আজ মোহনবাগানেরও জন্মদিন, এক ইতিহাসের শুরু

দেবাশিস সেনগুপ্ত

ব্রিটিশরা যখন পরাধীন ভারতে ফুটবল নিয়ে আসে, তখন এই খেলাটিকে সবার আগে রপ্ত করে নিয়ে আঁকড়ে ধরে বাঙালীরা। ব্রিটিশ শাসকদের চিন্তায় ছিল, ফুটবল নামক নেশায় বাঙালীদের বুঁদ করে রেখে স্বাধীনতার আন্দোলনকে স্তিমিত করে রাখা। কিন্তু তাদের এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়।শোষকের অস্ত্রকে তাই শোষকের বিরুদ্ধেই ঢাল করবার সিদ্ধান্ত নিলো বাঙালীরা।এরই মধ্যে ১৮৭৭ সালে প্রথম বাঙালী হিসেবে ফুটবলে পা ছোঁয়ান নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী।

এই খেলাটিকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে যায় বাঙালীর আবেগ, বাঙালীর উচ্ছ্বাস, বাঙালীর ভালবাসা। বাঙালীর দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে ওঠে ফুটবল। বাঙালীর মানসিকতায় দারুণ প্রভাব ফেলে সহজ, রোমাঞ্চকর এই খেলাটি। বাঙালীর কারণেই সেই ব্রিটিশ আমলে উপমহাদেশের ‘ফুটবলের রাজধানী’ হিসেবে বিবেচিত হত কলকাতা। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বাঙালীদের কাছে ফুটবল হয়ে ওঠে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রধান অস্ত্র। পরাধীন দেশে প্রতি পদে পদে অপমানে গুমরে মরছিল বাঙালী। এই রকম একটা সময়ে খেলার মাঠে ব্রিটিশদের সঙ্গে সমানতালে লড়াই দেবার একটা সুযোগ এসে যায় বাঙালীর সামনে। মাঠের ফুটবলে ব্রিটিশদের যখন দেশীয় ফুটবলাররা নাজেহাল করে দিতেন, তা দেখে খুব আনন্দ পেত বাঙালীরা। আর বাঙালীদের দল জিতলে কিছুক্ষণের জন্য হলেও পাওয়া যেত পরাধীনতার গ্লানি থেকে ‘মুক্তি’র আনন্দ। ফুটবল খেলাকে বাঙালী যত গভীরভাবে ভালোবেসেছে আর তার জন্য যতটা আত্মত্যাগ করেছে, তা তুলনাহীন। এই উপমহাদেশে ফুটবল খেলাকে জনপ্রিয় করে তুলতে বাঙালীর ভূমিকা অবিসংবাদিতভাবে স্বীকৃত। একথা আজ সর্বজনবিদিত যে ফুটবল খেলার সঙ্গে বাঙালীর রয়েছে গভীর নাড়ীর টান। এই খেলাটি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে বাঙালীর মনে-প্রাণে।

এরই মধ্যে ১৮৮৫ সালে রাজা জিতেন্দ্রকৃষ্ণ দেব প্রতিষ্ঠা করেন শোভাবাজার ক্লাব।নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী শোভাবাজার রাজবাড়ির সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়ে জড়িয়ে যান শোভাবাজার ক্লাবের সঙ্গে।এর পাশাপাশি কুমোরটুলি ক্লাবও জন্ম নেয় এই সময়েই।এই ১৮৮৫তেই বি ভি গুপ্তর উদ্যোগে টাউন ক্লাবের জন্ম হয়।উত্তর কলকাতার এই তিনটি ক্লাবের সঙ্গে দক্ষিণ কলকাতায় ন্যাশনাল ক্লাবের প্রতিষ্ঠা করেন কালীঘাট হাইস্কুলের শিক্ষক মন্মথ কুমার গাঙ্গুলী।অর্থাৎ ১৮৮৫তে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সূচনার সময় কলকাতায় চার চারটি ফুটবল ক্লাবের প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ হয়ে যায়।১৮৮৭ সালে কলকাতার মুসলিম সমাজ নবাবজাদা আমিনুল ইসলামের আনুকূল্যে “জুবিলি ক্লাব” তৈরী করে, যা ১৮৯১ সাল থেকে পরিচিত হয় মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব নামে।১৮৮০র দশকেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়েছিল।

