেরা অপেক্ষা করেন সারাটা বছর শুধুমাত্র এক চিলতে সম্মানপ্রাপ্তির আশায় , যখন কিনা হাজার হাজার মণ্ডপে দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে ‘ বেশ্যাবাড়ির মাটি’ দারুণ মূল্যবান হয়ে ওঠে ।

জমানো চোখের জলে
শাপলা শালুক ফুলে
অর্ঘ্য রচেছি যতনে
অঞ্জলি নিও আর
আশ্রয় দিও মাগো
তোমার রাতুল চরণে ।

শাপলা-শালুক চয়ণ করেন যাঁরা , সারা বছর অভাবের মেঘে ঢাকা থাকে তাঁদের সাধের সংসার । শারদোৎসব তাঁদের হাতে এনে দেয় কিছু কাঁচা পয়সা । যদিও সাময়িক , তবুও মায়ের আগমন ছাড়া এও কি জুটতো ?

আর ঢাকি ভাইয়েরা ? বোধনের দিন থেকে যাঁরা আনন্দের হিল্লোল তোলেন তালে তালে ছন্দে ছন্দে হরেক বোল আর লয়কারীর জাদুতে ? আমরা সমস্বরে উচ্ছল হয়ে উঠি , ‘ ওই তো ঢাকে কাঠি পড়েছে ‘ ! কিন্ত যতই তাল ঠুকি না কেন , আসল ‘ বোল ‘ তো লুকিয়ে থাকে হাজারো ঢাকি ভায়েদের বুকের গভীরে কান্না হয়ে । কি সেই ‘ বোল ‘ ?
‘ ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ
ঠাকুর যাবে বিসর্জন ‘ ।

একলপ্তে হাজার কয়েক টাকা আসবে বটে হাতে , কিন্তু সে সব তো ফুরিয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই । তারপর খাবো কি বাবু ? কিভাবে সংসার চলবে আমাদের ? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে পৃথিবীর আহ্নিক গতি যেন থমকে যায় । কেউ কি বলতে পারেন দুর্গাপূজা শেষ হয়ে গেলে কীভাবে চলবে ঢাকশিল্পীদের সংসার ?

যাঁরা চাঁদমালা বানান , পুজোর ছোট ছোট অথচ ভীষণ জরুরি উপাদানের জোগান দেন , তাঁদের সারা বছর কতটা টানাটানির মধ্যে দিয়ে কাটাতে হয় তার খবরই বা কে রাখে ? যাঁরা প্যান্ডেলের বাঁশ বাঁধেন , অসামান্য সব মণ্ডপসজ্জার কাঠামো তৈরি করেন দিনরাত এক করে , তাঁরা শারদোৎসব শেষ হয়ে গেলে কীভাবে বাঁচেন ?

জগতের লাঞ্ছিত আতুর জনে
বরাভয় দিও
বল দিও গো প্রাণে
দাও মা সুরের আলো
ছড়িয়ে আঁধারে
ওগো মা করুণারূপিনী ।।
বরাভয়দাত্রীর কৃপা করুণা কারা পান ? যাঁদের প্রকৃতই পাওয়া উচিত তাঁরা পান কি ? সম্পন্ন ব্যবসায়ীরা শারদোৎসবের পর ফুলে ফেঁপে ওঠেন । কিন্তু পুজোয় যুক্ত থাকেন হাজার হাজার গরীব মানুষ । পুজোর বিশাল অর্থনীতি থেকে তাঁদের প্রাপ্তি যথারীতি যৎসামান্য , ছিটেফোঁটা । সন্তানদের দুধেভাতে রাখাটা তাঁদের কাছে স্বপ্নই । তবু নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালোর মতো তাঁরা বছরভর চাতকের মতো অপেক্ষা করতে থাকেন মায়ের আগমনের । কিছুই না পাওয়ার চেয়ে বছরের ওই বিশেষ চারদিনের নগদপ্রাপ্তি তো ভালো বটেই ।

আরও পড়ুন- সারেগামাপার মঞ্চে দরদী রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে মন জিতলেন জাভেদ

অটো বা টোটোর মতো ছোট গাড়ির চালকেরা পুজোয় বাড়তি কিছু রোজগার করেন। বড়ো ও বিখ্যাত পুজোমণ্ডপের আশেপাশে চা-পান-চপ-ঘুঘনি-ঝালমুড়ি-ফুচকা ও অন্যান্য ছোট ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত কিছু রোজগার করার সুযোগ পান অবশ্যই । মেলা বসে অনেক জায়গায় । দরিদ্র ব্যবসায়ীদের মুখে সামান্য হাসি ফুটে ওঠে ওই ক’টা দিন। আলোক শিল্পী , মাইক্রোফোন ব্যবসায়ী , ডেকরেটর্স , ফল ও ফুল বিক্রেতা , বাসন ও দশকর্মা ব্যবসায়ী , মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী ও পেশাদার গায়ক-গায়িকারা সাধারণত ভালো রোজগার করেন শারদোৎসবে । কিন্তু এখানে যুক্ত দরিদ্র শ্রমিক ও কর্মচারীরা অন্যান্য সময়ের চেয়ে কিছুটা বেশি রোজগারের মুখ দেখলেও সারা বছরের জন্য তা নেহাতই অপ্রতুল । তবুও তাঁরা সম্ভবত এই ভেবেই নিজেদের সান্ত্বনা দিতে থাকেন যে ,’ … তবুও শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে ‘ । এটা কিন্তু অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে , মায়ের মুখের হাসি সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেয় । হাজার কষ্টের মাঝেও অপার শান্তি অনুভূত হয় । মায়ের আগমণে অনন্ত জাগে । বিশ্বচরাচর আনন্দময় হয়ে ওঠে ।