সিএএ-এনআরসি নিয়ে কিছু জরুরি প্রশ্ন, সঙ্গে উত্তর

সিএএ-এনআরসি-এনপিআর নিয়ে অনেকেই অনেক রকম প্রশ্ন করেছেন। তাঁরা কেউই সে অর্থে ঠিক ভক্ত নন, কিন্তু মনে অনেক সংশয় রয়েছে। মূলতঃ যে সব প্রশ্ন খুব বেশি আসছে সেগুলির তথ্য পঞ্জিকা খুলে উত্তর দিলেন বিশিষ্ট পশু চিকিৎসক দেবাশিস বিশ্বাস।

১. অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের কি এদেশে থাকার অধিকার আছে?

উ: না, একেবারেই না, কিন্তু এই অবৈধ অনুপ্রবেশ সারা দুনিয়ার সমস্যা, ইউরোপ, আমেরিকা তে সবচাইতে বেশি অনুপ্রবেশ কারী আছে। আসলে যে দেশের অর্থনীতি যত শক্তিশালী সে দেশে তত অবৈধ অনুপ্রবেশ কারী। এঁদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা গোয়েন্দা ও পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাও এই সমস্যা দূর হয়নি।

২. সরকার যদি অবৈধ অনুপ্রবেশ কারী দের চিহ্নিত করে বিতাড়িত করতে চায়, তাতে দোষের কি?

উ: কোনো দোষ নেই। করতেই পারে, বরং করা উচিৎ। এর জন্য সীমান্তে জোরালো নজরদারি, গোয়েন্দা বিভাগের আরো অনেক বেশি শক্তিশালী ভূমিকা নেওয়া উচিৎ। এই চিহ্নিত করা নিয়ে প্রশ্ন নেই, প্রশ্ন পদ্ধতি নিয়ে।

৩. অসমে এনআরসি হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন নেই, অথচ অন্য রাজ্যে করতে গেলে দোষ কেন?

উ: অসমে কোনও এনআরসি হয়নি, অসমে এনআরসি করা হয় ১৯৫২ সালে, সেটার পুনর্নবীকরণ করা হয়েছে। সেটা অসম চুক্তি অনুযায়ী এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ও নজরদারির মধ্যে। সেটাও ভুলে ভরা। অসমের মূল নিবাসীদের নিজস্ব বৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য এটা করা হয়। এর সাথে ধর্মের কোনও যোগাযোগ নেই। আবার বলি অসমে কোনও এনআরসি হয়নি, এনআরসি আপডেট করা হয়েছে।

৪. প্রশ্নটা থেকেই গেল, সব রাজ্যে হলে অসুবিধা কি?
উ: উত্তর সেই এক, যে পদ্ধতিতে আসামে এনআরসি হয়েছে, সেই পদ্ধতি অন্য রাজ্যে প্রয়োগ করলে বিপর্যয় হবে। কারণ অসমে একটা তথ্য অন্তত সরকারের ঘরে মজুত ছিল, তাতে ত্রুটি থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে অনেকটা সঠিক করা গেছে। অন্য রাজ্যে সেরকম কিছুই নেই, তার উপর অন্য বেশিরভাগ রাজ্যে, যেমন এই রাজ্যে জনসংখ্যা অসমের বহু বহুগুণ। বসতি ও ঘনত্ব অনেক বেশি। তাই ২-৩ বছরে’ কাজ শেষ করতে গেলে বিপর্যয় হবে নিশ্চিত।

5. এনআরসির অসুবিধা কি? কোনও অপরাধের তদন্তে কি জিজ্ঞাসাবাদ করে না? নির্দোষদেরও তদন্তের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করতেই তো হয়। এখানে অবৈধ অনুপ্রবেশে যদি আপনি অপরাধ মানেন, তাহলে সে নিয়ে তদন্ত বা জিজ্ঞাসাবাদে দোষ কি? নির্দোষদের তো কেউ গ্রেফতার করছে না?

