সিংহের গুহায় ঢুকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, ওরা কোথায় ভুল করছে : প্রণব মুখোপাধ্যায়

২০১৮ সালের ৬ জুন৷ আজীবনের নিষ্ঠাবান কংগ্রেসি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় সেদিন পা রাখলেন নাগপুরে আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সদর দফতরে৷ এই ঘটনা দেশের রাজনৈতিক মহলে সেদিন বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিলো৷ কংগ্রেসের অন্দরেও ঝড় উঠেছিলো এ ঘটনায়৷ ঝড় ওঠাই স্বাভাবিক৷ হিন্দুত্ববাদীদের সদর দফতরে প্রণববাবু অতিথি হয়ে যাবেন, আর তা নিয়ে বিতর্ক হবে না, তা আবার হয় নাকি ? ফলে নানা আলোচনা, নানা ব্যাখ্যায় তখন প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলো ভারতীয় রাজনীতি৷

তখন এ বিষয়ে একটা কথাও বলেননি প্রণববাবু ৷ কিন্তু এর কিছুদিন পরেই সোনিয়া সিং নামে এক সাংবাদিককে তাঁর নাগপুর যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। সোনিয়া সিংয়ের লেখা
‘ডিফাইনিং ইন্ডিয়া : থ্রু দেয়ার আইজ’ বইতে প্রণববাবু বলেছিলেন, “আমি সিংহের গুহায় ঢুকেছিলাম। সেখানে ঢুকেই ওদের বোঝাতে চেয়েছিলাম, ওরা কোথায় ভুল করছে।” এই কথাতেও সেদিন বিতর্ক হয়৷ প্রশ্ন ওঠে, ঠিক কাদের ‘সিংহ’ বলতে চাইলেন প্রণববাবু?
সোনিয়া সিংয়ের এই বই-এ প্রণববাবুর সাক্ষাৎকার আছে। তাঁকে ‘ভারতরত্ন’ দেওয়ার প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে নরেন্দ্র মোদি ও ইন্দিরা গান্ধীর তুলনা, নানা বিষয়ে মন খুলেই কথা বলেছেন প্রণববাবু। সবটাই ছাপা হয়েছে৷
সোনিয়া সিং তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ” এটা ঠিকই প্রণব মুখোপাধ্যায় এখন আর সক্রিয় রাজনীতিতে নেই, কিন্তু রাজনীতিতে এখনও ভীষণ প্রাসঙ্গিক। তাই তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি জানা খুব দরকার ছিলো”৷

সোনিয়ার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গেই আরএসএস দফতরে তাঁর যাওয়ার বিষয় উঠে আসে। কংগ্রেস হাই কম্যাণ্ড প্রকাশ্যেই প্রণববাবুকে নাগপুর যেতে নিষেধ করেছিল। প্রণববাবু তা আমল দেননি৷ সেদিন টিভির পর্দায় দেখা গিয়েছিলো, সঙ্ঘের মঞ্চে বসে প্রণববাবুর ভাষণ মন দিয়ে শুনছেন সংঘপ্রধান মোহন ভাগবত। সেদিন ‘সিংহের গুহা’য় দাঁড়িয়ে নিজের ভাষণে ভারতের বহুত্ববাদী চরিত্র সম্পর্কে স্বয়ংসেবকদের উপদেশ দিয়েছিলেন প্রণববাবু। একের পর এক উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’ পাতা থেকে। প্রণববাবু সেদিন ভাগবত সাহেবের উপস্থিতিতেই সংঘকর্মীদের বলেছিলেন, ধর্ম- জাতি-ঘৃণা-অসহিষ্ণুতার ভিত্তিতে ভারতের জাতীয় চরিত্র ব্যাখ্যা করতে গেলে আখেরে ভারতের শাশ্বত পরিচয়টাই হারিয়ে যাবে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, “ভারতের আত্মার মধ্যেই আছে বহুত্ববাদ ও সহিষ্ণুতা। শত শত বছর ধরে নানা মতাদর্শকে আমরা আত্মস্থ করেছি। এইভাবেই আমাদের বহুত্ববাদের আদর্শের জন্ম হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি ধর্মনিরপেক্ষতায়। পরকে আপন করে নেওয়াই আমাদের ধর্ম। এই সংস্কৃতিই আমাদের জাতি হিসাবে গড়ে তুলেছে।”

‘ডিফাইনিং ইন্ডিয়া : থ্রু দেয়ার আইজ’-এর লেখিকার প্রশ্নের উত্তরে রাখঢাক না করেই প্রণববাবু জানিয়েছিলেন, “সিংহের গুহায় ঢুকে ওদের ভুলটা ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম”৷

