আমেরিকায় এত মৃত্যু, কেন? কে দায়ী? কী দায়ী? পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলম

পার্থ  বন্দ্যোপাধ্যায় ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক

আমি যখন ৬ মার্চ কলকাতা থেকে দোহা বিমানবন্দর হয়ে প্রথমে লন্ডনের হিথরো এবং তারপর নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে এসে নামলাম, দেখলাম প্রথম বিশ্বের এই দুটো বিশালতম এয়ারপোর্টে কোনও করোনাভাইরাস পরীক্ষা নেই। প্রায় কারুকে মাস্ক পরতেও দেখিনি। কোয়ারেন্টিন তো দূরের কথা। বরং নিজেকে মাস্ক পরে বোকার মতো লাগছিল।
ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসকশ্রেণী ঠিক ওই ইতালি, ইরান বা স্পেনের মতোই এই বিভীষিকা সম্পর্কে মানুষকে সাবধান করে দেয়নি। চিনও দেয়নি। ঠিক সেই একই সময়ে কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, জাপান, জার্মানি, অথবা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো আপৎকালীন ভিত্তিতে টেস্টিং শুরু করেছিল এবং এয়ারপোর্টগুলোতে কঠোর বাধানিষেধ আরোপ করেছিল। (কিউবা, রাশিয়া ও ভিয়েতনামও করেছিল, কিন্তু ওসব দেশের কথা আর আজকে কেই বা শোনে? ওখানে কিন্তু এই মহাসঙ্কটে মৃত্যুর হার প্রায় শূন্য। জিরো। মঙ্গোলিয়াতে শূন্য। ভুটানে শূন্য। গরিব মায়ানমারে এক কী দুই। বাংলাদেশেও অনেক কম।)

