রয়্যালটির টাকা না পেয়ে কোর্টের দ্বারস্থ হাঁদা ভোঁদা,বাঁটুলের স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথ

বাংলা কমিকস স্ট্রিপের প্রবাদপুরুষ শিল্পী নারায়ণ দেবনাথ। বিগত 5-6 দশক ধরেই বাঙালির নস্টালজিয়া নারায়ণ দেবনাথের অমর শিল্পসৃষ্টির সঙ্গে জুড়ে আছে। নারায়ণ দেবনাথ দেশের এমন এক বিরলতম শিল্পী যিনি গত 50-60 বছরেরও বেশি সময় ধরে দেড় হাজারেরও বেশি কমিকস স্ট্রিপ তৈরি করেছেন। সেই সব কমিকসের কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও চিত্ররূপের দায়িত্বও একা সামলেছেন । হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট, নন্টে ফন্টে, বাহাদুর বেড়াল, ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায়, ম্যাজিশিয়ান পটলচাঁদ, ডানপিটে খাঁদু আর তাঁর কেমিক্যাল দাদু, কৌশিক রায়, পেটুক মাস্টার বটুকলাল, শুঁটকি আর মুটকি, প্রভৃতি কমিক চরিত্রের জন্ম হয়েছে নারায়ণ দেবনাথের হাতে। তাঁর অমর সৃষ্টি ‘বাঁটুল দি গ্রেট’ এবং
‘হাঁদা ভোঁদা’ কমিকস পার করেছে পঞ্চাশ বছর।
সৃজনশীল শিল্পী নারায়ণ দেবনাথ 94 বছর বয়সে আজ আদালতের দ্বারস্থ তাঁর আর এক সাড়া জাগানো
চরিত্র ‘নন্টে-ফন্টে’কে মুক্ত করতে। প্রায় 50 বছর বয়স এই ‘নন্টে-ফন্টে’ চরিত্রেরও।
‘নন্টে-ফন্টে’-র চাহিদা আজও অটুট। বাজারে কাটতি আজও ঈর্ষাজনক। কিন্তু তবুও নিজের প্রাপ্য রয়্যালটির টাকা পাচ্ছেন না শতবর্ষের দোরগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এই শিল্পী। অনেক অনুরোধেও কাজ না হওয়ায় নারায়নবাবু শেষপর্যন্ত বাধ্য হলেন আদালতের আঙ্গিনায় পা রাখতে। রয়্যালটির টাকা পেতে
শুরু হয়েছে আইনি লড়াই। প্রবীণ এই শিল্পীর যুক্তি, “আমার সৃষ্টি এই দু’টি চরিত্রের চাহিদা আজও সমানভাবে রয়েছে। বই বিক্রি হচ্ছে, অথচ আমার প্রাপ্য থেকে আমাকেই বঞ্চিত করা হচ্ছে। অসংখ্যবার যোগাযোগ করা সত্ত্বেও প্রকাশক ইতিবাচক কিছুই করছেন না। ফলে নিতান্ত বাধ্য হয়েই
আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি”।
নারায়নবাবুর ভাইপো শান্তনু দেবনাথ শনিবার দাবি করেছেন, “গত বুধবার সিটি সিভিল কোর্ট নন্টে-ফন্টের প্রকাশনায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। প্রকাশক এই ‘নন্টে-ফন্টে’ কমিকস আর ছাপতে বা বিক্রি করতে পারবেন না।”
যে প্রকাশনা সংস্থার বিরুদ্ধে নারায়ন দেবনাথ এই অভিযোগ এনেছেন সেই ‘পত্রভারতী’-র
কর্ণধার ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, “এ সংক্রান্ত বই ছাপানোর জন্য নারায়ন দেবনাথ 2014 সালের আগস্টে লিখিতভাবে সম্মতি দেন। সেই চুক্তিপত্র আমাদের কাছে আছে। তার ভিত্তিতেই বই ছাপা হয়েছে। আমরা 5 জুলাই এ বিষয়ে চিঠিও দিয়েছিলাম। কিন্তু উত্তর পাইনি। আদালতে যাওয়ার বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমের কাছ থেকেই জেনেছি।” নারায়নবাবুর আইনজীবী রমেশচন্দ্র পালের বক্তব্য, “বহুদিন ধরেই নারায়ন দেবনাথের বইয়ের রয়্যালটি দিচ্ছে না ওই প্রকাশনা সংস্থা। পরিবারের তরফে এবং নারায়নবাবু নিজে একাধিকবার বিষয়টি প্রকাশক সংস্থাকে জানায়। গত বছরের পুজোর পরেও নারায়নবাবুর পুত্র তাপস দেবনাথ যোগাযোগ করেন প্রকাশন সংস্থার সঙ্গে। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। প্রকাশন সংস্থা বুঝতেই চায়নি যে, 94 বছর শিল্পীর এই টাকাতেই চলে। তাই বাধ্য হয়েই আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছে।”
এদিকে, ‘নন্টে-ফন্টে’-র প্রকাশক পত্রভারতীর কর্ণধার ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের পাল্টা বক্তব্য, ‘ওনার সঙ্গে আমাদের চুক্তি থাকার পরেও অন্য এক সংস্থাকে নন্টে-ফন্টেকে দিয়েছেন বই হিসেবে প্রকাশ করার জন্য। এই কাজ বেআইনি। কিন্তু আমরা প্রবীণ শিল্পীর মর্যাদার কথা ভেবে কোনও ব্যবস্থা নিইনি। 1968 সাল থেকে উনি পত্রভারতীর সঙ্গে কাজ করছেন। 2012 সালের আগস্ট মাসে একটি চুক্তি হয়। সেখানে ইংরেজি-বাংলা সমস্ত সত্ত্বই আমাদের দিয়ে দেন।কিছুদিন আগে হঠাৎ একটি চিঠি দেন, যা আমার কাছে অপমানজনক মনে হয়েছে। এখন এই বিষয়টি নিয়ে উনি আইনি লড়াই লড়লে আমরা রাজি। আসলে শিল্পী নিজে বয়সজনিত কারণে খুব অসুস্থ, অনেক কিছুই জানেন না।”

