৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২: এই রায় চূড়ান্ত নয়, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর অযােধ্যায় ঐতিহাসিক ষোড়শ শতাব্দীর বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার প্রায় ২৭ বছর পর, লখনউয়ের এক বিশেষ CBI আদালত, আগামীকাল, বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, এই ফৌজদারি মামলার রায় ঘোষণা করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই হাই- প্রোফাইল মামলায় মূল অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির দুই ‘মার্গদর্শক’ লালকৃষ্ণ আদবানি ও মুরলি মনোহর যোশি৷ আছেন কল্যাণ সিং, নৃত্যগোপাল দাস, উমা ভারতী, বিনয় কাটিয়ার, সাধ্বী রীতাম্ভরা প্রমুখ নেতা-নেত্রীরাও৷ যেহেতু বিচার শেষ হয়েছে, তাই “এখন বিশ্ব বাংলা সংবাদ” এই মামলা সংক্রান্ত বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরার চেষ্টা করছে৷

🔴 বাবরি মসজিদ ধ্বংস মামলার বহু প্রতীক্ষিত রায় ২৮ বছর পর মঙ্গলবার ঘোষণা হলেও এই রায় কিন্তু চূড়ান্ত রায় নয়। রায় পছন্দ না হলে অভিযুক্তরা হাইকোর্ট এবং তারপর শীর্ষ আদালতেও যেতে পারে, এই রায় চ্যালেঞ্জ করে।

🔴 অনেকেরই মনে আছে, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর, বিতর্কিত ওই মসজিদটি বিশাল পুলিশ বাহিনীর চোখের সামনেই ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিলো। সেদিন যারা অযোধ্যায় মসজিদ ভাঙ্গতে সমবেত হয়েছিলেন, তারা প্রধানত ভারতীয় জনতা পার্টি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, শিবসেনা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বজরং দলের ‘ডেডিকেটেড’ বাহিনি৷ এর সঙ্গে ‘প্রভাবিত’ কিছু সংগঠনও ছিলো৷ সেদিন মসজিদ ধ্বংসের পরেই ত্রিপল টাঙ্গিয়ে রাতারাতি একটি অস্থায়ী মন্দিরও নির্মাণ করা হয়েছিলো।

🔴 এই মামলার মোট ৪৯ জন অভিযুক্তের মধ্যে ১৭ জন মারা গিয়েছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম শিবসেনা প্রধান বাল ঠাকরে এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা অশোক সিঙ্ঘল।

🔴 আগেই বলা হয়েছে, যে ৩২ জন অভিযুক্ত জীবিত আছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রবীণ বিজেপি নেতা এল কে আদবানি, মুরলী মনোহর যোশী, কল্যাণ সিং, মোহন্ত নৃত্যগোপাল দাস, উমা ভারতী, সাক্ষী মহারাজ, ব্রজভূষণ শরণ সিং, বিনয় কাটিয়ার প্রমুখ।

🔴 মামলার ৫০ জনেরও বেশি সাক্ষী মারা গিয়েছেন। বাস্তব এটাই, বাবরি মামলার অভিযুক্ত, সাক্ষী এবং আইনজীবীরাও বৃদ্ধ এবং দুর্বল হয়ে পড়েছেন। মামলায় মোট ৩৫০ জন সাক্ষীর বয়ান রেকর্ড করা হয়েছে। মামলার সাক্ষ্যের প্রমাণ হিসেবে ভলিউম ডকুমেন্ট এবং আইটেম রেকর্ডে রাখা হয়েছে।

🔴 একসময়ে বেপথে চলে যাওয়া তদন্ত এবং মামলার শুনানি গতি পায় ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল, সুপ্রিম কোর্ট যেদিন, ২ বছরের মধ্যে বিচার শেষ করার আদেশ দেয়। ২০১৯-এর ১৯ জুলাই শীর্ষ আদালত ১৪২ ধারার ভিত্তিতে আইনি অধিকার ব্যবহার করে বিশেষ আদালতের বিচারক সুরেন্দ্র কুমার যাদবের মেয়াদ বৃদ্ধি করে এবং তাকে ৯ মাসের মধ্যে রায় ঘোষণার নির্দেশ দিয়েছিলো৷ সেই সময়সীমাও পার হয় এ বছরের এপ্রিল মাসে৷

