মোদিজি’র দম্ভেই NDA, BJP-তে ফাটল, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

দ্বিতীয় দফায় চেয়ারে বসার পর থেকে কৃষিবিল পেশের আগে পর্যন্ত রাজ্যসভায় নরেন্দ্র মোদিকে এত সমস্যায় পড়তে হয়নি। সব বিলই পাশ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কৃষিবিলের পরীক্ষাই ছিলো সবচেয়ে কঠিন। এবং সেই পরীক্ষায় ডাহা ‘ফেল’ করেছেন মোদি এবং তাঁর দল৷ পাশাপাশি, কৃষিবিল নিয়ে অহেতুক ইগোর লড়াইয়ে গিয়ে মোদি ‘নিজের সংসারে’ ফাটলও ধরিয়ে দিয়েছেন৷

কড়া হুইপ ছিলো বিজেপির তরফে, সব সাংসদকে রবিবার রাজ্যসভায় হাজির থাকতেই হবে৷ রাজ্যসভায় একসঙ্গে দু’টি বিল পাশ করাতে হলে ভোটাভুটির মধ্যে যেতে হতে পারে, এমন ধারনা ছিলো বিজেপির৷ সে কারনেই ওই হুইপ৷ কিন্তু সেই হুইপ অমান্য করে বেশ কয়েকজন গেরুয়া- সাংসদ রাজ্যসভার অধিবেশন এড়িয়েছেন৷

প্রচলিত সংসদীয় রীতি মেনে রাজ্যসভায় কৃষিবিলকে ভোটাভুটিতেই পাঠানো উচিত ছিলো৷ কিন্তু সে পথে না গিয়ে সরকার কেন ‘ধ্বনি-ভোটে’ বিল পাশ করাতে গেলো, তা নিয়ে বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে৷ বস্তুত মোদি সরকারের এই ‘ফুলটস’ বল’কে সীমানার বাইরে পাঠাতে একটুও সময় নেননি বিরোধী সাংসদরা৷ বিজেপি’র এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তেই বিরোধীরা মোদি সরকারকে ‘গণতন্ত্রের- খুনি’ বলে চিহ্নিত করারও অস্ত্র পেয়েছে৷

প্রশ্ন উঠছে, কার কথায় নির্দিষ্ট সংসদীয় বিধিকে সরাসরি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এই বিব্রতকর অবস্থায় পড়লো বিজেপি ? ওইদিন রাজ্যসভায় বিজেপি সাংসদদের উপস্থিতির হার যা ছিলো, তাতে সরকারপক্ষ নিশ্চিতভাবেই কমপক্ষে ৫ ভোটে হেরে যেত৷ তেমন ঘটলে একইসঙ্গে অনেক সমস্যায় পড়তে হতো নরেন্দ্র মোদিকে ৷ প্রধান সমস্যা হতো, বিরোধীরা একযোগে তাঁর ইস্তফা দাবি করে বসলে৷ ৫৬ ইঞ্চির ছাতিতে সেক্ষেত্রে পিন ফুটে যেতোই৷ সেই ‘পরাজয়’ এড়াতেই নরেন্দ্র মোদি ধাপার মাঠে পাঠালেন সংবিধান ও সংসদীয় বিধিকে৷
ভারতীয় সংবিধানের ১০০ নং ধারা বলছে, ”…. all questions at any sitting of either House or joint sitting of the Houses shall be determined by a majority of votes of the members present and voting…” অর্থাৎ রাজ্যসভা বা লোকসভা, সংসদের দুই কক্ষেই সমস্ত প্রশ্ন উপস্থিত সদস্যদের ভোটদানের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে।

ওদিকে, রাজ্যসভার পদ্ধতি ও নিয়মাবলীর ১২৫ নং বিধিতে বলা হয়েছে, “Any member may move an amendment that a bill be referred to a select committee and if, the motion is carried, the bill shall be referred to such a committee.” অর্থাৎ কোনও সাংসদ যদি কোনও বিল সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর জন্য কোনও সংশোধনী পেশ করে এবং সেই সংশোধনী যদি ভোটাভুটিতে পাশ হয়, তাহলে বিল সিলেক্ট কমিটিতেই যাবে। সিলেক্ট কমিটিতে যাওয়ার পরের নিয়মে বলা আছে, কমিটি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে কৃষক সংগঠন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের লিখিত বা মৌখিক বক্তব্য শুনবে এবং শোনার পর সিলেক্ট কমিটি বিল সম্পর্কে তার সুপারিশ সভার কাছে পাঠাবে। এটাই নিয়ম৷

