কোভিড- ১৯ সংক্রমণ থেকে রাজ্যবাসীকে বাঁচাতে কেন এগিয়ে বাংলা ?

মহামারির সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে গোটা দেশের সঙ্গে লড়াই করছে এ রাজ্যও। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রীতিমতো পথে নেমে প্রথম থেকেই মানুষকে সতর্ক করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন এই সংক্রমণের হাত থেকে বাচার উপায় সম্পর্কে। লকডাউনে কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে শাসকদল। রাজ্য সরকারকে সমালোচনায় বিঁধেছেন বিরোধীরা। কোভিড- ১৯ থেকে বাঁচতে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই রাজ্য, যা গোটা দেশে রীতিমতো নিদর্শন। দেখে নিন তারই এক ঝলক।

১) আগে থেকে কোভিড আইসোলেশন ওয়ার্ড নির্মাণ: ১৭ মার্চ বাংলায় প্রথম কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার কেসটি রিপোর্টেড হয়। তার আগে ফেব্রুয়ারি মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কলকাতার সম্ভাব্য করোনা-আক্রান্তদের কথা ভেবে আইসোলেশোন ওয়ার্ড তৈরি রেখেছিল। এমনকি রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক শাখায় একটি ক্যাম্প প্রস্তুত করে, যাতে থার্মাল স্ক্রিনিংয়ের অব্যবহিত পরেই ‘সন্দেহভাজন’ কোভিড আক্রান্ত যাত্রীদের দ্রুত কোয়রান্টিনে পাঠানো যায়। যত দ্রুত সম্ভব বাংলায় ৫৮২টি কোয়রান্টিন সেন্টারও গড়ে তোলা হয়।

২) দ্রুত সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু কোভিড-১৯কে অতিমারি হিসেবে ঘোষণা করার আগেই, মুখ্যমন্ত্রী অনুমান করেন করোনাভাইরাস যে এক গণস্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা আনতে চলেছে । একদিন আগেই তাঁর সংসদীয় দলের স্ট্যান্ডিং কমিটির এক জরুরি সভা ডাকা হয়েছিল, তা বাতিল করা হয়। ১৬ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী ২০০ কোটি টাকার এক আপৎকালীন তহবিল গঠন করেন।

৩) অন্যান্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের বার্তা : মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগাম বুঝতে পেরেছিলেন যে, লকডাউনের ফলে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা। ২৬ মার্চ তিনি ১৮টি রজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে পরিযায়ী শ্রমিকদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য আবেদন রাখেন।

৪) সর্বপ্রথম লকডাউনের সিদ্ধান্ত: জাতীয় স্তরে লকডাউন ঘোষিত হওয়ার আগেই ২২ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা সহ রাজ্যের কয়েকটি জায়গায় লকডাউনের নির্দেশ দেন ।

৫) বিনামূল্যে রেশন: ২০ মার্চ ভর্তুকির আওতাধীনদের বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয় । ৩০ জুন মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, এই বিনামূল্যে রেশন পাওয়ার মেয়াদ ২০২১-এর জুন পর্যন্ত বাড়ানো হল।

৬) উচ্চ মানের মাস্ক বিতরণ: রাজ্যের ৩ কোটিরও বেশি বাসিন্দাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ত্রিস্তর বিশিষ্ট উচ্চমানের মাস্ক বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ১২ এপ্রিলের মধ্যে মাস্ক পরাকে বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে রাজ্য সরকার।

৭) গ্লোবাল অ্যাডভাইসরি কমিটি গঠন: অতিমারির ফলে তৈরি হওয়া আর্থ-সামাজিক বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য এক গ্লোবাল অ্যাডভাইসরি কমিটি গঠন করা হয়, যেখানে অগ্রণী স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও রাখা হয়। এই কমিটি ইতিমধ্যে ১৩টি বৈঠক করেছে।

৮) রাজ্যে বিনামূল্যে চিকিৎসা: কোভিড-১৯ আক্রান্তদের বিনামূল্যে চিকিৎসা পরিষেবা দিচ্ছে বাংলা। এই চিকিৎসার সম্পূর্ণ খরচ রাজ্য সরকার বহন করছে। সেই সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে ‘স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের’ অধীনে ৭.৫ কোটি মানুষের ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মূল্যের চিকিৎসা বিনামূল্যে করার নির্দেশও দেওয়া হয়।

৯) বিমা কভারেজ: মার্চ মাসে বাংলার সরকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের কর্মী—চিকিৎসক, সাফাইকর্মী, ফার্মাসিস্ট, নার্স, কুরিয়ার কর্মী, আশা কর্মী, সাংবাদিক, পুলিশ কর্মী এবং তাঁদের পরিবারের  লোকজনের জন্য ১০ লক্ষ টাকার বিমা কভারেজ ঘোষণা করে ।

