পিকে ম্যাজিকেই প্রকাশ্যে গুরুং? বদলে গেল পাহাড়ের সমীকরণ

ফের রাজ্য রাজনীতির শিরোনামে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সর্বাধিনায়ক বিমল গুরুং। সুবাস ঘিসিং পরবর্তী সময়ে পাহাড় তথা দার্জিলিংয়ের রাজনৈতিক সমীকরণ যিনি একক দক্ষতায় বদলেছেন, তাঁর নাম বিমল গুরুং। এই রাজনৈতিক নেতা একাধিক ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত থাকার দরুণ পুলিশের রেকর্ডে “ফেরার” ছিলেন। একটা সময় কার্যত রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে “যুদ্ধ” ঘোষণা করে সন্ত্রাসবাদী তকমা পর্যন্ত পেয়েছিলেন বিমল গুরুং-রোশন গিরি-সহ তাদের বিশ্বস্ত অনুগামীরা। রাজ্যের সঙ্গে সু-সম্পর্ক বজায় রেখে তাঁদের জায়গা নিয়েছিলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার আরেক নেতা বিনয় তামাং। কিন্তু গুরুং-এর জনপ্রিয়তার ধারে কাছ দিয়েও যেতে পারেননি বিনয়। অনেক সুযোগ পাওয়ার পরও রাজনৈতিকভাবে শাসক দলকে সেভাবে পাহাড় রাজনীতির লভ্যাংশও দিতে পারেননি। অনেক বিতর্ক থাকলেও, বিমল গুরুং যে এখনো পাহাড় রাজনীতির শেষ কথা সেটা কার্যত প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে “ফেরার” থেকেও পাহাড় থেকে বিজেপি তথা এনডিএ জোট প্রার্থীকে জেতানোর ক্ষমতা দেখিয়েছিলেন বিমল গুরুং। তাই গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার এই বিতর্কিত শীর্ষ নেতার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা প্রশ্নাতীত দেখেই তাঁকে ফের দলে টানার প্রস্তুতি শুরু করেছিল রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। অবশেষে সফল। গুরুং এখন এনডিএ ছেড়ে তৃণমূলের পাশে। একুশের বিধানসভা নির্বাচন আগে কার্যত পাহাড়ের আসনগুলি নিশ্চিত করে ফেললো ঘাসফুল শিবির।

এবার দেখে নেওয়া যাক কোন পথে বিজেপির মোহভঙ্গ হয়ে কোন পথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে বিমল গুরুং–

পর্ব-১: আজ, বুধবার পঞ্চমীর দিন গোটা রাজ্য যখন শারদ উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক তখনই হঠাৎ কলকাতায় আগমণ বিমল গুরুংয়ের। পুলিশের ডায়েরিতে একজন “ফেরার আসামী” কোন সাহসে কলকাতার বুকে প্রকাশ্যে পা রাখলেন? এবং তাঁকে গোর্খা ভবনে ঢোকানোর জন্য বিধাননগর পুলিশ প্রাণপণ চেষ্টা করলেন? জল্পনার শুরু সেখান থেকেই। দীর্ঘ ৩ বছর পর বুধবার আচমকা কলকাতায় উদয় হলেন বিমল গুরুং। চর্চা তো হবেই!

পর্ব-২ অনেক চেষ্টা করেও সল্টলেকের গোর্খা ভবনে যখন ঢুকতে পারলেন না বিমল গুরুং, তখন তিনি বাইপাস ধরে সোজা চলে যান ধর্মতলা চত্বরের এক অভিজাত হোটেলে। আরে গোটা রাস্তায় পুলিশ তাঁকে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দিয়েছে। জানা যাচ্ছে, অনেক আগে থেকেই ধর্মতলার ওই হোটেলে গুরুং-গিরি ও তাঁদের বেশ কয়েকজন সহযোদ্ধাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অবশেষে সেখানে গিয়েই স্বস্তিতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার শীর্ষনেতা বিমল গুরুং। পাশে তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সৈনিক রোশন গিরি।

পর্ব-৩ রাজ্যের খাতায় উগ্রপন্থী ও সন্ত্রাসবাদী তকমা পাওয়া একজন “ফেরার আসামি” কিভাবে এত নিশ্চিন্তে হাসিমুখে রাজ্য রাজধানীর রাজপথে স্বচ্ছন্দে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছেন এবং রাষ্ট্রের পুলিশ তাঁর নিরাপত্তা দিচ্ছে! এই ছবিটা দেখার পর মোটামুটি সিনারিও স্পষ্ট হতে শুরু করে।

পর্ব-৪ ধর্মতলার পাঁচতারা হোটেলে বসে বিমল গুরুং ঘোষণা করলেন, এনডিএ ছেড়ে এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের সঙ্গে জোট করতে চান। মুখ্যমন্ত্রীর আসনে ফের মমতাকেই দেখতে চান। কিন্তু কী এমন হল যে গুরুং এমন ডিগবাজি খেলেন?