কেন্দ্র রবিবার এর কোনওটিকেই তোয়াক্কা করেনি৷ রবিবার রাজ্যসভায় তৃণমূল দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন-সহ একাধিক বিরোধী সাংসদ একাধিক সংশোধনী নির্দিষ্ট নিয়মে জমা দিয়েছিলেন৷ কিন্তু এদিন সেসব সংশোধনী উপেক্ষা করে রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান বীরের মতো সরাসরি ঘোষণা করে দেন, দুটি বিলই ধ্বনি ভোটে পাশ হলো। অথচ যে সমস্ত সংশোধনী জমা পড়েছিল তা ভোটাভুটির জন্য গ্রহণ করতে আইনি বিধি অনুসারে ডেপুটি চেয়ারম্যান বাধ্য ছিলেন। সম্ভবত নির্দিষ্ট কোনও স্তর থেকে ‘নির্দেশ’ পাওয়ার পর ডেপুটি চেয়ারম্যান আর বিধিসম্মত পথে হাঁটেননি৷ কারন, রাজ্যসভার উপস্থিতি দেখে বিজেপি প্রমাদ গোনে৷ পরাজয় নিশ্চিত৷ তারপরই দ্রুত বিজেপি ঠিক করে সংবিধান ও নির্দিষ্ট সংসদীয় বিধি জাহান্নামে যাক, যেভাবেই হোক সরকারের পরাজয় রুখতেই হবে৷ আইনের বাইরে গিয়ে সেই কাজটাই ডেপুটি চেয়ারম্যানকে দিয়ে করিয়েছে মোদি সরকার৷
রবিবার বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকার ভোটাভুটির পথে না যাওয়ার একমাত্র কারন, সরকারের কাছে বিল পাশ করানোর মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভোট ছিল না। হুইপ জারি করা সত্ত্বেও বিজেপি ও শরিকদের বহু সাংসদ অনুপস্থিত ছিলেন। রাজ্যসভায় এখনও পর্যন্ত মোদি সরকারের গরিষ্ঠতা নেই। ওদিকে বিজেপি শরিক অকালি দল মন্ত্রিসভা ছেড়েছে এই ইস্যুতে। অপর শরিক হরিয়ানার JJP-র ওপর বিরোধীরা চাপ বাড়িয়েছে কৃষি বিলের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার জন্য। হরিয়ানা ও পাঞ্জাবে এই ইস্যুতে কৃষক বিক্ষোভ ক্রমশই বৃদ্ধি পাওয়ার জেরেই নিজেদের অবস্থান বদলে বিল-বিরোধিতার পথে গিয়েছে অকালি দল। বিজেপির হিসেব ছিলো মোট ২৪৫ জনের রাজ্যসভায়, ১৩০ সদস্যের সমর্থন তারা পাবে। এর মধ্যেই আছে AIADMK-র ৯, TRS-এর ৭ এবং YSR-কংগ্রেসের ৬ সদস্য। আর বিজেপির নিজের আছে ৮৬ সাংসদ৷ অকালি বিপক্ষে ভোট দিলেও শিবসেনার ৩ জন কৃষি বিলের সমর্থনে ভোট দেবে বলে হিসাব করা হয়। ওদিকে বিরোধীদের প্রাথমিক হিসেব ছিলো, সব মিলিয়ে ১০০ জনের বেশি সাংসদ এই বিলের বিরোধিতা করবেন। আর এর সঙ্গে পরোক্ষে যোগ হয় একাধিক বিজেপি সাংসদের গরহাজিরা, অকালির পাশাপাশি TRS, BJD এবং JJP-র মতবদল৷ সঠিক সময়েই বিজেপি নিশ্চিত হয়, পাশার চাল উল্টে গিয়েছে৷ অঙ্ক মিলছে না৷ এই অবস্থায় রাজ্যসভার পদ্ধতি ও নিয়মাবলীর ১২৫ নং ধারা মানলে, পরাজয় নিশ্চিত৷

কেন এই হাল হলো অমিতপরাক্রমী নরেন্দ্র মোদির ? কেন নিজের দলের বেশ কয়েকজন সাংসদ সেদিন পরিকল্পিতভাবেই গরহাজির থাকলেন ? তাহলে তারাও কি কৃষি বিলের বিরোধী ? বিরোধী তো বটেই, না হলে হুইপ থাকা সত্বেও এতজন একসঙ্গে সেদিন ছিলেন না কেন?

