সেলেবদের দেখে হতাশার বহিঃপ্রকাশ বন্ধ করুন

দুলাল দে

 

একদিন দিল্লির বাড়িতে প্রয়াত প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির সঙ্গে কথা হচ্ছিল।

শরদ পাওয়ার তখন ক্রিকেটের মসনদে বসবেন বসবেন করছেন। একথা সেকথা ঘুরে প্রিয়দা হঠাৎ বললেন, “শরদ পাওয়ার দেখবি (প্রিয়দা সাধারণত সবাইকেই ‘তুই’ সম্বোধনে অভ্যস্ত ছিলেন) বিসিসিআইটা দারুণ চালাবে।”

কিন্তু সবটাতেই কেন রজনীতিবিদরা? এবার প্রিয়দা-“শোন, এদেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা ছাড়া কিছু হয় না। এই ধর, ভারতীয় ফুটবল দল বিদেশে খেলতে যাবে। দ্রুত ভিসা করাতে হবে সবাইকে। বিশাল প্রভাবশালী শিল্পপতি অথবা রাজানীতির বাইরে থাকা কাউকে সভপতির পদে বসিয়ে দিয়ে দেখ না, ঠিক সময়ে ভিসার অভাবে ফুটবলাররা বিদেশে খেলতে যেতেই পারবে না। আমরা রাজনীতির লোক বলে দিল্লির অলিন্দে ব্যপারটা অনেক সহজে করে ফেলতে পারি। না হলে কেউ ফোনটাই তুলবে না।”

এই দেশের মানুষের চরিত্র সম্পর্কে প্রিয়দার থেকে ভাল মূল্যায়ন আর কে করবেন!

ধরুন, একজনকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। বাসুদেব মণ্ডল ভারতীয় দলের একদা অধিনায়ক ছিলেন। তিনি একটা চিঠি লিখে দিলেন। শুনবেন সুপার? এবার কোনও বিধায়ক চিঠি অথবা ফোন করে দিলেন। কী মনে হয় কাজ হবে?

এখন চলতি ট্রেন্ড হল, সেলেব আর রাজনীতিবিদ হলেই অ্যাটাক কর। ভোটে দাঁড়িয়েছ মানেই কিছু না কিছু ধান্দা রয়েছে। দেশের কাজে, দশের কাজে সাহায্য করার জন্য তো বাপু তুমি ভোটে দাঁড়াওনি। এটা হল মানুষের একদম বেসিক লেভেলের ভাবনা। আর এই ভাবনা থেকেই কত মানুষ ইচ্ছে করলেও ভোটে দাঁড়াতে না হলে রাজনীতিতে আসতে ভয় পান। আর যার সুযোগ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ছড়ি ঘোড়ান- পঞ্চু দা, জগাই দা রা। ইট, বালি, সিন্ডিকেট, প্রোমোটার থেকে টাক ঝাড়ের ঝাড়ের ফাঁক করে দিয়েছেন। কোথায়, আপনি কি তাঁর মোবাইল নম্বর বাজারে ছেড়ে দিয়ে একবারও দাব তুলেছেন, “জনগনের সেবা করার নাম করে বছর ভর পঞ্চু দা তোলা তুলে মালে মালাক্কার হয়ে গিয়েছে। দে বাজারে ছেড়ে এদের মোবাইল নম্র। সবাই মিলে এদের ফোন কর। সাহায্য চেয়ে ফোন কর।” শুনেছেন কখনও এরকম হয়েছে? কিন্তু সে যদি অন্য পেশায় কোনও বিখ্যাত লোক হন, তাহলেই গেল গেল রব। দে ছেড়ে সবার মোবাইল নম্বর।

বিভিন্ন মনোবিদ এবং রাজনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝলাম, এটা যাঁরা এটা করেন, এটা এক ধরণের মানসিক হতাশা থেকেই করেন। ও পেরেছে। আমি পারিনি। অতএব দে ব্যাটাকে একটু ভোগান্তি। আরবানার উপরে থেকে মানুষের সেবা!

নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই দেখেছি। জীবনের প্রথম জিনসটা মুদিয়ালির ফুটপাতের মড়া সাহেবের বাজার থেকে কিনে যখন পড়েছি, কেউ একবারও খোঁজ নিয়ে দেখেননি, রোজ ইউনিভার্সিটি পড়তে যাওয়ার বাস ভাড়াটা আছে তো? আজ পড়াশোনা করে, পরিশ্রম করে যদি “গ্যাস” থেকে নিজের টাকায় জিনস কিনে পড়ি, দেখবেন ব্র্যান্ড নিয়ে কত বাঁকা প্রশ্ন আসবে।

Advt

ভাই, রাজ, রুদ্র, কাঞ্চন অথবা শচীন এরা কেউই একদিনে সেলেব হননি। কোথায় ছিলেন আপনি, যখন রাজ আর রুদ্র একটা ছোট ভাড়া ঘরে দিন কাটাতেন! কাঞ্চন যখন রাস্তায় ফেরি করতেন, তখন কোথায় ছিলেন আপনি! তখন তো সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দেননি। আজ নিজেদের পরিশ্রমে যখন সেলেব হয়েছেন , তখনই আপনার রাগ গিয়ে পড়েছে ওদের উপর!

ফেসবুক পূর্ববর্তী সমাজে আমাদের রাগ, হতাশা, বঞ্চনার প্রতিনিধি হয়ে সিনেমার পর্দায় যাবতীয় লড়াই করতেন অমিতাভ বচ্চন। সৎ পুলিশ অফিসার হয়ে যখন অসাধু ব্যবসায়ীদের দমন করতেন, হাততালিতে ফেটে পড়ত গোটা হল। অমিতাভ বচ্চনই ছিলেন আমাদের মতো জীবনে ব্যর্থ মানুষের একমাত্র প্রতিনিধি। আর সেই থেকেই ট্রেন্ড সেট হয়ে গেল, ধনী ব্যবসায়ী অথবা সমাজের উচ্চস্তরে থাকা মানুষ মানেই বোধহয় অসাধু। কিন্তু সমাজের উচ্চস্তরে পৌঁছনোর আগে সেই মানুষটির কী অমানুষিক পরিশ্রম আর মেধার কথা একবারটি ভাবুন। কেউ শর্টকাট রাস্তা দিয়ে টালিগঞ্জের ছোট ঘর থেকে আরবানাতে পৌঁছোননি। শুধু রাজ নয়। আমি সব সেলেবদের (কতজন সেলেব, তা নিয়ে যদিও আমার সন্দেহ আছে) কথাই বলছি।

ইদানীং এটা খুব চলছে। দেখতে চাই, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে কোন দল জিতে এসে আমাদের কত টাকা দেবে। মানে কেউ যদি বলে, জেতার পর সবার অ্যাকাউন্টে মাসে ১০০০ করে টাকা দেওয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে অন্য দল বলবে ২০০০ করে দেব। আমরাও আনন্দে মশগুল। বিনা পরিশ্রমে মাসে মাসে অ্যকাউন্টে টাকা ঢুকবে। কখনও কি আমরা দাবি তুলেছি, আমরা ভিক্ষা চাই না। বরং কাজের সুযোগ হোক। যেখানে আমরা পরিশ্রম করে ২০০০ নয়। ২০০০০ রোজগার করব। আমরা আশায় বসে থাকি, আবার তা নিয়ে ঝগরাও করি, কখন অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা আসবে। কোনও ভদ্র দেশে সম্ভব! কাজ করব না, বসে থাকব। আর আমার অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা চলে আসবে!