জাতীয় রাজনীতিতে কেন কংগ্রেসের বিকল্প হিসাবে বিজেপি ঘাঁটি গেড়ে বসতে পেরেছে, সে বিষয়েও নিয়েও স্পষ্ট বক্তব্য ছিলো প্রণববাবুর। তাঁর ধারনা, হিন্দুত্বের এই সংজ্ঞা ও তার রাজনীতিকরণ সাময়িক৷ প্রণববাবুর মত, ‘‘কংগ্রেসকে দরকার। কংগ্রেস ছাড়া দেশটা ‘বলকান’ হয়ে যাবে। এই অবস্থা চিরস্থায়ী হবে না। হিন্দুত্ব বিরাট একটা ব্যাপার। তা মানুষকে আপন করে নেওয়ার কথা বলে। আমরা কি পাকিস্তানের মতো হতে চাই? আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট বাইবেল হাতে শপথ নেন। ইংল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রীদের শপথ গ্রহণের সময় বাইবেল হাতে নেন রানি। কিন্তু আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী শপথ নেওয়ার সময় আমরা সংবিধানকে গুরুত্ব দিই। ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের এই সাধারণতন্ত্রের ভিত্তি”, এমনই ব্যাখ্যা মন্তব্য প্রণববাবুর।

সকলকে অবাক করেই, ২০১৯ সালের সাধারণতন্ত্র দিবসের আগে মোদি সরকার প্রণববাবুকে ভারতরত্ন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলো। প্রণববাবু এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “২৫ জানুয়ারি সন্ধ্যা ছ’টায় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ফোন করেন। জানতে চান, আমি ‘ভারতরত্ন’ গ্রহণ করব কি না। সাধারণতন্ত্র দিবসের আগে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ভারতে এসেছিলেন। তাঁকে নিয়ে মোদি ব্যস্ত ছিলেন। তাই নিজে আমার কাছে আসতে পারেননি। ফোনেই সম্মতি নেন। তিনি চাইছিলেন, সেই সন্ধ্যাতেই ‘ভারতরত্ন’ প্রাপকের নাম ঘোষিত হোক। আমার সম্মতি না পেলে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করতে পারছিলেন না। আমি তখনই সম্মতি দিই।”

প্রণববাবু সোনিয়া সিংকে জানিয়েছেন, তাঁর মেয়ে শর্মিষ্ঠা এতে খুব রেগে গিয়েছিলেন। “মেয়ে বলেছিলো, তুমি ভারতরত্ন পাচ্ছ। অথচ তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, কিছুই হয়নি। তুমি আমাকে পর্যন্ত জানাওনি!” বললাম, আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা না হলে বলা যায় না। শর্মিষ্ঠা উত্তরে বলেছিলো, আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আবার কী দরকার? প্রধানমন্ত্রী নিজে যখন ফোন করে বলেছেন, তখন তো এতে আর কোনও সন্দেহ থাকতে পারেনা।”

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির তুলনা প্রসঙ্গে প্রণববাবু এই বইয়ে বলেছেন, এই দু’জনের মধ্যে অমিলই তো বেশি। ইন্দিরা ছিলেন চূড়ান্ত ধর্মনিরপেক্ষ। তাঁরা দু’জনেই দু’বার করে অরুণাচল প্রদেশে গিয়েছেন। ওই রাজ্যে মাত্র দু’টি লোকসভা আসন আছে। কিন্তু দুই প্রধানমন্ত্রীই জাতীয় স্বার্থের কথা মাথায় রেখে অরুণাচলে গিয়েছেন। তাঁরা উভয়েই চেয়েছেন, চিনকে কঠোর বার্তা দিতে।

বিরোধীরা নানা ইস্যুতে নির্বাচন
কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও কমিশনকে ক্লিনচিটও দিয়েছেন প্রণববাবু। সোনিয়া সিংয়ের বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, “আমরা যদি আমাদের দেশের সাংবিধানিক সংস্থাগুলিকে মজবুত করতে চাই তাহলে মনে রাখতে হবে, এ ধরণের সংস্থা আসলে দেশের কাজে লাগে। আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি সাফল্য পেয়ে থাকে তাহলে তার সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে নির্বাচন নির্বিঘ্নে আয়োজন করতে পারার বিষয়টি। সে ব্যাপারে দেশের প্রথম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন থেকে শুরু করে এখনকার মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সকলেরই ভূমিকা রয়েছে। তাঁরা নিজেদের কাজ ঠিক করে পালন করছেন। তাঁদের সমালোচনা করা যায় না। নির্বাচন আয়োজনে কোনওরকম ত্রুটি হয়নি। দেশের সংস্থাগুলি নিজেদের মতো কাজ করছে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সেগুলি আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি যার কাজের দক্ষতা নেই সে যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জাম নিয়ে প্রশ্ন তোলে। যার কাজের দক্ষতা আছে সে জানে, কোন যন্ত্রকে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়।”

Previous articleমোদিকে ডিসলাইক ! কমেন্টস সেকশন লক হলো
Next articleজ্ঞানী ও উচ্চমার্গের রাষ্ট্রনেতা ছিলেন প্রণব, শোক জানিয়ে বললেন মোদি