বৈশাখী-ইস্যুতে বিজেপি এতখানি নতজানু কেন ? কণাদ দাশগুপ্তর কলম

 

কণাদ দাশগুপ্ত

দুনিয়ার ‘বৃহত্তম’ দল বলে দাবি করা দলটিই বর্তমানে দেশ শাসন করছে৷ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে৷ দেশের একাধিক রাজ্যও শাসন করছে দলটি৷ এই দলটিকে না’কি নিয়মিত বুদ্ধি-পরামর্শ দেয় আরএসএস৷ দলের শেষ কথা বলেন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, জে পি নাড্ডা৷

আর রাজ্যবাসী বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করে চলেছে, সেই বিজেপি’র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি ও কমিটির সর্বস্তরের পদাধিকারীদের নাকে দড়ি বেঁধে বারংবার তুলে আছাড় দিচ্ছেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একজন আপদমস্তক অ-রাজনৈতিক মহিলা৷ এ ধরনের ঘটনায় অপদস্থ, বিব্রত, বিড়ম্বিত হচ্ছেন বঙ্গ- বিজেপির নেতারা৷ একুশের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে জিতে যে দলটি বাংলার শাসক হওয়ার আশায় রয়েছে, সেই দলটির ভাবমূর্তি এই ইস্যুতে ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছে ধাপার মাঠে৷ কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না, যে বা যারা এখনও পর্যন্ত বিজেপির কোনও কাজেই লাগেননি, তাঁরাই প্রতি মুহুর্তে ওই দলকে বেইজ্জত করে চলেছে, আর বিজেপির নেতারা কেন তা হজম করে চলেছেন? বাইরে থেকে এই রহস্যভেদ করা অসম্ভব৷

তবে এর বাইরে একমাত্র ব্যতিক্রম রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ৷ বুধবার সকালে এক চা-চক্রে যোগ দিয়ে তিনি বলেছেন, “আমাদের সঙ্গে শোভনবাবুর সুর মিলছে না। যদি মেলে সমস্যা মিটে যাবে।”

দিলীপবাবু এ কথা বললেও রাজ্য বিজেপির বাকি ‘ডাকসাইটে’ নেতারা বোধহয় নিশ্চিত হয়েছেন, বৈশাখীকে দলে রাখতে পারলেই বিজেপি নবান্নে ঢুকে পড়বে৷ হয়তো সেই কারনেই ওই অ-রাজনৈতিক মহিলার সামনে বারবার নতজানু হচ্ছেন রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতারা৷ ‘ভয়ঙ্কর’ বিস্ময়কর যে এত কিছুর পরও ফের মঙ্গলবার রাতে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বাসভবনে গিয়ে বৈঠক করেন বিজেপির কলকাতা জোনের আহ্বায়ক দেবজিৎ সরকার৷ দেবজিৎ কথা বলে এলেও সেই সব কথা কতখানি শোভন মানবেন তা নির্ভর করছে বৈশাখীর উপর৷

দলের সম্ভ্রমের বারোটা বাজানোর যে ঘটনা গত সোমবার বৈশাখী ঘটিয়েছেন,তাতে কতখানি লাভবান হলো বিজেপি ? এত কিছুর পরেও দলের তৃণমূলস্তরের ‘ডেডিকেকেট’ কর্মী- সমর্থকরা রাজ্য নেতাদের এই নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ কতখানি সমর্থন করছেন? কোন নজরে দেখছেন ? বৈশাখীর ইমেজ এই বাংলার মাটিতে কত উঁচুতে রয়েছে, যে সেই ইমেজ ‘কাজে’ লাগাতে না পারলে গেরুয়া শিবিরের ভরাডুবি হবে ? দিলীপ ঘোষ, মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী, সৌমিত্র খান, লকেট চট্টোপাধ্যায়রা দাঁতে দাঁত চেপে রয়েছেন লড়াইয়ের ময়দানে৷ এনাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে রাজ্য বিজেপি ক্রমশই শক্তিশালী হচ্ছে৷ সেই সময় বারবার বৈশাখীর দেওয়া শর্তপূরণে কেন মরিয়া হচ্ছে রাজ্য বিজেপি ? ওই মহিলাকে নিয়ে বারবার চরম বিড়ম্বনায় পড়তে কেন ভালোবাসছে বঙ্গ-বিজেপি? সেদিনের কর্মসূচি এড়িয়ে যাওয়ার পর বিজেপির অন্দরে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে৷ দলীয় কার্যালয়ে কাগজে লেখা শোভন-বৈশাখীর নেমপ্লেট ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছে। বৈশাখীকে নিয়ে দলের অভ্যন্তরে যে শৃঙ্খলারক্ষার প্রশ্নও উঠে গিয়েছে, মুখ ফুটে বলতে না চাইলেও আজ হাড়ে হাড়ে বুঝছে বিজেপি৷ অজানা কারনে তবুও বঙ্গ-বিজেপি এখনও দর্শকের চেয়ারেই বসে আছেন৷