সেলেব তখন নিশ্চয়ই অনেক টাকা। আমার কিছু নেই। সেলেবের আছে। যেন বিনা পরিশ্রমে লটারি থেকে পেয়েছে। ফেসবুকে সেলেবদের যে আক্রমণ গুলো হয় দেখবেন, তার বেশির ভাগই লেখা থাকে-“গরীবদের টাকা দিতে পারছেন না?” মানে এতদিন যা রোজগার করেছেন, ব্যাঙ্ক থেকে তুলে এনে বিলিয়ে দিতে থাকুন। নাহলে ভোটে দাঁড়াবেন না।”

কোথায় পাড়ার পঞ্চুদাকে একবারও বলেছেন এমন কথা? যাঁর পুরোটাই অন্যকে ফাঁকি দিয়ে রোজগার? না কি, তাঁর মাসল ম্যানের ভযে তখন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ঘরের কোনায় লুকিয়ে থাকেন?

কিছুদিন আগে শচীন ১ কোটি টাকা দান করলেন। ব্যাস শুরু হয়ে গেল, মাত্র ১ কোটি! তারপর এমন সব মন্তব্য এল, যেন শচীনের ব্যাঙ্ক ডিটেইলস তাঁদের কাছেই আছে। মাসে কত রোজগার থেকে কত খরচ সব জানেন। তাই ১ কোটি নয়। মাসে ৪ কোটি দেওয়া উচিত ছিল। আর তারপরেই সেই মোক্ষম প্রশ্ন। আচ্ছা শচীন তো দিল। তাহলে দাদা কত দিল? আরে মশাই, নিজে পকেট থেকে ১০ টাকা দিয়েছেন না কি, পুরোটাই ফেসবুকে বিপ্লব?

এবার থেকে পাড়ায় চোর ধরা পড়লে কি শহরের পুলিশ কমিশনারের নম্বর ছড়িয়ে দিয়ে বলবেন, পুলিশ কমিশনারকে ফোন করে এখনই জিজ্ঞাসা করা হোক। না কি, স্থানীয় থানায় যোগাযোগ করবেন? পাড়ার নর্দমায় জল জমলে কি, মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধান মন্ত্রীকে ফোন করেন না ওয়ার্ড প্রতিনিধি অথবা কর্পোরেশন অফিসে যোগাযোগ করেন?

ভাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে সব সময় ডিএমকেই স্পটে যেতে হয় না। ধাপে ধাপে কাজের বিন্যাস থাকে। আপনার কি চাই, কাজের সুষ্ঠ সমাধান না, যিনি ভোটে দাঁড়িয়েছেন, তাঁকেই সবাই মিলে ফোনে উত্যক্ত করে দাবি জানাতে হবে, যেখানে যা হবে, সেখানেই ছুটতে হবে। সকাল থেকে রাত শুধু ছুটতে হবে। কারণ, তিনি পাড়ার পঞ্চুদাদের মৌরসিপাট্টা সরিয়ে সেলেব হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছেন। ব্যক্তিটি একটি দলের প্রতিনিধিমাত্র। দেখতে হবে, তাঁর দল কাজ করছে কি না। তিনি তো সামান্য প্রতিনিধিমাত্র। দক্ষ নেতা, ঘরে বসেও পুরো কাজটা পরিচালনা করতে পারেন। যিনি ভোটে দাঁড়িয়েছেন, তিনি তাঁর সুদক্ষ পরিচালনাতেও সমস্যাটা সমাধান করতে পারেন। কিন্তু আপনার তো রাগের কারণ, আরবানা আর সেলেব তকমা।

কিন্তু এই যে ফোন নম্বর ছড়িয়ে দেওয়ার ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে উঠেছেন, আপনার সারা জীবনের হতাশার বহিঃপ্রকাশ নয় তো!

Previous articleএক্সিট পোলের থেকেও বেশি আসন কেন পাবে তৃণমূল ! কণাদ দাশগুপ্তর কলম
Next articleসহ্যের সীমা ছাড়াচ্ছে, দ্রুত অক্সিজেনের ব্যবস্থা করুন: কেন্দ্রকে তোপ দিল্লি হাইকোর্টের