বিজেপির বিলের বিরোধিতা করছি, কিন্তু দায় কি অন্যদেরও নয়? কুণাল ঘোষের কলম

কুণাল ঘোষ

এন আর সি, সি এ বি ইস্যুগুলি অনেকের কাছে জরুরি।
আমার কাছে জরুরি নয়।
আমার কাছে এগুলির থেকে অনেক গভীর সমস্যা সামনে রয়েছে, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সঙ্কট বাড়িয়ে চলেছে।
কেন্দ্রীয় সরকার তা থেকে নজর ঘুরিয়ে আমাদের এই জাতি, ধর্ম, পরিচয়জনিত বিতর্কে ঠেলে দিল।

বিষয়টা হল, বিজেপি এটা পারল, তার কারণ কিন্তু এই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষদের অদ্ভুত রাজনীতি।

আমরা একশোবার ধর্মনিরপেক্ষ থাকব। আমরা সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখব।

কিন্তু যখন বাংলাদেশের মত প্রতিবেশি রাষ্ট্রেও সেখানকার সংখ্যালঘুদের উপর লাগাতার অত্যাচার হয়, সেখানে সংখ্যালঘুরা ক্রমশ কমেই চলেছেন, তখন এই দেশে, এই বাংলায় আমরা নীরব থাকি।আমরা প্রতিবাদ, পথসভা, অবরোধ, মোমবাতি মিছিল করি না। বুদ্ধিজীবীরা ঘুমোন। মিডিয়া খবর চাপে। কেউ বলতে গেলেই সাম্প্রদায়িক তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়। মানুষ চুপচাপ সব দেখেন এবং ক্ষুব্ধ হন।

আর বিজেপি এই চাপা ক্ষোভের পূর্ণ সুযোগ নিয়ে তাদের হিন্দুত্বের রাজনীতির তাস খেলছে। যেহেতু প্রতিবেশি দেশে সংখ্যালঘুর নির্যাতনে এখানকার ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির মাথাব্যথা নেই, তাই এখন এই ইস্যুতে তাদের কথা বহু মানুষ ধরছেন না। উল্টো প্ররোচিত হচ্ছেন।

বাংলার অধিকাংশ সাধারণ মানুষ এই জাতি ধর্মের খেলা পছন্দ করেন না।
এন আর সি নিয়ে গোলমালের আশঙ্কায় তাঁরা বিজেপিকে সমর্থন করছেন না।
বিজেপি এটা বুঝেছে। সেইজন্যেই তড়িঘড়ি এলো সিএবি।
সিএবি নিয়ে যদি বিজেপি তাদের লাইনে pযথাযথ প্রচার করতে পারে, তাহলে আবার কিছু মানুষের সমর্থন পেয়ে যেতে পারে।

বিজেপির বিরোধিতা করতে গেলে বাকি দলগুলিকে আগে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হতেই হবে। না হলে অন্য রাজনৈতিক দলের কর্মীদের আড্ডাতেও বিশেষ বিশেষ ইস্যুতে বিজেপির প্রতি নরম কথা শোনাচ্ছে।

আরও সমস্যা কিছু বিপ্লবীকে নিয়ে। এঁরা এন আর সি, সি এ বিকে নিয়ে বিজেপির চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছেন। অথচ প্রতিবেশি দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনে এঁদের খুঁজে পাওয়া যায় না। এসবের ফল হয় উল্টো। আর ফলের সুফল পায় বিজেপি। বিপ্লবী সাজতে মত্তরা সেটা বোঝেন না।

আর্থিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সংকট গভীর।
চারপাশে বেঁচে থাকার লড়াই।
এর মধ্যে এই জাতিধর্মের বিতর্কটা জরুরি ছিল বলে মনে করি না।

আসাম জ্বলছে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিরা আক্রান্ত। ত্রিপুরা উত্তাল। উপজাতিরা মেরেছে অনুপজাতিদের।
বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ বিভ্রান্ত।

বিজেপি এই সব করে আদৌ লাভবান হবে কি না, সময় বলবে।
কিন্তু বিজেপিকে এই পথে যেতে সাহস দিয়েছে অন্য কিছু দলের মেকি ধর্মনিরপেক্ষ নীতি।