এই সময়ে শ্যামবাজার অঞ্চলে এদিক ওদিক এক দু’টি বাড়ি, বাকি সব ফাঁকা মাঠ বা পুকুর।শিয়ালদা থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল আপার সার্কুলার রোড, যা পরে পরিচিত হয় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড নামে।শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের কাছে দুটি রাস্তা আপার সার্কুলার রোডের সঙ্গে মেশে, যাদের নাম ছিল মোহনবাগান লেন (২৯/০৮/১৮৯০ তারিখে নামকরণ করে কলকাতা পৌরসভা) আর ফড়িয়াপুকুর স্ট্রিট।মোহনবাগান লেন তৈরীর জন্য জমি দান করেছিলেন সে সময়ের বিশিষ্ট ধনী ব্যক্তি কীর্তিচন্দ্র মিত্র।মোহনবাগান লেন আর ফড়িয়াপুকুর স্ট্রিটের মাঝে ছিল এক বিরাট বাগান, যার নাম ছিল “মোহনবাগান”।এর মালিক ছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ দেবের ছেলে গোপীমোহন দেব।গোপীমোহন দেবের এক উত্তরাধিারীর কাছ থেকে “মোহনবাগান” কিনে নেন কীর্তিচন্দ্র মিত্র।এবং তিনি সেখানে এক বিরাট অট্টালিকা তৈরী করান বিখ্যাত ইঞ্জিনীয়ার নীলমণি মিত্রকে দিয়ে।যার নাম রাখা হয় “মোহনবাগান ভিলা”।এর উত্তরে ছিল ফড়িয়াপুকুর স্ট্রিট (১৯৬০ সালে কলকাতা পৌরসভা এর নামকরণ করে শিবদাস ভাদুড়ী স্ট্রিট), পূর্বে আপার সার্কুলার রোড, দক্ষিণে মোহনবাগান লেন এবং পশ্চিমে কীর্তি মিত্র লেন।“মোহনবাগান ভিলা”র মধ্যেই ছিল এক বিরাট মাঠ।কীর্তি মিত্রের মৃত্যুর পরে “মোহনবাগান ভিলা”র মালিক হন তার ছেলে প্রিয়নাথ মিত্র।

সেই মাঠে তখন খেলতেন দুখীরাম মজুমদারের স্টুডেন্ট ইউনিয়নের ছেলেরা আর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা নামী আইনজীবী ভূপেন্দ্রনাথ বসুর বাড়ির ছেলেরা এবং বাগবাজার সেনবাড়ির ছেলেরা।ভূপেন্দ্রনাথ বসু পরে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন।কিছুদিন পরে স্টুডেন্ট ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায় আর দুখীরাম মজুমদার তার ঘনিষ্ঠদের নিয়ে শ্যামপুকুর লাহাদের মাঠে চলে যান ও পরে এরিয়ান ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন।বাগবাজার সেনবাড়ির ছেলেরা চলে যান তাদের বাড়ির সামনের মাঠে, যা পরিচিত ছিল শ্যাম স্কোয়ার নামে আর পরে যার নাম হয় সুভাষ উদ্যান।এখানেই তৈরী হয় বাগবাজার ক্লাব।বাকিরা থেকে যান “মোহনবাগান ভিলা”তে।নিজেদের মধ্যে খেলা আর ইতস্তত বাগবাজার আর এরিয়ানের সঙ্গে খেলার বাইরে আর কিছু করার ছিল না তখন।স্বাধীনতা আন্দোলনকে সাহায্য করার জন্য নতুন ক্লাবের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে ভীষণভাবে।

এজন্য উত্তর কলকাতার ফড়িয়াপুকুর মোহনবাগান অঞ্চলের মিত্র ও সেন পরিবারের সাহায্যে ভূপেন্দ্রনাথ বসু ১৮৮৯ সালের ১৫ অগস্ট ‘মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ দিন একটি সভা বসে ১৪ নম্বর বলরাম ঘোষ স্ট্রিটে ভূপেন্দ্রনাথ বসুর বাড়িতে।সভার সভাপতি ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ বসু।ঐ সভাতেই ‘মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা হয় যার প্রথম সভাপতি ও প্রথম সম্পাদক ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ বসু ও তার ভাইপো যতীন্দ্রনাথ বসু।প্রথম অধিনায়ক ছিলেন মণিলাল সেন।রেনকিন্সের দোকান থেকে খেলোয়াড়দের পোশাক তৈরীর দায়িত্ব পান প্রিয়নাথ মিত্র।ক্লাব তৈরীর সূচনালগ্নে পৃষ্ঠপোষক ছিলেন প্রিয়নাথ মিত্র, ব্যারিস্টার হরিহর দাস, হেমনাথ সেন, সতীশচন্দ্র মিত্র, শরৎচন্দ্র মিত্র, গিরীন বসু, ডঃ মণীন্দ্রনাথ বসু, মনমোহন পান্ডে প্রমুখ।

