মহামারীর দিনে পুজো: মন ভালো নেই প্রতিমা শিল্পীদের

খায়রুল আলম, ঢাকা

শারদীয় দুর্গা পূজার বাকি আর তিন সপ্তাহ; হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় এই উৎসবে প্রতিমা তৈরির কাজে ব্যস্ত মৃৎশিল্পীদের এখন দম ফেলার সময় নেই। কিন্তু করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে আয় কমে যাওয়ায় সেই আনন্দ এবার নেই তাদের মনে।গত মার্চ মাসে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর পণ্ড হয়ে যায় বাসন্তী পূজার আয়োজন। প্রতিমা তৈরির কার্যাদেশ দিয়েও তা বাতিল করেন আয়োজকরা।

মহামারীর মধ্যে জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা থাকায় এ বছর রাষ্ট্রীয় অনেক অনুষ্ঠান বাতিল করতে হয়েছে। মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুই ঈদও পালিত হয়েছে বিধিনিষেধের মধ্যে সীমিত পরিসরে। ফলে এবার দুর্গা পূজার আয়োজন নিয়েও শঙ্কা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে পূজা আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর মহালয়াও হয়ে গেছে।

পঞ্জিকা অনুযায়ী, ২২ অক্টোবর মহাষষ্ঠী তিথিতে হবে বোধন, দেবীর ঘুম ভাঙানোর বন্দনা পূজা। পরদিন শুক্রবার সপ্তমী পূজার মাধ্যমে শুরু হবে দুর্গোৎসবের মূল আচার অনুষ্ঠান। ২৬ অক্টোবর সোমবার মহাদশমীতে বিসর্জনে শেষ হবে দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।

কিন্তু মহামারীর দিনে এই দুর্গোৎসবে সেই আড়ম্বর আর থাকছে না, শারদীয় এই উৎসবের সব ক্ষেত্রেই থাকছে স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়ি।

বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মৃৎশিল্পীরা জানান, প্রতিবছর পূজার চার মাস আগে থেকে তাদের প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয়। কিন্তু এবার অনিশ্চয়তার কারণে প্রতিমা তৈরির কাজ তারা পেয়েছেন একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে। আর যেসব কাজ পেয়েছেন, তাতে দাম মিলবে আগেরবারের তুলনায় ‘অনেক কম’।
১৯৯২ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর মৌলবাদী হামলা হয়। তার প্রতিবাদে সে বছর প্রতিমা গড়ে পূজার আয়োজন বন্ধ রেখেছিল দেশের হিন্দু সম্প্রদায়। সেবার চরম ধাক্কা খেয়েছিলেন মূর্তি গড়ে জীবন ধারণ করা মৃৎশিল্পীরা।

প্রায় তিন দশক পর মহামারীর কারণে আবারও বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ার কথা বললেন ‘চট্টগ্রাম মৃৎশিল্পী সমিতির সভাপতি রতন পাল।

তিনি বলেন, “প্রত্যেকটি পূজা কমিটি তাদের খরচ কমিয়ে ফেলেছে। কিন্তু প্রতিমা তৈরির সরঞ্জামের দাম তো বেড়েছে। প্রতিবছর দুর্গা পূজা ঘিরে আমাদের আয়ের যে সম্ভাবনা থাকে, এবার সেটা নষ্ট হয়ে গেছে।”

রোজগার কম হলেও পূজার আয়োজন হচ্ছে বলে মৃৎশিল্পীরা ‘বেঁচে থাকার অবলম্বনটুকু’ পাচ্ছেন বলে মন্তব্য রতনের। “এটুকু না হলে হয়ত বেঁচে থাকাটাই কঠিন হত। অনেকেই হয়ত পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেত। তাতে এই সম্প্রদায়ের লোকজনের টিকে থাকাই কঠিন হত।”

চট্টগ্রাম পূজা উদযাপন কমিটির হিসাবে এবার নগরীতে পূজা হবে ২৭০টি মণ্ডপে। বিভিন্ন উপজেলা ও পারিবারিক মিলিয়ে আরও দেড় সহস্রাধিক মণ্ডপে পূজো হওয়ার কথা রয়েছে।

আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আগে তারা মণ্ডপ সাজাতে যে টাকা খরচ করতেন, এবার তা অর্ধেকে নেমেছে। প্রতিমা হবে, তবে আগের মত আড়ম্বর থাকবে না।

চট্টগ্রামের সদরঘাট এলাকায় প্রতিমা গড়ার কাজ করেন সুজন পাল। পারিবারিকভাবে এই পেশায় যুক্ত সুজনও বললেন, গত কয়েক দশকে এমন পরিস্থিতিতে তাদের আর পড়তে হয়নি। তিনি জানান, প্রতিমা তৈরির উপকরণ খড়, মাটি, পাট, সুতো- সবকিছুরই দাম এবার বেশি। কিন্তু প্রতিমার বাজেট নেমেছে আগের বছরের অর্ধেকে। ফলে তাদের কাজ সারতে হচ্ছে খরচ যতটা পারা যায় কম রেখে।“এই দুর্গা পূজার ওপরই নির্ভর করে দেশের মৃৎশিল্পীদের আয় রোজগার। কিন্তু এ বছরটা আমাদের খুব খারাপ গেল।”

দুর্গা পুজো ঘিরে মৃৎশিল্পীদের যে ব্যস্ততা শুরু হয়, তা চলে ফাল্গুন-চৈত্র মাস পর্যন্ত। সরস্বতী আর বাসন্তী পূজার মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়। সুজন বলেন, “দুর্গা পূজার আগে এবার যে পরিস্থিতি যাচ্ছে, এটাই যদি চলতে থাকে, আগামী পূজাগুলোতেও আমাদের আয় রেজগার থাকবে না।”

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে এই শিল্প এবার যে ধাক্কা খেয়েছে, সামনে পরিস্থিতি ভালো হলেও মৃৎশিল্পীদের সামলে উঠতে কয়েক বছর লেগে যাবে বলে সুজনের ধারণা।

প্রবীণ মৃৎশিল্পী অমর পাল বলেন, “এ বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে পূজা নিয়ে সিদ্ধান্ত এসেছে অনেক দেরিতে। সে কারণে ইচ্ছে থাকলেও প্রতিমা সেভাবে তৈরি করা যাচ্ছে না।” গত বছর ৫০টি প্রতিমা তৈরি করা অমর এবার ২৭টি প্রতিমার কাজ নিয়েছেন। সেই কাজ সময়মত শেষ করতে রাতদিন খেটে যাচ্ছেন তিনি। “মাস খানেক আগে আমরা সিদ্ধান্ত পেলাম যে পূজার আয়োজন হবে। লকডাউনে অনেক কারিগর বাড়ি চলে গিয়েছিল, তাদের সবাইকে আনা সম্ভব হয়নি। ফলে অনেকে প্রতিমা তৈরির জন্য অর্ডার নিয়ে এলেও ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।”

Previous articleবাংলাদেশ থেকে শুরু আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইট
Next articleআজই আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু ফুলবাগান মেট্রোর