উ: এই প্রশ্নটা একটু পেঁচানো। পুলিশ প্রশাসন অবশ্যই তদন্তের স্বার্থে বহু মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, বহু নিরপরাধ ব্যক্তিকেও করে, এবং ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু সেই জিজ্ঞাসাবাদের সময় আইনের চোখে প্রতিটা ব্যক্তি নির্দোষ, যতক্ষণ না আদালতে সে দোষী সাব্যস্ত হচ্ছে। এমনকী আমি নিজে যদি পুলিশের কাছে লিখিত স্বীকার করি যে আমিই অপরাধ করেছি, তাও আমাকে অপরাধী বলা যাবে না, বিষয়টি আদালতে প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু এনআরসির ক্ষেত্রে প্রতিটা মানুষ সরকার বা আইনের চোখে প্রারম্ভিক ভাবে অপরাধী (অবৈধ অনুপ্রবেশের অপরাধ), এবং সেই ব্যক্তিকে নানা কাগজ, সাক্ষী ইত্যাদি দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি নির্দোষ। বোঝানো গেল ফারাকটা? প্রথম ক্ষেত্রে সব নাগরিক নির্দোষ, প্রশাসনকে প্রমাণ করতে হবে সে দোষী, আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সব মানুষ অপরাধী, তাকে প্রমাণ করতে হবে যে সে নির্দোষ। কাজটা অতি কঠিন, কারণ, ধরুন কাল আপনার এলাকায় একটা খুন হল, আর আপনাকে জেলে ভরে বলা হল আপনিই খুনী। প্রমাণ করুন আপনি নির্দোষ। এইটা প্রমাণ করতে আপনার সাক্ষী, alliby (অর্থাৎ প্রমাণ করতে হবে অপরাধের সময় আপনি অন্য কোথাও ছিলেন) ইত্যাদি বাবদ কত ঝামেলা আর উকিলের খরচ কত আন্দাজ আছে? অসমে গড়পড়তা মানুষ প্রতিজনের ৪০হাজার উকিলের পিছন খরচ হয়েছে। এখানে এর ৪-৫গুন ধরে নিন। খরচ, ঝামেলার বাইরে আমাকে প্রমাণ করতে হবেই বা কেন যে আমি অবৈধ অনুপ্রবেশ কারী নই? এটা কতটা অপমানের? সাধারণ নাগরিক এর আত্মসম্মানের মূল্য ছিল আইনের ভাষায়, তাই সম্মানহানি হলে ক্ষতিপূরণ আছে। এই পাইকারি সম্মানহানি র ক্ষতিপূরণের কথা নেই। তার মানে আপনার আত্মসম্মান বন্ধক রাখতে হচ্ছে এই ক্ষেত্রে।

৬. আচ্ছা এনআরসি না হয় কিছু জটিল, কিন্তু সিএএতে সত্যি সত্যি তো কোনও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার বিষয় নেই, এটা তো নাগরিকত্ব দেবার আইন, এটার বিরোধিতা কেন?

উ: অত্যাচারিত শরণার্থীকে নাগরিকত্ব দিতে বাধা নেই, সেটা দেওয়া দরকারও। আগেও দেওয়া হত, তবে আগে ১২ বছর দেশে বাস করার পর আবেদন করা যেত, এখন পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, খ্রিস্টান দের ক্ষেত্রে ওই সময়সীমা ১২ থেকে কমিয়ে ৫ বছর করা হয়েছে। আগে অবশ্যই অবৈধভাবে ঢুকে পড়া মানুষের কথা ছিলনা, বৈধ মানে পাসপোর্ট ভিসা ইত্যাদি নিয়ে আসা মানুষের কথা ছিল। এখন কিছু মানুষের সুরাহা হলে মন্দ নয়। তবে এরকম নাগরিকত্বের আবেদক মেরে কেটে ২৪হাজার, তাদের কিছু লাভ হতেই পারে। তবে এই নাগরিকত্ব দেবার ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় বাধা গোয়েন্দা দফত্র, আইবি, ইন্টারপোলের ছাড়পত্র। অর্থাৎ অন্য দেশে কেউ ফৌজদারী অপরাধ করে এদেশে কেউ যেন নাগরিক না হয়ে যায়। এই ছাড়পত্রের জন্যই বিষয়টি আটকে থাকে, সেটা কিন্তু তুলে নেওয়া হয়নি, তোলা সম্ভবও নয়। এছাড়া এটা ভারতে প্রথম একটা আইন যা ধর্মীয় পক্ষপাতদুষ্ট। বেছে বেছে মুসলিমদের বাদ দিয়ে ধর্মীয় জিগির তোলা ছাড়া এর ভালো কিছু নেই। যেমন শ্রীলঙ্কা থেকে বহু হিন্দু তামিল, বৌদ্ধদের অত্যাচারে এই দেশে নাগরিকত্ব চান, যাঁদের কথা এই বিলে নেই। তিব্বতী বৌদ্ধদের নাগরিকত্ব দেবার কথা নেই, সম্ভবত চিনের ভয়ে।

