‘অশান্ত কমলাকান্ত’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

অশান্ত কমলাকান্ত বলে
দিয়ে গালাগালি —
এবার সর্বনাশি , ধ’রে অসি,
ধর্মাধর্ম দুটোই খেলি।

এই সেই আশ্চর্য গান , যা আজও শ্রোতাদের মনে বিস্ময় জাগায়। এই সেই গান , যে গানে রয়েছে এক মারাত্মক জিজ্ঞাসা:
আদিভূতা সনাতনী,
শূন্যরূপা শশী-ভালী
ব্রক্ষ্মাণ্ড ছিল না যখন হে মা,
মুণ্ডমালা কোথায় পেলি।

শাক্ত পদাবলী তথা শ্যামা সঙ্গীতের অন্যতম প্রধান কবি ও গীতিকার সাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য ( ১৭৬৯ — ১৮২১ ) বর্ধমানের মহারাজ তেজচাঁদের গুরু ও সভাসদ ছিলেন। তিনি শতাধিক ভক্তিগীতির স্রষ্টা। তাঁর অসামান্য পদগুলির মধ্যে ‘ সদানন্দময়ী কালী… ‘ সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয়।

সদানন্দময়ী কালী, মহাকালের মনমোহিনী গো মা।
তুমি আপন সুখে আপনি নাচো,
আপনি দাও মা করতালি।
এ গানের পদকর্তা সাধক কমলাকান্ত কেন যে নিজেকে
‘ অশান্ত ‘ বলেছেন, তা আজ দু’শো বছর পরেও অজ্ঞাত। এই সেই বিখ্যাত গান, যে গানে মুণ্ডমালা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন কবি। গানের অন্তরায় মা শ্যামাকে গালাগালি করতে করতে কাঠগড়ায় তুলতেও দ্বিধা করেন নি এই ব’লে যে, অসি ধারণ করে ধর্মাধর্ম দুটোই খেয়ে ফেলেছেন সর্বনাশি মা! মায়ের প্রতি শাক্ত কবির কঠোর অভিযোগ, সন্দেহ, তীব্র ক্ষোভ, অভিমান ইত্যাদি সবকিছুই একেবারে খোলামেলা গালাগালি হয়ে বেরিয়ে এসেছে এই আশ্চর্য গানটিতে। অথচ এই বিরল গানটিতেই কবি মেনেও নিয়েছেন যে, মায়ের কথাতেই তিনি চলেন, মায়ের শেখানো কথাই তিনি বলেন।

এই অশান্ত সাধকের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা অলৌকিক ঘটনা। এমনকি তাঁর মৃত্যুর সঙ্গেও যুক্ত হয়ে আছে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। ১৮২১ সালে মারা যান কমলাকান্ত। মৃত্যুর আগে তাঁর একান্ত ইচ্ছে ছিল তাঁর গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটুক। কিন্তু বর্ধমানের যে গ্রামে তিনি দেহ রাখেন, তার ধারেকাছেও গঙ্গা ছিল না। কিন্তু সাধকের অন্তিম ইচ্ছা পূরণের জন্যই হয়তো তাঁর আরাধ্যা মা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর সেই মন্দির প্রাঙ্গণের মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে গঙ্গার জল। পরবর্তী কালে সেই স্থানে একটি কুয়ো তৈরি করে দেওয়া হয়। সেই কুয়োর জলে আজও কালীপুজোর সময়ে মায়ের ভোগ রান্না করা হয়।
মহারাজ তেজচাঁদ কবির সাধনভজনের জন্য কোটালহাটে তৈরি করে দেন একটি মন্দির। সেখানেই কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে সাধনা করতেন কমলাকান্ত। তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা জনশ্রুতিতে পরিণত হয়। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে এসব অলৌকিক কাহিনীর প্রচার ও প্রসারের ফলে অনেকটাই চাপা পড়ে যায় শাক্ত কবির অসাধারণ কাব্যপ্রতিভা।

