বঙ্গ-বিজেপি ভোটে যেতে কতখানি তৈরি ( ২ ) কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

ভোট-রাজনীতিতে অন্য রাজ্যের সঙ্গে বাংলার বিস্তর ফারাক আছে৷ এখানে যেমন শুধুই ‘ধর্ম’-কে ইস্যু বানিয়ে ভোটে যাওয়া যায়না, তেমনই রাজ্যের প্রায় ২৮ শতাংশ নাগরিককে ভোট-ময়দানের বাইরে রেখে সাফল্য পাওয়া কষ্টকর৷ কংগ্রেস, বামফ্রন্ট বা তৃণমূল, কেউই এই বিপুল সংখ্যক সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটারদের আস্থা এড়িয়ে ক্ষমতায় আসতে পারেনি৷

ভোট মানেই অঙ্কের খেলা, অঙ্ক কষে ভোট বৃদ্ধির ক্ষেত্রগুলি চিহ্নিত করে, সেখানে প্রভাব বিস্তার করতে না পারলে ‘গুড-লুজার্স’ হয়েই অভিনন্দন কুড়াতে হয়৷ তথাকথিত ‘আদর্শের’ ভূমিকা ভোট রাজনীতিতে খুবই কম৷ তা না হলে সিপিএম ও কংগ্রেস জোট গড়ে একসঙ্গে ভোট চাইতে নামতো না৷ আরও আগে, বিজেপি এবং তৃণমূলও ১৯৯৯ সালে একসঙ্গে ভোটে যেত না৷ এতে তেমন কোনও নীতিহীনতা নেই৷ গোটা দেশের প্রায় সব রাজ্যেই বিচিত্র সব জোট দেখা যায় একটাই কারনে, ভোট পাওয়ার ক্ষেত্র বৃদ্ধি করা৷ এবং এই কারনেই দেশের এক একটি রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি এক এক টাইপের জোট গড়েই ভোটে যাচ্ছে, যাতে এক বা একাধিক শরিকের ভোট বিজেপি নেতৃত্বাধীন ফ্রন্টে এসে মেশে৷ কিছুটা ভোট এখনও ধরে রাখতে পেরেছে, বাংলার এমন কোনও দলই বিজেপির সঙ্গে জোট গড়ে বা আসন সমঝোতা করে বিধানসভা ভোটে যাবে না, এটা নিশ্চিত৷ ফলে শরিক দলের বাড়তি ভোট পদ্ম-শিবিরে ভিড়ছে না৷

দ্বিতীয়ত,, ২০১১-র সেন্সাস রিপোর্ট বলছে, পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যা ৯১.২৭৬.১১৫ এবং এর মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা ২৪.৬৫৪.৮২৫ জন৷ শতাংশের হিসাবে বাংলার মোট জনসংখ্যার
২৭.০১ শতাংশই মুসলিম৷ এটা ২০১১-র হিসাব, এখন এই হিসাব বদলে গিয়েছে, রাজ্যে মুসলিম পপুলেশন প্রায় ২৯-৩০ শতাংশ৷

তাহলে, বঙ্গ-বিজেপির ভোটের অঙ্ক কী বলছে ? প্রথমত, অন্য প্রায় সব রাজ্যে ‘জোট গঠন’ করার যে ফয়দা বিজেপি তুলছে, বাংলায় তা হচ্ছে না৷ ফলে সামান্য যে ৩-৪ শতাংশ ভোট বৃদ্ধির সম্ভাবনা ছিলো, সেটা নেই৷ এবং দ্বিতীয়ত, রাজ্যের কমবেশি ২৯-৩০ শতাংশ মুসলিম ভোট বিজেপি এড়িয়ে চলছে৷ ভোটের দোরগড়ায় এসেও তেমন কোনও উদ্যোগ নিয়ে রাজ্য বিজেপিকে পথে নামতে দেখা যায়নি৷ ফলে একুশের ভোটে ৭০ শতাংশ হিন্দু ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পদ্মফুলেই ছাপ দেবে, এটা ধরেই নিয়েছে বিজেপি৷ এটা বুঝতে পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই যে, ৭০% অ-মুসলিম বা হিন্দু ভোটের মধ্যে তৃণমূল, বিজেপি বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের ভোট আছে৷
কোনও ভোটেই সামগ্রিকভাবে ১০০ শতাংশ ভোট কাস্টিং হয়না৷ ওদিকে, ৭০% শতাংশ হিন্দুর সবাই যে ভোটার তেমন হতে পারে না৷ এই ৭০% জনসংখ্যার যারা ভোটার, তাদের মধ্যে তৃণমূল, কংগ্রেস, বাম এবং অন্য দলের ভোটার আছেই৷ তাহলে শুধু এই ৭০% ভোটের কত শতাংশ ভোট একাই বিজেপি পেয়ে সরকার গড়বে ? অন্য রাজ্যে মুসলিম প্রার্থী না দিয়ে বা মুসলিম ভোটের তোয়াক্কা না করে বিজেপি ভোটে গেলেও, এ রাজ্যে সেই ফরমুলার কপি-পেস্ট কতখানি কার্যকর হবে, তা দলের শীর্ষনেতারা নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখছেন৷

