বাঙালি জানলই না, তার ঘরে শোভা পাওয়া বহু ছবির কারিগর চলে গেলেন

চলমান ইতিহাস। ৯৬ বছরে থেমে গেল। রাজ কাপুরের ছবি দিয়ে শুরু। তারপর উত্তম কুমার পাহাড়ী সান্যাল, বিশ্বজিৎদের সময় পেরিয়ে বার্ধক্যের বারাণসীতে। সেই ইতিহাস বড় বেদনাদায়ক। রামকৃষ্ণ মিশনের কাঙালি ভোজনই ছিল তাঁর উদরপূর্তির সম্বল। তারপর কী করে যেন বছর দুই আগে ফিল্মি জগতের মানুষজন তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন। তাই দুবেলার খাওয়ার সমস্যা মিটেছিল। কিন্তু সে সুখ তাঁর বেশিদিন সইল না। বছর দুই কাটতে না কাটতেই চলে গেলেন অভিমানী।

চিত্রগ্রাহক বৈদ্যনাথ বসাক। সিনেমাটোগ্রাফার। কে ছিলেন তিনি? আজকের প্রজন্ম যাকে চিনলই না! অথচ তাঁর তোলা ছবিই ঘুরে বেড়াচ্ছে নেটের বেড়াজালে!

১৯৫৪ সালে ‘বুট পালিশ’ হিন্দি ছবি। প্রযোজক রাজ কাপুর। চিত্রগ্রাহক বৈদ্যনাথ বসাক। প্রথম ছবি। মুম্বই গিয়ে কাজ করেছিলেন। দারুন প্রশংসা। এবার ‘শ্রী -৪২০’। পরিচালক রাজ কাপুর নিজেই। ডাক পড়ল বৈদ্যনাথের। কিন্তু তিনি তখন কলকাতায়। কাজ করতে চান বাংলাতে। চুক্তি করে ফেলেছেন অগ্রদূত প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে। প্রথম ছবি অগ্নিপরীক্ষা! বিভূতি লাহা আর বিজয় ঘোষের সঙ্গে সহকারি হিসেবে কাজ শুরু করার হাতছানি। বৈদ্যনাথ তাই রাজ কাপুরের অফার ফিরিয়ে দিলেন। একটার পর একটা হিট ছবির তখন তিনি চিত্রগ্রাহক। সবার উপরে, লালু ভুলু, সাগরিকা, সোনার খাঁচা, সূর্য সাক্ষী, অগ্নিপরীক্ষা, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, ছদ্মবেশী, নায়িকা সংবাদ, বাদশা, অপরাহ্নের আলো, আপন ঘর-সহ অসংখ্য ছবি। শুধু বাংলা কেন, মালায়ালাম, ওড়িয়া, ভোজপুরী সেখানেও অনবদ্য বৈদ্যনাথ। উত্তম কুমারের সঙ্গে ৭২টি ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছেন। অনেকে বলতেন বৈদ্যনাথের ক্যামেরার গুণেই উত্তমকুমারের নজরকাড়া লুক দর্শকরা দেখতে পেতেন। এক সময় নেপালের রাজা মহেন্দ্র তাকে রাজপরিবারের আলোকচিত্রীও করতে চেয়েছিলেন। থাকার জন্য রয়্যাল গেস্ট হাউস দিয়েছিলেন। আর ২৪ ঘন্টার নিরাপত্তারক্ষী। কিন্তু বৈদ্যনাথ বারে বারে কলকাতায় ফিরেছেন নাড়ির টানে। কয়েক বছর কাজ করে চলে আসেন। লাইট-ক্যামেরা-সাউন্ড যেন তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াত।

কিন্তু অভাব আর বয়স বৈদ্যনাথকে অসহায় করে দিয়েছিল। বৈদ্যনাথের অসহনীয় অতীতের কথা প্রথম জানা যায় সোশ্যাল সাইটে। প্রতিদিন চার কিলোমিটার হেঁটে রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে আসতেন। বৃদ্ধ মানুষটি শুধু দু’বেলা ভাতের জন্য আশ্রমের দরিদ্র ভোজনে বসতেন। এক পংক্তিতে বসে খেতেন। কেউ তাঁকে চিনতেও পারতো না। খাওয়া শেষে নিজেই থালা ধুয়ে নিতেন। তারপর গাছতলায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার চার কিলোমিটার হেঁটে ফিরে যেতেন বাড়িতে। জীবনের কী ট্র‍্যাজেডি! যাঁর ডিনার আর লাঞ্চ হতো তারকাদের সঙ্গে, তিনি পাত পেড়ে বসতেন ভিক্ষুকদের সঙ্গে!

ফুটবলার রঞ্জিত মুখোপাধ্যায় প্রথম অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের কাছে তার নাম করেছিলেন। কেমন আছেন বলেছিলেন। চিনতে পেরে বলেছিলেন ওর জন্য কিছু করুন। তারপর একে একে টলিপাড়ার অনেকেই তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। গতবছর তাঁর হাতে সুব্রত মিত্র পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। শিল্পী কলাকুশলীরা মোটা টাকা সাহায্য করেন। অভিনেতা দেব তাঁকে বাড়িতে নিয়ে এসে শ্রদ্ধা জানান এবং বড় অঙ্কের অর্থ সাহায্য করেন। শেষ বয়সে টালিগঞ্জের শিল্পীদের পাশে পেয়েছিলেন। পাপমুক্ত হয়েছিলেন শিল্পীরা।

বছর ১৫ আগে বৈদ্যনাথের স্ত্রী সরস্বতীদেবী প্রয়াত হন। ছেলে সঞ্জয়ের সঙ্গে থাকতেন। ছেলে, বউ, নাতি। ছেলেও স্বল্প আয়ের কর্মচারী। ফলে অভাব লেগেই থাকত সংসারে।

২০১৮ সালে পরিচালক রাজ বন্দোপাধ্যায় তৈরি করেন ‘পাড়’। সেই ছবিতেই অশীতিপর বৈদ্যনাথ সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেন। এটাই তাঁর জীবনের শেষ কাজ।

বৃহস্পতিবার, ৪ জুন। নীরবে, নিভৃতে চলে গেলেন বৈদ্যনাথ বসাক। যিনি ক্যামেরাবন্দি করেছেন অসংখ্য তারকাকে, তাঁর শেষ যাত্রার একটি ছবিও ফ্রেমবন্দি হলো না। এ অপরাধ বিধাতা মাফ করবেন তো!!

Previous articleউত্তপ্ত ভাটপাড়া: পরিযায়ী শ্রমিকদের ছোড়া বোমায় আহত শিশু-সহ দুই
Next articleএকনজরে বাংলার করোনা ও আমফান আপডেট