৭. এই আইনের তাহলে একটাই দোষ মুসলিম বিদ্বেষ। বাকিদের তাহলে কোনও সমস্যা নেই, বরং ভালো।

উ: এটি সর্বৈব মারাত্মক ভুল ধারণা। এই বলে অনেক মানুষকে চুপ রাখা হয়েছে, তাঁরা ভাবছেন আমাদের কোনও সমস্যা নেই। মুসলিমদের বিষয়ে পরে আসছি, হিন্দুদের নিয়েই আলোচনা আগে করি। এই দেশে হিন্দুরা যেহেতু বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই কোনও ভালো বা মন্দ সবরকম কাজের ফল হিন্দুদেরই বেশী ভুগতে হয়। বেকার কোন ধর্মে বেশি? শিশুমৃত্যু, অপুষ্টি, দারিদ্র্য সব সংখ্যায় (অনুপাতে নয়, সংখ্যায়) হিন্দুরা বহু বহু বেশি। তেমনি এনআরসি থেকে বাদ যাওয়ার সংখ্যায় হিন্দুরাই অনেক অনেক গুন বেশি পড়বেই, এটা বুঝতে সাধারণজ্ঞানই যথেষ্ট। কারণ, এই কাজ করবেন তো সরকারি কর্মীরাই, অন্য গ্রহ থেকে লোক তো আসছে না। দ্রুত এই জটিল কাজ করতে দুনিয়ার ভুল হবেই হবে। আজও ভোটার তালিকায় ভুলের হার দেখেন না? এবার ভাবুন, ভোটার বা আধারে ভুল থাকলে কত হয়রানি, আর এনআরসিতে বাদ পড়া মানে “সপ্ত পুরুষ হেথায় মানুষ” থেকে আছাড় খেয়ে সোজা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হয়ে গেলেন। এরপর কিন্তু বিডিও বা এসডিও অফিসে দৌড় ঝাঁপ নয়, একমাত্র উপায় এনআরসি ট্রাইব্যুনাল। এই ট্রাইব্যুনাল আর আদালতের তফাৎ পরে লিখবো। কিন্তু সব্বাইকে তল্পিতল্পা বেঁধে হা পিত্যেশ করে কোটি কোটি মানুষের ভিড় হবে কলকাতাতে। হতেই পারে আপনার স্বামী-স্ত্রী এনআরসিতে ঢুকলেন, আপনার কন্যা আর বৃদ্ধা মা বাদ পড়লেন। ভেবে দেখেছেন যন্ত্রনা? কল্পনা করুন, ট্রাইব্যুনালে তারিখ পেতে ৩-৪ বছর গড়িয়ে যাবে, তারপর হয়তো শুনানিও হল না। বানানো রূপকথা নয়, এটাই অসমে চলছে। এই সময় আপনি হিন্দু, না মুসলিম এসব অর্থহীন, আপনি হয়ে গেছেন বিনা দোষে বিরাট অপরাধী। আগে পদ্ধতি মেনে নির্দোষ হতে হবে। না হলে ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে হচ্ছে। পরে ওসব আমি হিন্দু, হনুমান চালিশা রোজ পড়ি, আমাকে ক্ষমা করে দিন আসবে। ততদিন বেঁচে থাকবেন তো? কারন এই মার্জনা ভিক্ষা বিচারের শেষ ধাপ।

Previous articleপ্রশান্ত কিশোরকে দল থেকে বের করে দিলেন নীতীশ, জেডিইউ বলল ওই ব্যক্তি করোনাভাইরাসের মত!
Next articleসরস্বতী পুজো করতে পুরোহিতকে নিয়ে টানাটানি, ভাইরাল ভিডিও