বিশিষ্ট ব্যক্তিরা জড়িত থাকায় প্রবল জনপ্রিয় হয় এই ক্লাব।অনেকেই এই ক্লাবে সদস্য হয়ে যোগ দিতে চান। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রশাসক যতীন্দ্রনাথ বসু ক্লাবের ভিত্তি গড়ে তোলার জন্য কড়া নিয়মাবলী রচনা করেন।চাইলেই যে কেউ এই ক্লাবে সদস্য হয়ে যোগ দিতে পারতেন না।প্রথমে পর্যবেক্ষণে রেখে শুধু ছাত্রদেরই পরে সদস্য করা হত।পড়াশোনার অগ্রগতি, ব্যক্তিগত আচার আচরণও ছিল সদস্য হওয়ার মাপকাঠি।খেলাধুলোর সাথে চরিত্র গঠনও ছিল মোহনবাগান ক্লাবের আদর্শ।

কথিত আছে যে মোহনবাগান ভিলায় ইডেন হিন্দু হোস্টেলের বিরুদ্ধে এই দল প্রথম খেলেছিল।প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ঠিক আগে অধ্যাপক এফ. জে. রো জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, এই দল কোনো রাইফেল শ্যুটিং বা আংলিং বা এই জাতীয় খেলার সঙ্গে যুক্ত কিনা। মোহনবাগান এই জাতীয় খেলার সঙ্গে যুক্ত নয় জেনে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন দলের নাম পালটে ‘মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব’ রাখতে। ক্লাবের কর্মকর্তারা এই পরামর্শ মেনে নিয়ে ক্লাবের নাম পরিবর্তন করেন।১৮৯১ সালে কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলে লাহা কলোনীর মাঠে এই দল চলে আসে। পরে এই দল উঠে যায় শ্যাম স্কোয়ার অঞ্চলে।এখন তাদের সবাই চেনে গঙ্গাপারের ক্লাব নামে।

১৩১ বছর ধরে ভাল মন্দ নানা স্মৃতি বহন করে আজও এগিয়ে চলেছে গঙ্গাপারের ক্লাব৷প্রথমে ক্লাবের প্রতীক ছিল গাছের তলায় বিশ্রামরত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার৷পরে ক্লাবের প্রতীক হল জলের ওপর পাল তোলা নৌকো৷ অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে ক্লাবের এতগুলো বছর কেটেছে৷ কখনও ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা হয়েছে ক্লাবের নাম৷ কখনও আবার তীব্র ক্ষোভে পুড়েছে ক্লাবের সুনাম৷

ক্লাবের আঁতুড়ঘরকে স্মরণীয় করে রাখতে জন্মদিন পালনে মোহনবাগানের তরফে সেভাবে এখন তেমন উদ্যোগ এই দিনে নেওয়া হয় না।১৫ই আগস্টে ক্লাব তাঁবুতে স্বাধীনতা দিবসের পতাকা তোলা ছাড়া আর কোনও সরকারী কর্মসূচি এখন নেই৷ হয়ত বড় করে ২৯ জুলাই “মোহনবাগান দিবস” পালনই এর কারণ।কর্তৃপক্ষের মতে, ওই দিনটা না থাকলে, মোহনবাগান ক্লাবের অস্তিত্বই হয়ত থাকত না৷ তাই ওটাই তাদের কাছে প্রতিষ্ঠা দিবস থেকে শুরু করে সব কিছু৷

শুভ জন্মদিন, মোহনবাগান।❤❤
শুভ স্বাধীনতা দিবস, সবাইকে।🙏🙏

Previous article“এত মিথ্যাচারের পরেও খারাপ লাগে না?” ট্রাম্পকে প্রশ্ন সাংবাদিকের
Next articleস্বাধীনতা দিবসে ভারতীয় জওয়ানদের শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জানালেন কোহলি-যুবরাজ