রাজ্যে তৃণমূল ঘর গুছিয়ে ভোট ময়দানে নেমে পড়লেও বঙ্গ-বিজেপি এখনও সে পথে হাঁটা শুরুই করতে পারেনি৷ দলের অন্তর্কলহ প্রকাশ্যে চলে এসেছে৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে উঠছে, ৪ সাংসদ তৃণমূলে যাচ্ছেন, সভাপতি বদল হচ্ছে, রাজ্য থেকে একজন কেন্দ্রীয় কমিটিতে অথবা মন্ত্রিসভায় ঢুকছেন৷ এসবই জল্পনা, কিন্তু বিজেপির মতো সংগঠিত দলে এ ধরনের জল্পনা এমনি এমনি হয়না৷
দিল্লির বৈঠকে কাজের কথা কতখানি হয়েছে, তা ওই দলের নেতারা বলতে পারবেন, কিন্তু ম্যারাথন বৈঠককে কেন্দ্র করে ‘মঞ্চস্থ’ হওয়া একাধিক একাঙ্ক নাটকের কথা রাজ্যবাসী শুনেছেন৷ মোটের উপর, বঙ্গ- বিজেপি এখনও একুশের ভোটে যেতে তৈরি হতেই পারছেনা৷

রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিমদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করার কাজ বিজেপি গত ৬ বছর ধরে শুরুই করতে পারেনি৷ রাজ্য কমিটিতে একজনও প্রভাবশালী মুসলিম মুখ নেই৷ দলের সংখ্যালঘু মোর্চার কাজ ঠিক কী, তা দলের নেতা-কর্মীরাও বুঝতে পারছেন না৷ বঙ্গ- বিজেপির সর্বস্তরের নেতারা একবগ্গা হয়ে তৃণমূল কংগ্রেসকে ‘মুসলিমদের দল’ বলে প্রচার করে চলেছে৷ নিশ্চয়ই তাঁদের ধারনা, এমন বলা হলে হিন্দুভোটের বড় অংশ গেরুয়া শিবিরে আসবে৷ নেহাতই কষ্টকল্পনা৷ বিজেপি নেতারা মুসলিমদের প্রতি এতখনি উষ্মা প্রকাশ না করে কেন্দ্রীয় সরকার মুসলিমদের জন্য যে সব প্রকল্প ঘোষণা করেছে, তার প্রচার করলে তা ইতিবাচক হয় এবং কাজের কাজ কিছু হতেও পারে৷ কিন্তু কে বোঝাবে ৷ বঙ্গ-বিজেপির কোন কোন নেতা কেন্দ্রের” ওস্তাদ প্রকল্প”, “মঞ্জিল প্রকল্প” বা
“হুনর হাট প্রকল্প”-র কথা জানেন, তা নিয়েই সন্দেহ আছে৷ মুসলিম এলাকার উন্নয়ণে সত্যিই এ পর্যন্ত কেন্দ্র কিছু গঠনমূলক কাজ করে থাকলে, তা প্রচার করার দায়িত্ব কার ?
মাঝে মধ্যেই শোনা যায়,
RSS অনুমোদিত মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ বা MRM নাকি রাজ্যের দিকে নজর দিয়েছে৷ MRM-এর মার্গদর্শক ইন্দ্রেশ কুমার নাকি খোঁজখবর নিচ্ছেন৷ খোঁজখবর নেওয়া মানে
বাইপাসের ধারে এক পাঁচতারা হোটেলে বসে বঙ্গ-বিজেপির কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলা৷ একুশের ভোটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বঙ্গ-বিজেপি এখনও বলছে, রাজ্যের মুসলিমদের মধ্যে কীভাবে দলের সমর্থন বাড়ানো সম্ভব তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা চলছে। কবে আলোচনা শেষ হবে, কবে রাজ্য-কমিটিতে গ্রহণযোগ্য মুসলিম-মুখ আসবে, কবে কাজ শুরু করবে, তা কেউই জানেনা৷

বঙ্গ-বিজেপির নেতাদের গতিবিধিই বলছে, রাজ্যের ২৯-৩০ শতাংশ মুসলিম ভোট বাদ দিয়েই শাসন ক্ষমতা দখল করা যাবে, এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত৷ কৌশলগত কারনেও মুসলিম ভোটব্যাঙ্কে ফাটল ধরানোর কাজে নামলে নাকি হিন্দুভোট হাতছাড়া হবে৷ অবশ্য রাজ্য- বিজেপি ‘আশাবাদী’, আসাউদ্দিন ওয়াইসি’র ‘মিম’ এ রাজ্যে ঢালাও প্রার্থী দিয়ে মুসলিম ভোটে ভাগ বসালেই কেল্লা ফতে ! বাংলার ভোট-রাজনীতিতে এখনও কি সড়গড় হতে পারেননি বঙ্গ-বিজেপির নেতারা ?

বাংলায় মুসলিম ভোট অবজ্ঞা করে ক্ষমতায় আসা সহজ না কঠিন, তা বোঝা যাবে একুশের বিধানসভা ভোটের ফলপ্রকাশের পরেই৷

Previous articleরাজস্থানের দলত্যাগী ৬ BSP বিধায়ককে হাইকোর্টের নোটিশ
Next articleলকডাউনেই সাধ, শুভশ্রীর ছবি ভাইরাল স্যোশাল মিডিয়ায়