🔴 বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার পরপরই দু’টি FIR হয়েছিলো৷ প্রথম FIR (নং ১৪২/১৯৯২ এবং কেস নং১৯৭/১৯৯২)- বলা হয়, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে “লক্ষ লক্ষ অজ্ঞাত করসেবক” চত্বরে ঢুকে মসজিদের ক্ষতিসাধন করেছে৷ এই নাম-ধাম না জানা ‘হামলাকারীদের’ বিরুদ্ধে FIR দায়ের করা হয় মসজিদ ভেঙ্গে ফেলার কয়েক মিনিট পরেই৷

🔴 ‘রামজন্মভূমি’ থানায় এক সাব- ইন্সপেক্টর গঙ্গাপ্রসাদ তিওয়ারি, তাঁর করা FIR-এ বলেছিলেন, “দুপুর ১২টা বা ১২.১৫ মিনিটে ফিক্সিং গেট নং ১ (বাবরি মসজিদের রেলিং ব্যারিকেড) দিয়েই হাজার হাজার ‘করসেবক’ -এর একটি দল চবুতরার কাছে জড়ো হতে শুরু করে। ‘করসেবকদের’ হাত ‘ফাওদা’, ‘সম্বল’, ‘গাইতি’, ‘বেকচা’ (এ সবই বাড়ি নির্মাণের সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়) ছিলো। সাধু বা পুরোহিতদের ‘করসেবা’ করতে দেওয়ার পরিবর্তে জোর করে তাঁরা নিজেরাই ‘সেবা’ করতে শুরু করেন। তারপরই শুরু হয় মসজিদ ভাঙ্গার কাজ৷ তাদের এই কাজ করতে বাধা দেওয়া হলে তারা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে৷ তারা মসজিদের চারপাশে লোহার গ্রিল নামিয়ে মসজিদের চূড়ায় উঠে তা ভেঙ্গে ফেলতে শুরু করে।

আরও পড়ুন- পিপিই পরেই করোনা আক্রান্ত রোগীর মাথায় অস্ত্রোপচার করলেন কলকাতার চিকিৎসকরা

🔴 ওই সাব-ইনস্পেক্টর আরও বলেন, সেখানে মোতায়েন থাকি পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। এর ফলে বিভিন্ন দিক থেকে ‘জয় শ্রী রাম’ এবং অন্যান্য উস্কানিমূলক স্লোগান উঠতে থাকে। সেই সময় আরেকটি শক্তিশালী করসেবক দল বাবরি মসজিদ কমপ্লেক্সে জড়ো হয় এবং চারদিক থেকে ভবনের উপর হামলা চালাতে শুরু করে। লাঠিচার্জে কাজ না হওয়ায় সেখানে উপস্থিত পুলিশ বাহিনীকে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুঁড়তে বলা হয়। এই আদেশমতো পুলিশ গ্যাসচার্জ করে৷ কিন্তু ‘করসেবকদের’ থামাতে ব্যর্থ হয়। তারা পুলিশ বাহিনীর উপর পাথর ছুঁড়তে শুরু করে। পুলিশের এই অভিযানে বেশ কয়েকজন ‘করসেবক’ আহত হয়, তখনও ভাঙচুর চলতে থাকে। বিতর্কিত সৌধ অবশেষে ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং কমপ্লেক্সের মধ্যে থাকা বেশ কিছু সরকারি সম্পত্তি, যেমন ওয়্যারলেস সেট, সিসিটিভি ক্যামেরা, ড্রাগন লাইট, দড়ি, কাঁটাতারের বেড়া, চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি ধ্বংস করা হয়।

🔴 সাব- ইন্সপেক্টরের এই অভিযোগের ভিত্তিতে নাম না জানা করসেবকদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৯৫ (ডাকাতি), ৩৯৭ (ডাকাতি), ৩৩২ (জেনে বুঝে সরকারি কর্মচারীকে আহত করা), ৩৩৭ (জীবন বিপন্ন করা) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। অন্যদের মধ্যে ৩৩৮ জন (অন্যদের জীবন বা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিপন্ন করা), ২৯৫ (যে কোন শ্রেণীর ধর্মকে অপমান করার উদ্দেশ্যে উপাসনাস্থলে আঘাত করা বা অপমান করা), ২৯৭ (অনুপ্রবেশ), ১৫৩এ (ধর্ম, জাতির ভিত্তিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা প্রচার করা) ধারায় মামলা হয়৷

