কং-বাম জোট কতখানি প্রভাব ফেলবে? কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

রাজ্যের তিন বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জোট গড়ে লড়ছে বাম ও কংগ্রেস। এই জোটের ‘সুফল’ দু’দল কতখানি পেলো, উপনির্বাচনের ফলপ্রকাশের পরেই তা বোঝা যাবে।

জোট গড়ে হোক বা আলাদা, রাজ্যে কংগ্রেস ও বামেদের হারানো জমি যে এত তাড়াতাড়ি ফিরছেনা, সাম্প্রতিক কিছু ভোটের ফলাফলেই তা ধরা পড়েছে। তাই এই উপনির্বাচনেও তেমন কোনও সু-সম্ভাবনা না থাকারই কথা। এককভাবে লড়াই করলেও ফল বোধহয় একই হতো। তাহলে কি এই জোট শুধুই দু’দলের নেতাদের মুখরক্ষার জন্য? জোট সাধারন ভোটারদের মধ্যে বাড়তি প্রভাব কতখানি ফেলতে সক্ষম হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন এবং সন্দেহ, দুটোই থাকছে। এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, ফলপ্রকাশের পর দু’দলকে যদি বলতে না হয় যে, “ওরা আমাদের ভোট দেয়নি”, তাহলেই আংশিক সফল হবে এই জোট।

জোট বা আসন সমঝোতা করে লড়তে নামা কং-বামের এটাই প্রথমবার নয়। পাশাপাশি গত লোকসভা ভোটের সময় জোট গড়ার অভিজ্ঞতাও দু’দলের কাছে সুখকর নয়। আলিমুদ্দিনের যে মেগা-নেতারা অকারনে জোট-বিরোধী বিবৃতি দিয়ে সেদিন একসঙ্গে লড়াইয়ের পথর বন্ধ করেছিলেন, তাঁরা এবার জোট প্রার্থীকে জেতাতে ঝাঁপাবেন, এমন আশা না করাই ভালো। দু’দলের চেনা এবং ক্রমাগত হারতে থাকা নেতাদের কথা বাংলার মানুষ কতখানি গুরুত্ব দেন, তা যে কোনও ভোটের ফলপ্রকাশের পরই বোঝা গিয়েছে। এই স্তরের নেতাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন আছে সাধারন ভোটারদের। ফলে এই তিন কেন্দ্রে এ ধরনের নেতাদের ভাষণ কতখানি এফেক্টিভ হবে, তা সাম্প্রতিক অতীতের ভোটের ফল দেখেই বোঝা যায়। কংগ্রেস মুর্শিদাবাদের কথা তুলতে পারে। ওই জেলার কথা এখানে না তোলাই ভালো। ওই জেলায় প্রদেশ বা জাতীয় কংগ্রেসের কোনও ভূমিকা থাকেনা, অধীর চৌধুরিই প্রথম এবং শেষ কথা বলেন।

এবারের তিন উপনির্বাচনে কং-বাম জোট বা আসন সমঝোতা হলেও দু’দলের জোট-ভোটের অতীত রেকর্ড বলছে, খড়গপুর বা কালিয়াগঞ্জের সব বামভোট কিছুতেই কংগ্রেস প্রার্থী পাবেন না। একইসঙ্গে করিমপুর কেন্দ্রেও কংগ্রেসের সব ভোট বামপ্রার্থী পাবেন না। কং-বাম জোটের ভোটারদের বড় একটা অংশ জোটের বাইরের প্রার্থীকে ভোট দেবেনই। রাজনৈতিক অঙ্ক বলছে, খড়গপুর বা কালিয়াগঞ্জের বামভোটের বড় অংশ যেতে পারে বিজেপির পক্ষে। করিমপুরের কংগ্রেসি ভোটাররা সিপিএমের পরিবর্তে তৃণমূলকে ঢালাও ভোট দিলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