দলের ঘোষিত কর্মসূচিকে ধ্বংস করার পর বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় সাফাইও দিয়েছেন৷ সংবাদমাধ্যমে
বলেছেন, “আমার শরীর একেবারেই ভাল নেই। দীর্ঘ যাত্রা করে ভুবনেশ্বর থেকে ফেরার পর আমার ও শোভন, কারো শরীরই একেবারে ভাল নেই। মূলত, সেই কারণেই মিছিলে থাকতে পারিনি।” আরও বলেছেন, “আমি তাও শেষ একবার চেষ্টা করেছিলাম যদি আমার পায়ের ফোলা কমে যায়, তবে আমি যাব। কিন্তু আমি চলাফেরা করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। আমার শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে শোভনবাবুও আমায় ছেড়ে যেতে পারেননি। কারণ বাড়িতে বড় কেউ ছিল না। তাই শোভনও মিছিলে যেতে পারেননি।”

প্রশ্ন উঠছে, বিজেপিকে এবং বিজেপির শীর্ষ নেতাদের এভাবে ডোবানোর পর এই ছেলেভোলানো সাফাই কতদূর মানছে গেরুয়া শিবির ? দলে যোগ দেওয়া বা দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া নিয়ে বিস্তর নাটক ইতিমধ্যেই করেছেন বৈশাখী৷ সর্বশেষ ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ বলছে, এই বিতর্কে কান দিতে চান না বৈশাখী। তাঁর কথায়,‌ “বিতর্ক তৈরি করার চেষ্টা করেছে কেউ কেউ, তবে যাঁরা করেছেন তাঁরা বিজেপির মূল নেতৃত্বের কেউ নন।”
এখনও দলের সঙ্গে এক কদমও না-হাঁটা বৈশাখীর এ ধরনের বক্তব্য প্রমান করছে, তিনি দলীয় নেতা- কর্মীদের মধ্যে বিভাজনের কাজটা চালাতে চাইছেন৷ এবং বুঝেছেন, শীর্ষ নেতাদের ‘হাতে রাখতে’ পারলেই সব ঠিক থাকবে, দ্বিতীয় সারির নেতারা বা কর্মীরা আদৌ ফ্যাক্টর নন তাঁর কাছে৷ এর কারণ,
সেদিনের মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল শোভন-বৈশাখী জুটির। অথচ তাঁরাই গরহাজির। তবুও দল চুপ৷ এমন ঘটনার পর ‘শৃঙ্খলাবদ্ধ’ দল বলে চিৎকার করা বিজেপিতেও নানা প্রশ্ন উঠছে৷
বিজেপিতে যোগ দেওয়া শোভন-বৈশাখী প্রকাশ্য কোনও দলীয় কর্মসূচিতে আজও অংশ নেননি। স্বীকার করুক বা না-করুক, সোমবারের মিছিলে এরা অংশ না নেওয়ায় রাজ্যবাসীর কাছে দলের মুখ পুড়েছে৷ বঙ্গ বিজেপিতে অতীতে কখনও এমন ঘটনা ঘটেনি৷ অথচ এধরনের কাজ করা সত্ত্বেও দল এখনও এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে সমানে ‘তৈলমর্দন’ করে চলেছে৷ এর কারন কী ? এই প্রশ্নই আজ দলের নেতা, কর্মী, সমর্থকদের মুখে মুখে ঘুরছে৷ এ কেমন ‘শৃঙ্খলাবদ্ধ’ দল? অসমর্থিত সূত্রের খবর, বৈশাখীর আপত্তি শঙ্কুদেব পাণ্ডাকে তাঁর সঙ্গে একই পদ দেওয়ায়৷ শঙ্কুকে ওই পদ থেকে তাড়াতে চাইছেন বৈশাখী ৷ দলের অন্দরে প্রশ্ন উঠছে, শোভনের থেকে বহুগুণ বেশি জনভিত্তি থাকা শুভেন্দু অধিকারী যদি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর টানা দলীয় কর্মসূচিতে থাকতে পারেন, তাহলে কেন ব্যতিক্রমী নজরে দেখা হচ্ছে এদের ? এ কথা অবশ্য বৈশাখীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়৷ কারন, বৈশাখীর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার একেবারেই শূন্য৷

তবে, বঙ্গ-বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষের এ সংক্রান্ত মনোভাব দেখে কিছুটা খুশ দলের কর্মী- সমর্থকরা৷ দিলীপবাবু প্রকাশ্যেই বলেছেন, ” এ বিষয়ে সবকিছু খতিয়ে দেখা৷ শোকজ করা হবে কি’না, তাঁর দেখার জন্য শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটিও আছে।” আরও বলেছেন, “যাঁরা এই দলে কাজ করতে এসেছেন, তাঁদের মনস্থির করতে হবে। পার্টি সবাইকে কাজ দেওয়ার জন্য, জায়গা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছে, দিয়েছেও। দরজা খোলা আছে, তাঁরাই ঠিক করবেন তাঁরা কী করবেন।”

বৈশাখীদের অবস্থান নিয়ে দলের অন্দরে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তা এখনই ঠেকাতে না পারলে, আগামী নির্বাচনে বিজেপির যে সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, তা নিশ্চিতভাবেই ধাক্কা খাবে৷ তবে বঙ্গ- বিজেপিকে মাথায় রাখতে হবে, ‘শূন্য কলসির আওয়াজ সবসময়ই একটু বেশি হয়’৷

Previous articleকেন্দ্রের পদ ছাড়াও যায়, নাম না করে শুভেন্দুকে খোঁচা কুণালের
Next articleEVM-এর বদলে ব্যালট, মামলা শুনতেই রাজি নয় সুপ্রিম কোর্ট