যদি প্রতিবেশি রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু দের উপর অত্যাচারের সময় এ রাজ্যের কিছু দল, এদেশের কিছু দল, বুদ্ধিজীবী, নেটিজেনরা প্রতিবাদের ঝড় তুলতেন, বিভিন্ন ইস্যুতে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ থাকতেন; তাহলে বিজেপি এই জায়গাটাতে যেতে পারত বলে বিশ্বাস করি না। এমনকি এখানকার সংখ্যালঘু নেতারাও যদি প্রতিবেশি দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের চড়া বিরোধিতা করতেন, তাহলেও বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক ধাক্কা খেত। অপ্রিয় কাজগুলো ধর্মের ভিত্তিতে হয়েছে বলেই বিজেপি এদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠের আবেগের তাস খেলার সুযোগ পেয়েছে। আজকের বুদ্ধিজীবীরা কোনো ঘটনায় ধর্মের রং দেখে সরব হন। সংখ্যালঘুর পক্ষে বললেই ধর্মনিরপেক্ষ। সংখ্যাগুরুর পক্ষে বললে সাম্প্রদায়িক। বিজেপি তাদের এই দ্বিচারিতার সুযোগ নিয়ে বেড়ে গেছে। আজ সংখ্যাগুরুদের একাংশের অভিমান, ক্ষোভের পিছনে কিছু মেকি ধর্মনিরপেক্ষর সুবিধেবাদী ভণ্ডামি দায়ী।

তাছাড়া বিজেপি তার ঘোষিত নীতির পথেই চলছে। এমনকি ইস্তাহারেও তারা এসব লেখে। বিজেপির উৎস ও জিনগত প্রকৃতি জানার পরেও যুগে যুগে একাধিক রাজনৈতিক শক্তি নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধার জন্য বিজেপিকে এক মঞ্চে নিয়েছে। তাতে লাভ হয়েছে বিজেপিরও। বোতল থেকে দৈত্য বার করার পর এখন বিরোধিতা করলে তো ইতিহাস মুছে যাবে না ! নিমগাছে জল দিয়ে বড় করেছেন; সেই গাছ কি আম খাওয়াবে?

দেশে এত ভোট হল। এত নাগরিক ভোট দিলেন। সরকার হল। তারপর এখন আবার আসল নাগরিক যাচাইয়ের আগুন নিয়ে খেলা আমাদের দেশের পক্ষে বিলাসিতা নয় কি?

এখন কাজ, রোজগার, অর্থনীতি চাঙ্গা করার সময়। কৃষি বাঁচানোর সময়। কারখানা বাঁচানোর সময়। কার্যত প্রতিটা শিল্প, ব্যবসার বাজারে প্রবল চাপ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, দৈনন্দিন জীবনধারণের খরচ ক্রমশ আমজনতার নাগালের বাইরে যাচ্ছে। এগুলি সমাধানের বদলে বিজেপির অ্যাজেন্ডা নিয়ে নাচতে শুরু করেছে দেশ।

তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি যদি ভোট রাজনীতির বদলে যথাযথ ভূমিকা পালন করত, আজ বিজেপি এই অস্থিরতা তৈরির সুযোগটাই পেত না।

সামনের দিনগুলো যথেষ্ট চিন্তার।

দেখতে হবে বিজেপি এই চলতি অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করে জীবনের মূল সমস্যাগুলির সমাধানে অগ্রাধিকার দেয় কি না।
দেখতে হবে অন্য দলগুলি এই পরিস্থিতিতে শুধুই বিজেপিবিরোধী রাজনীতির সাময়িক ফায়দার পদক্ষেপ নেয়; নাকি অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে যথাযথ সমাধানের লক্ষ্যে ভূমিকা নিতে পারে।

আমি একজন নাগরিক। আমি জন্মসূত্রে হিন্দু। আমার পূর্বপুরুষরা যুগ যুগ ধরে এই বাংলার।

আমি কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করছি।

Previous articleনিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরছেন জনসন, ইঙ্গিত বুথ ফেরত সমীক্ষার
Next article“সমস্যা হলেই গেট আউট বলা চলবে না”, CAB নিয়ে ফের সরব মমতা, 20 তারিখ দলের বৈঠক