কেন হাজির হননি দলের কয়েকজন সাংসদ, সে কথা নিশ্চয়ই ভাবছে বিজেপি৷ শোনা যাচ্ছে, যারা হুইপ পেয়েও অনুপস্থিত থেকে দলকে এভাবে গাড্ডায় ফেলেছেন, তাদের কাছে গরহাজিরার কারন জানতে চাইবেন জে পি নাড্ডা৷ ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে দলের এই সাংসদদের শো-কজ, সাসপেণ্ড পর্যন্ত করার কথা না’কি ভাবা হয়েছে৷ এতেই তো প্রমান হচ্ছে, মোদির কৃষিবিল নিয়ে NDA-তে ফাটল লেগেছে, নিজের দলের অন্দরেও ফাটল দেখা দিয়েছে৷ বিজেপির শীর্ষস্তরের একাংশও এমনই মনে করছেন৷ এই ফাটল এখনই ‘ম্যানেজ’ করতে না পারলে দলে ভাঙ্গন দেখা দিতে পারে বলেও এই অংশের আশঙ্কা৷ এবং এই আশঙ্কা সৃষ্টির কারিগর একমাত্র নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর জেদ৷

এত ঘটনাতেও কিন্তু কোনও শিক্ষা নেয়নি বিজেপি৷ কেন শরিক এবং দলের একাংশ কৃষিবিলের বিরোধিতা করলো, তার ময়না তদন্তে না গিয়ে, হেভিওয়েট গেরুয়া নেতারা খাতা-পেন্সিল নিয়ে বসেছেন৷ রাজ্যসভার হাজিরা খাতা খতিয়ে দেখে তৈরি হচ্ছে দলের অনুপস্থিত সাংসদদের তালিকা৷ আরও মারাত্মক তথ্য, এদের মধ্যে এমন কয়েকজন আছেন, যারা শনিবার পর্যন্ত রাজ্যসভায় উপস্থিত থাকলেও, রবিবার কৃষি বিল পেশের মতো বিজেপির বাঁচা-মরার দিনে সংসদে পা রাখেননি৷ আসলে নরেন্দ্র মোদি গাড্ডায় পড়েন একেবারে শেষ মুহুর্তে নবীন পট্টনায়েকের BJD নিজেদের অবস্থান বদল করায়৷ মোদিজি স্বপ্নেও ভাবেননি, BJD বিরোধী দাবি সমর্থন করে কৃষি বিল সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর কথাই বলবে৷
দলীয় সাংসদদের লোক দেখানো শাস্তি দেওয়ার ‘নাটক’ করার আগে নরেন্দ্র মোদি একবার ভেবে দেখতে পারতেন, জেদ করে এমন কোন ‘পাপ’ তিনি করলেন, যাতে অকালি, বা TRS বেঁকে বসার পর JJP, BJD সরে গেলো, কেন বিজেপির একাধিক সাংসদও অনুপস্থিত থাকলেন ? দায়িত্ব নিয়ে NDA-তে তো বটেই, বিজেপি-তেও ফাটল লাগালেন নরেন্দ্র মোদি৷

এই অপরাধ-এর শাস্তি নরেন্দ্র মোদিকে দেওয়ার সাহস বিজেপি’র আছে ?

আরও পড়ুন- ৬ অক্টোবর পর্যন্ত বিচারবিভাগীয় হেফাজতের মেয়াদ বাড়ল রিয়া–সৌভিকদের

Previous article৬ অক্টোবর পর্যন্ত বিচারবিভাগীয় হেফাজতের মেয়াদ বাড়ল রিয়া–সৌভিকদের
Next articleঅত্যাবশ্যক আইনে সংশোধন কি আমজনতার বড় বিপর্যয় ডেকে আনছে?