🔴 ওই সাব- ইন্সপেক্টর গঙ্গাপ্রসাদ তিওয়ারির অভিযোগ অনুযায়ীই আদবানি, অশোক সিঙ্ঘল, গিরিরাজ কিশোর, মুরলি মনোহর যোশি, উমা ভারতী, বিনয় কাটিয়ার, বিষ্ণুহরি ডালমিয়া এবং সাধ্বী রীতাম্ভরার বিরুদ্ধে একই অভিযোগের ভিত্তিতে দ্বিতীয় FIR (নং ১৪৩/১৯৯২ এবং কেস নং ১৯৮/১৯৯২) দায়ের করা হয়।

🔴 এই দ্বিতীয় FIR- এ তিওয়ারি বলেছিলেন, “আমার দায়িত্ব পালনের পর আমি বিতর্কিত কমপ্লেক্সের ‘রাম কথা কুঞ্জে’ পৌঁছে যাই৷ সেখানে তার আগেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অশোক সিঙ্ঘল, গিরিরাজ কিশোর, ভারতীয় জনতা পার্টির লালকৃষ্ণ আদবানি, মুরলী মনোহর যোশী, বিষ্ণু হরি ডালমিয়া উস্কানিমূলক ভাষণ দিচ্ছিলেন৷ সেই সময় করসেবকদের মধ্যে থেকে স্লোগান ওঠে “এক ধাক্কা অউর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো”। বিশিষ্ট বক্তারা তখন জনতাকে কাঠামোটি ভেঙ্গে ফেলার আহ্বান জানাতে থাকে৷ অভিযুক্ত জনতা তখনও একই স্লোগান দিতে থাকে৷ আওয়াজ ওঠে, “রাম লালা হাম আয়েঙ্গে, মন্দির ওয়াহি বানায়েঙ্গে”৷ স্লোগান দিতে দিতেই
উপস্থিত বড় বড় নেতারা মসজিদ ভেঙ্গে ফেলার জন্য ‘করসেবকদের’ উত্তেজিত করছিলেন। এরপরই বিতর্কিত সৌধ ভেঙ্গে ফেলা হয়৷ এই জাতীয় অখণ্ডতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ওখানে সেই সময় হাজির থাকা পুলিশ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকরা এই ঘটনার সাক্ষী।”

আরও পড়ুন- কোভিডে আক্রান্ত উপ-রাষ্ট্রপতি ভেঙ্কাইয়া নাইডু

🔴 পরবর্তী সময়ে আরও ৪৭টি FIR নথিভুক্ত করা হয়। এগুলো ছিল সাংবাদিকদের উপর হামলার সাথে সম্পর্কিত৷ তাদের ক্যামেরা এবং অন্যান্য গ্যাজেট লুট এবং ধ্বংস করার অভিযোগ আনা হয় ওইসব FIR-এ৷

🔴 মজার বিষয়, “অজ্ঞাত করসেবকদের” বিরুদ্ধে মামলাও তদন্তের জন্য CBI-এর কাছে পাঠানো হয়েছিলো৷ এবং CBI একজনকেও চিহ্নিত করতে পারেনি৷

🔴 তদন্ত শেষে CBI ও CID ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৮ জন অভিযুক্ত, অশোক সিঙ্ঘল, গিরিরাজ কিশোর, লালকৃষ্ণ আদবানি, মুরলি মনোহর যোশি, বিষ্ণু হরি ডালমিয়া, বিনয় কাটিয়ার, উমা ভারতী এবং সাধ্বী রীতাম্বরার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে।

🔴 এই মামলার বিচারের জন্য ললিতপুরে একটি বিশেষ CBI আদালত চালু করা হয়। পরে, যাতায়াতের সুবিধার কথা মাথায় রেখে এই আদালত রায়বেরেলিতে স্থানান্তরিত করা হয়।

🔴 ১৯৯৩ সালের ৫ অক্টোবর, CBI অবশেষে লখনউয়ের বিশেষ আদালতে ৪৯টি মামলায় ৪০ জনের বিরুদ্ধে একটি সমন্বিত চার্জশিট দাখিল করে। ১৯৯৬ সালের ১১ জানুয়ারি এই মামলায় আরও ৯ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দাখিল করা হয়। তাই, অভিযুক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৯।

🔴 এই মামলারই দীর্ঘ শুনানি শেষ করে, ২৭ বছর পর রায় ঘোষণা হতে চলেছে, আগামীকাল, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখে৷

আরও পড়ুন- চাকরির কথা বলে তিন তরুণীকে ফ্ল্যাটে আটকে দেহ ব্যবসা

Previous articleচাকরির কথা বলে তিন তরুণীকে ফ্ল্যাটে আটকে দেহ ব্যবসা
Next articleহবে না দুর্গাপুজো! ঐতিহ্য রক্ষায় যোগীকে চিঠি বাংলা পক্ষ’র