আলিমুদ্দিন থেকে লোকাল কমিটি, মোটামুটি সব স্তরই জানে, এই মুহূর্তে বাম-প্রার্থীর পক্ষে তৃণমূলকে হারানো সম্ভব নয়। কিন্তু তৃণমূলকে তো ‘শিক্ষা’ দিতে হবে। সেটা কোন পথে সম্ভব? বর্তমান রাজ্য-রাজনীতি বলছে, তৃণমূলকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার কাজটা বিজেপি করতে পারে। তাই নীতি-আদর্শ পরে দেখা যাবে, আগে তো তৃণমূল হারুক, তৃণমূল ‘শিক্ষা’ পাক। ফলে তৃণমূলকে হারাতে যথারীতি বামভোটের সিংহভাগ যাবে বিজেপিতে। লোকসভা নির্বাচনে বেশ কিছু কেন্দ্রে এমনই হয়েছে। এবার খড়গপুর বা কালিয়াগঞ্জেও এমনই হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
এই দুই কেন্দ্রের দুই কংগ্রেস প্রার্থী নিজের দলের ভোটের বাইরে বাম-ভোটের 10%-20% পেলেই, অনেক পাওয়া হবে। খড়গপুর বা কালিয়াগঞ্জে এবারও ‘বামভোট রামে’ যাওয়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। ফলে ওই দুই কেন্দ্রে বিজেপির জয় অনেকটাই নিশ্চিত।

পক্ষান্তরে ট্র্যাডিশনাল
কংগ্রেসি ভোটারদের মধ্যে এখনও সিপিএমকে ভোট দেওয়ার কালচার এখনও গড়ে ওঠেনি। প্রায় সম-মতাবলম্বী তৃণমূলে যোগ দেওয়ার ডাক বা সুযোগ উপেক্ষা করে যারা আজও কংগ্রেসের পতাকার তলায় আছেন, তারা বিজেপিকে হারাতে সিপিএমকে ভোট দেওয়ার থেকে পরিবর্তে
তৃণমূলকে ভোট দিতে অনেক বেশি স্বছন্দ। করিমপুরের কংগ্রেসি ভোটারদের সিংহভাগ সম্ভবত সিপিএমকে ভোট দেবেন না। যতই সামান্য হোক, রাজ্যে এখনও কংগ্রেসের নিজস্ব ভোট রয়েছে। শত প্রলোভনেও এই কর্মী-সমর্থকরা তৃণমূলে বা অন্য দলে যাননি। নিষ্ঠাবান কংগ্রেসিরা ভাবতেই পারেন না সিপিএমকে ভোট দেওয়ার কথা। এবারও কতখানি এ কথা ভাববেন, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ফলে বিজেপিকে হারাতে করিমপুরে বড় অংশের কংগ্রেসি-ভোট তৃণমূলের পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। করিমপুরে এই ঘটনা ঘটতেই পারে। ফলে খড়গপুর বা কালিয়াগঞ্জের মতো করিমপুরেও প্রকৃত ‘জোট’ কতখানি মর্যাদা পাবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। করিমপুরে ভোট বাড়বে তৃণমূলের। সে কারনেই ওখানে তৃণমূলের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।

জোট হোক বা আলাদা, রাজ্যে কংগ্রেস বা বামেদের হারানো জমি এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কোনও সম্ভাবনাই দেখাতে পারছেন না সাধারন মানুষ। তিন কেন্দ্রেই কং-বাম জোট-প্রার্থীদের জয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। হয়তো তিন নম্বরে থাকতে হবে। যদি সত্যিই তেমন হয়, তাহলে এবার রাজ্যজুড়ে নতুন একটি বার্তা যাবে, কং-বাম জোটকে দু’দলের ভোটাররাই মেনে নিতে পারছেন না। একক লড়লে আজও যারা নিজের দলের প্রার্থীকেই সমর্থন করেন, জোট হলে শরিক-প্রার্থীকে ভোট দিতে তাঁরা ইচ্ছুক নন, এই বার্তা প্রতিষ্ঠিত হলে আগামী সব নির্বাচনেই কং-বাম জোট প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। দু’দলের নেতাদের ইচ্ছা হলো তাই এই উপনির্বাচনে জোট হলো, ইচ্ছা হয়নি বলে গত লোকসভা ভোটে জোট হয়নি, নীতি বা পলিসির উর্ধ্বে গিয়ে নেতাদের নিজস্ব ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার এমন খামখেয়ালি সিদ্ধান্তের সঙ্গে একদমই সহমত নন দু’দলের কমিটেড ভোটাররা, জমি থেকে এমন বার্তাই সম্ভবত আসতে চলেছে।

আলিমুদ্দিন এবং বিধান ভবনকে এমন ‘মেসেজ’-এর অপেক্ষাতেই বোধহয় থাকতে হচ্ছে।

Previous articleক্রিমিনাল আর এজেন্সিকে কাজে লাগাচ্ছে! বিজেপির বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগ শিবসেনার
Next articleমুশফিকুরের হাফ সেঞ্চুরিতে সহজ জয় বাংলাদেশের