পর্ব-৫ এতক্ষণে বোঝা গেল কিভাবে এতটা স্বচ্ছন্দে রয়েছেন বিমল গুরুং। শোনা যাচ্ছে, রাজ্যের এক মন্ত্রী নাকি গত এক মাস ধরে বিমল গুরুংয়ের সঙ্গে লাগাতার যোগাযোগ রাখছিলেন।

আরও পড়ুন- গুরুংয়ের সঙ্গে কী বোঝাপড়া হয়েছে রাজ্য জানাক, দাবি অশোকের

পর্ব-৬ আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিভিন্ন মহল থেকে সামনে আসতে শুরু করলো। যদিও তার কোনও আনুষ্ঠানিকতা নেই। বিভিন্ন সূত্র অসমর্থিত থেকে শোনা যাচ্ছে, আসল খেলাটা খেলেছেন সেই তিনিই! গুরুং-এর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন তৃণমূলের ভোটকৌশলী প্রশান্ত কিশোর। যদিও সেই বৈঠকের কোনও তথ্য-প্রমাণ এখনও পর্যন্ত কারও হাতে নেই।

পর্ব-৭ এখানেও অসমর্থিত সূত্রের খবর। গত ৩ মাস আগে থেকেই বিমল গুরুংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয় তৃণমূলের। মাঝে দিল্লিতে প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে বৈঠকও হয় তাঁর। তারপরও একাধিকবার কথা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে,শিলিগুড়িতে প্রশান্ত কিশোর ও তৃণমূলের অন্যতম বড় শীর্ষনেতার সঙ্গে বৈঠক হয় বিমল গুরংয়ের প্রতিনিধিদের। যেখানে অবশ্য সশরীরে হাজির ছিলেন না গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার বিতর্কিত এই নেতা। আরও শোনা যাচ্ছে, গুরুংয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলছিলেন রাজ্যের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী। আসানসোলের ওই নেতার সঙ্গে ঝাড়খন্ডেও বৈঠক হয়েছে বিমল গুরুংয়ের।

পর্ব-৮ আজ, বুধবার দুপুরে নাকি ওই মন্ত্রীর কোয়ার্টারে যান বিমল গুরং। সেখানে ছিলেন প্রশান্ত কিশোর। তখনো তাঁর শহরে আসার খবর কেউ টের পাননি। ওই বৈঠকেই চূড়ান্ত হয় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার শীর্ষনেতা। সেইমতো সবদিক থেকে প্রস্তুতিও শুরু হয়। প্রথমে ঠিক ছিল সল্টলেকের গোর্খা ভবনে সাংবাদিক সম্মেলন করবেন বিমল গুরুং। এবং একেবারে শেষ মুহূর্তে সেখানে সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। সেই মতই সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয় সল্টলেকের গোর্খা ভবনে। কিন্তু গোর্খা ভবনের বাইরে থেকেই ফিরে যেতে হয় গুরুংকে।

চূড়ান্ত পর্ব এরপর ইএম বাইপাস হয়ে মা উড়লালপুল ধরে পাক স্টিট হয় ললিত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে গিয়ে ওঠেন বিমল গুরুং। যার পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই করা ছিল। সেখানে সাংবাদিক বৈঠকে বিমল গুরং ঘোষণা করলেন, ”প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কথা রাখেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কথা রাখেন। মমতাকেই ফের মুখ্যমন্ত্রীর আসনে দেখতে চান। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জোটে লড়াই করতে ইচ্ছুক। একইসঙ্গে কথা বা প্রতিশ্রুতি না রাখায় বিজেপিকে মোক্ষম জবাব দিতে চান। সেই বিজেপি, যে দলের প্রতিনিধিকে পরপর দু’বার পাহাড় থেকে লোকসভায় পাঠিয়ে ছিলেন তাঁরা।

যদিও তৃণমূলের নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগের কথা সরাসরি অস্বীকার করেছেন বিমল গুরুং। তাঁর দাবি, সরকার বা সরকারি শাসক দল বা তাদের কোনও প্রতিনিধির সঙ্গে কোনও বৈঠক হয়নি। তাঁরাই কথা বলার চেষ্টা করছেন। বার্তা দিতে চাইছেন তৃণমূলকে। বাকিটা তৃণমূলের ব্যাপার। তারা গুরুর প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা দেখাবেন, না-কি দূরত্ব বজায় রাখবেন!

আরও পড়ুন- চিকিৎসায় বিশেষ উন্নতি হয়নি সৌমিত্রের, বাড়ছে অস্থিরতাও

ফলে কোনটা ঠিক, কোনটা ঠিক নয় বা পাহাড়ের রাজনৈতিক সমীকরণ লজিক কোন পথে, সেটা জানার জন্য আরও কিছুটা অপেক্ষা করতেই হচ্ছে! তবে বিমল গুরুং-এর হঠাৎ এমন অবস্থানে একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে পাহাড়ের রাজনৈতিক সমীকরণ যে বদলাতে চলেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না! রাজনৈতিক মহলের মতে, আবার উত্তরবঙ্গে অন্তত ১২টি বিধানসভা আসনে প্রভাব ফেলতে পারেন “গোর্খাদের” আইকন বিমল গুরং। বাকিটা সময় বলবে। কারণ, এখনো পিকে ম্যাজিক অব্যাহত, বলছে সংশ্লিষ্ট মহল।

Previous articleচিকিৎসায় বিশেষ উন্নতি হয়নি সৌমিত্রের, বাড়ছে অস্থিরতাও
Next articleবেন্নুর বুকে নেমে নমুনা সংগ্রহ করল ‘ওসিরিক্স রেক্স’