তার ফল আমরা দেখতে পাচ্ছি। আজকের হিসেব অনুযায়ী এখানে এই সর্বশক্তিমান, যুদ্ধবাদী আমেরিকায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অনেক বেশি। প্রায় দু কোটি আমেরিকান দু তিন সপ্তাহের মধ্যে কর্মচ্যুত, কপর্দকহীন।
কিন্তু আমেরিকার পাশের আর এক পুঁজিবাদী সমান্তরাল দেশ কানাডায় এখনো পর্যন্ত খুব কম মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিউবা নিজের দেশের সঙ্কট প্রতিরোধ করে ইতালি ও অন্যান্য দেশের তাদের মেডিক্যাল টিম পাঠিয়েছে। সেসব খবর আমাদের দেশে বা মার্কিনি মিডিয়াতে কখনো বলা হবে না।
গরিব কালো আফ্রিকার দেশগুলো আর গরিব ল্যাটিন আমেরিকার বাদামি দেশগুলো (ব্রাজিল ছাড়া) করোনাভাইরাসকে প্রায় ঢুকতেই দেয়নি। আজকেই সকালে আফ্রিকার অ্যাক্টিভিস্টদের সঙ্গে এক অনলাইন মিটিংএ শুনছিলাম, কীভাবে তাঁরা প্রথম থেকেই এই অতিমারী সম্পর্কে সজাগ ছিল এবং বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছিল। যা আমেরিকা নেয়নি, ব্রিটেন নেয়নি। মৃত্যুর হারে ব্রিটেন এখন সর্বোচ্চ দেশগুলোর মধ্যে একটা দেশ। সংক্রমণ সংখ্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রথম। এ এক শোচনীয় অবস্থা।
কিন্তু আমেরিকার মানুষ — যাদের পরিবারের কেউ বা সহকর্মীদের মধ্যে চেনাশোনা কেউ মরেনি, তাদের কাছে এই সংখ্যার ভয়াবহতা কতটা ভয় সৃষ্টি করতে পেরেছে, আমার সন্দেহ আছে। আমেরিকার মানুষ বোধহয় ভারতের মানুষের মতোই উগ্র দেশপ্রেমে সম্পূর্ণ অন্ধ। এই দুটো দেশকেই আমি সারা জীবন খুব কাছ থেকে দেখলাম। এতো ব্যক্তিকেন্দ্রিক, আত্মসর্বস্ব সমাজ পৃথিবীতে আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই।
যখন দেশ ছেড়েছিলাম পঁয়ত্রিশ বছর আগে, তখন ভারতে এই অবস্থা ছিল না। আজ ভারত শুধু যে মার্কিনি নিষ্ঠুর লাগামছাড়া কর্পোরেট পুঁজিবাদ গ্রহণ করেছে তাই নয়, সমাজবিচ্ছিন্নতা ও আমি-সর্বস্ব জীবনদর্শন আমেরিকার থেকে গ্রহণ করেছে। আজ তাই রাস্তায় কারুকে মরে পড়ে থাকতে দেখলেও ভারতীয় বা বাঙালি পাশ কাটিয়ে চলে যায়। পাশের বাড়ির একটা মেয়ের ওপর অত্যাচার হলে আমরা আমাদের দরজা জানালা বন্ধ করে টিভিটা জোরে চালিয়ে দিই। ভালো হিন্দি সিরিয়াল বা ক্রিকেট খেলা দেখি।
আমেরিকার আজকের এই শোচনীয় অবস্থার জন্যে আমেরিকার সাধারণ মানুষ দায়ী নয়, দায়ী এদেশের শাসকশ্রেণী ও তাদের গত তিরিশ-চল্লিশ বছরের নির্মম শাসন। যেখানে অর্থনৈতিক দিক থেকে মানুষকে সম্পূর্ণ কোমর ভেঙে দেওয়া হয়েছে। যেখানে মানুষের শিক্ষার হার খুব কম। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা খরচের কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে। যেখানে সারা পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকা একমাত্র দেশ — যেখানে স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা অধিকার নয়, প্রিভিলেজ। তোমার অর্থ থাকলে তুমি মেডিকেল ইনস্যুরেন্স কিনবে। না থাকলে তোমার ভাগ্য খারাপ। তোমার চাকরির জায়গায় যদি মেডিকেল বেনিফিট থাকে, তাহলে তোমার থাকবে। চাকরি এই আমার মতো হঠাৎ রাতারাতি চলে গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তোমার মেডিকেল কাভারেজও থাকবে না। চিকিৎসার খরচ আকাশছোঁয়া। আমাদের দেশে যে প্রাইভেটাইজেশন বা বেসরকারিকরণ আজ দেখছেন, আমেরিকায় তা গত তিরিশ-চল্লিশ বছর ধরেই আছে।
এখানে বেশির ভাগ মানুষ জানেই না, আশির দশকের আগে পর্যন্তও এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেও আমেরিকার অবস্থাটা সম্পূর্ণ অন্যরকম ছিল। মধ্যবিত্তের এতো দুর্দশা ছিল না। তারা সারাজীবন আকণ্ঠ ঋণে জর্জরিত ছিল না। তারা ছেলেমেয়েদের সরকারি কলেজে পাঠাতে পারত। তারা অসুস্থ বাবা-মায়ের চিকিৎসা করতে পারত ঋণে দেউলিয়া হয়ে না গিয়ে।
আজ, আমেরিকায় আমি এমন লোককেও চিনি, কেবলমাত্র একদিনের জন্যে মেডিকেল ইনস্যুরেন্স না থাকার কারণে তাকে ও তার পরিবারকে সারাজীবন ধরে চিকিৎসার খরচের ঋণ শোধ করে যেতে হচ্ছে।
ঠিক ওই যেদিন দুটো চাকরির মাঝখানে তার ইনস্যুরেন্সটা ছিল না, সেইদিন তার স্ট্রোক হয়েছিল।
এই হল এখনকার আমেরিকা ও তার অমানবিক অর্থনৈতিক সিস্টেম। যে সিস্টেম এখন আমাদের দেশে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

Previous articleদেশে সংক্রমিতের সংখ্যা কমে সুস্থ-র সংখ্যা বাড়ছে, আপাতত মোট আক্রান্ত ১২,৩৮০ জন
Next articleএগিয়ে কেরল, মানবিক কারনে এবার রাজ্যের সীমান্ত খুলছেন পিনারাই বিজয়ন