মনে রাখতে হবে, সাধক কমলাকান্তের রচনা যথেষ্ট মার্জিত, পরিশীলিত, অলংকৃত এবং অভিজাত।
তাঁর অন্যান্য রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তন্ত্রতত্ত্ব ‘ সাধকরঞ্জন ‘ , কৃষ্ণ-বিষয়ক কিছু রচনা এবং কয়েকটি প্রণয় সঙ্গীত। কমলাকান্ত সারাক্ষণ ডুবে থাকতেন সঙ্গীতে । তাঁর দেবী অর্ঘ্যের মধ্যে প্রধান ছিল গান। গান গেয়েই তিনি মূলত মায়ের পূজা করতেন। গায়ক হিসেবেও তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি ও কদর ছিল। লেখক ও গায়ক হিসেবে তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তাঁর পূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল শিবহীন কালীসাধনা। শিব ছাড়াই তিনি গড়তেন কালীমূর্তি এবং নিজেই পূজা করতেন। গানে গানে তিনি প্রশ্ন রেখে গেছেন অজস্র। তার মধ্যে একটি হলো, কেন শ্যামা মাকে সবাই কালো বলে। মা তো কখনো শ্বেত, কখনো পীত, আবার কখনও বা নীললোহিত। আর তাছাড়া কালোই যদি হবেন, তাহলে মায়ের রূপের ছটায় সারা জগত আলোকিত হয় কীভাবে ? আবার কখনও লিখেছেন, মায়ের সুশীতল পদ্মের মতো প্রফুল্ল চরণে কমলাকান্তের মন নিরন্তর ভ্রমর হতে চায়।
শিবকে বলেছেন আশুতোষ।
দ্যাখো, শব-ছলে চরণ-তলে
আশুতোষ পড়িল আসি।
তাঁর আরাধ্যা দেবীর কাছে তাঁর জিজ্ঞাসা ও অভিমান যেন অন্তহীন।
শ্যামা যদি হেরো নয়নে গো ,
ইথে বলো ক্ষতি কি তোমার।
জননী হইয়ে এই যন্ত্রণা দেখিয়ে
দয়া না করিলে এ কোন্ বিচার…
আগমে নিগমে শুনি
পতিত পাবনী তুমি
আমি যে পতিত দুরাচার।
আবার এই অশান্ত কমলাকান্তই আজ থেকে দু’শো বছর আগে লিখে গেছেন:
ওরে নবমী নিশি !
না হৈওরে অবসান।

আরও পড়ুন- মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগ! নিউটাউনে জৈব হাটে শহরবাসীর জন্য নিরাপদ সবজি

_

 

_

 

_

 

_

spot_img

Related articles

বাংলার বকেয়া না দিলে ফের মেগা ধরনা দিল্লিতে, হুঁশিয়ারি অভিষেকের

বাংলার বকেয়া না দিলে আবারও দিল্লিতে মেগা ধরনা হবে, হুঁশিয়ারি দিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। একশো...

নকশালবাদ ও ভারত সরকারের বর্তমান নীতি

কেন্দ্রীয় সরকার নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও পুনর্বাসন, এই তিনটি স্তম্ভের সমন্বয়ে ভারতের নকশাল দমন কৌশলে আমূল পরিবর্তন এনেছে। অতীতের...

গাছের মগডালে ৭৩৮ দিন! প্রকৃতির সৃষ্টিকে বাঁচাতে তেইশ বছরের জুলিয়ার লড়াকু বাস্তব কাহিনী

'গাছ লাগান প্রাণ বাঁচান' কথাটা বইয়ের পাতা থেকে বেরিয়ে এসে দেওয়াল লিখন কিংবা পরিবেশ দিবসের দিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের...

থামল লুনার সওয়ারি: শেষ হল অ্যাডম্যান পীযুশ পাণ্ডের ফেভিকলের সফর

খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন থেকে অডিও ভিস্যুয়াল বিজ্ঞাপনে যখন পাড়ি দিয়েছিল আমাদের দেশের বিজ্ঞাপনীমহল, তখন নিজে হাতে ধরে সেই...