১০) পেনশনের ব্যবস্থা : দু’মাসের সামাজিক সুরক্ষা পেনশন ও ভাতা অগ্রিম দেওয়া হয়।
১১ ) পরীক্ষাগারের সংখ্যা বৃদ্ধি : মার্চের শেষ দিকে রাজ্যে কোভিড -১৯ পরীক্ষার জন্য মাত্র ২টি ল্যাবরেটরি ছিল। এখন সেই ল্যাবের সংখ্যা ৫৪। কেন্দ্র সকারের পাঠানো ত্রুটিযুক্ত কিট পাঠানো সত্ত্বেও মার্চের মধ্যে বাংলায় কোভিড পরীক্ষা ৪৪১ গুণ বেড়েছে। রাজ্যে এই মুহূর্তে প্রতিদিন ১৩ হাজার স্যাম্পলের পরীক্ষা হচ্ছে।

১২) পরীক্ষা ও চিকিৎসার খরচে লাগাম :  জুন মাসে মুখ্যমন্ত্রী বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড পরীক্ষার ব্যয় ২২৫০ টাকা, প্রতিদিনের পিপিই-র ব্যয় ১০০০ টাকা এবং চিকিৎসকের সাম্মানিক দৈনিক ১০০০ টাকা নির্দিষ্ট করে দেন।
১৩) বিনামূল্যে আইসোলেশনের ব্যবস্থা: রোগলক্ষণ ছাড়া বা সামান্য লক্ষণ যুক্ত কোভিড রোগীদের মধ্যে যাঁদের বাড়িতে থেকে চিকিৎসার তেমন সুবিধা নেই, তাঁদের জন্য  বিনামূল্যে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করেছে রাজ্য । কেন্দ্র সরকারও এই পদক্ষেপের প্রসংশা করেছে। অন্য রাজ্যকে এই বিষয়ে ‘বেঙ্গল মডেল’ অনুসরণ করতে বলেছে।
১৪ ) কর্মনিযুক্তিতে জোর: সেরে ওঠা রোগীদের তালিকা তৈরি করে বাংলার সরকার তাঁদের ‘কোভিড যোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। বাংলা জুড়ে হাসপাতালগুলিতে নন মেডিক্যাল কর্মী হিসেবে তাঁদের নিযুক্তির কথাও ভাবা হচ্ছে।  জেলা শাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে , পরিযায়ী শ্রমিকদের দক্ষতা ভিত্তিক তালিকা প্রস্তুত করে উপযুক্ত কাজের ব্যবস্থা করতে ।
১৫) শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তা: বাংলার সরকার ‘স্নেহের পরশ’ প্রকল্পের মাধ্যমে লকডাউনে অন্য রাজ্যে আটকে পড়া প্রায় এক লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে এককালীন ১ হাজার টাকা অর্থসাহায্যের ব্যবস্থা করেছে।
‘প্রচেষ্টা প্রকল্প’ দ্বারা রাজ্য সরকার অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের এককালীন ১০০০ টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। বাংলার সরকার এ রাজ্যের শ্রমিকদের ভিন্‌ রাজ্য থেকে ফেরাতে ট্রেন ভাড়ার সম্পূর্ণটাই বহন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
১৬) সর্বক্ষণের কোভিড-১৯ হেল্পলাইন: রাজ্য সরকার একটি ওয়ান স্টপ কোভিড-১৯ হেল্পলাইন চালু করেছে, যাতে একটাই মাত্র ফোন কল দ্বারা কোনও সন্দেহভাজন রোগী প্রয়োজনীয় সহায়তা পেতে পারেন।

১৭) গার্হস্থ্য হিংসা সংক্রান্ত হেল্পলাইন:  লকডাউন পর্বে মহিলাদের উপর গার্হস্থ্য হিংসা বেড়েছে। পশ্চিম বঙ্গের কমিশন ফর উইমেনস রাইটস এই সংক্রান্ত একটি হেল্পলাইন চালু করেছে। ৯৮৩০৯৪৭২৪৭ নম্বরে ডায়াল করে এই সংক্রান্ত অভিযোগ জানানো যাবে।

১৮) বাড়ি বাড়ি মিড ডে মিল : আইসিডিএস প্রোগ্রামের মাধ্যমে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের মাধ্যমে শিশুদের মিড ডে মিল বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
১৯) মৃতদের স্বজনের জন্য চাকরির বন্দোবস্ত:  ১৬ জুলাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয় যে, কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রয়াত রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের স্বজনদের চাকরির ব্যবস্থা করা হবে ।

Previous articleপূর্ব বর্ধমানে পুলিশ আধিকারিক সহ নতুন করে ভাইরাস আক্রান্ত ৩৫ জন!
Next articleগুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট: প্রাণে বাঁচলেন বিজেপি নেতা