পত্রভারতীর ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের এই অভিযোগের জবাব দিয়েছেন নারায়ণবাবু নিজেই। বলেছেন, “2012 সালের জানুয়ারি মাসে নন্টে-ফন্টে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। কিন্তু পত্রভারতী বলছে, ওই বছরের আগস্ট মাসে আমাদের মধ্যে চুক্তি হয়েছে। বই প্রকাশ হয়ে গেলো, আর তারপর কেন চুক্তি হব? কী করে চুক্তি হয়? তা ছাড়া, ওটি চুক্তি নয়, চুক্তির একটি খসড়া ছিল। প্রকাশনা সংস্থা যা তথ্য দিচ্ছে, তা আদৌ ঠিক নয়।অসত্য তথ্য। আর সব থেকে বড় কথা, ওখানে ‘নন্টে-ফন্টে সমগ্র’ নামে কোনও বইয়ের উল্লেখই ছিল না। এবং বলা হয়েছিল, ওই চুক্তিপত্রটির মেয়াদ তিন বছরের।”

কার বক্তব্য সঠিক, সে সব বিচারের দায়িত্ব আদালতের। কিন্তু নারায়ন দেবনাথের মতো একজন প্রবাদপ্রতিম কমিকস-শিল্পী
নিজের প্রাপ্য রয়্যালটির টাকা না পাওয়ার যে অভিযোগ এনেছেন, তা দুর্ভাগ্যজনক বলেই মনে করছেন বাংলার সাহিত্যপ্রেমী মানুষ। তাঁদের ক্ষোভ, 94 বছরের একজন
সাহিত্যিক তথা শিল্পী নিজের পাওনা টাকা না পেলে, তা দুর্ভাগ্যের। এমন হওয়া উচিত হয়নি।”

Previous articleকেদারনাথে HDFC কি করছে একবার দেখুন!
Next articleহৃষি তো আমাদেরই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে গেল!