ঠান্ডাঘরে বসে যাই বলুন, শ্রমজীবী ক্যান্টিন চলবে

সুদীপ সেনগুপ্ত

Jadavpur Sramajibi Canteen এর ৪০০ দিন পূর্ণ হলো আজ…

আপনারা সকলেই জানেন গতবছর লকডাউনের সময় শুরু হয় আমাদের যাদবপুর রান্নাঘর…

প্রথমে বিজয়গড়…
তারপর শ্রীকলোনী…
তারপর বাপুজিনগর…
তারপর নাকতলা অরবিন্দনগর…

দীর্ঘদিন ধরে এই চারটি রান্নাঘরে খাবার তৈরি করে আমাদের কমরেডরা ভ্যানে চাপিয়ে ৯৬, ৯৯ ও ১০০ নং ওয়ার্ডের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে খাবার ডিস্ট্রিবিউট করেছিলো সম্পূর্ণ বিনামূল্যে…
প্রতিদিন প্রায় ১৫০০ জন মানুষের কাছে দুপুরের ভাত পৌঁছে দিতেন কমরেডরা…

হাজার হাজার মানুষ যুক্ত হলেন আমাদের সাথে…
আর্থিক ভাবে সহযোগিতা করলেন অনেকে…
অনেকে চাল-ডাল-তেল-সোয়াবিন পৌঁছে দিয়ে গেলেন…
অনেকে এগিয়ে এসেছিলেন স্বেচ্ছাশ্রম দিতে…

তারপর…
এই রান্নাঘর গুলোর উন্নত রূপ হিসেবে শুরু হয় আমাদের জ্যোতিদেবী শ্রমজীবী ক্যান্টিন…

এক পা, দু পা করে আজ ৪০০ টি দিন পার করলাম আমরা…
চেষ্টা করেছি প্রতিদিনের রোজনামচায় আমাদের খবর পৌঁছে দিতে আপনাদের কাছে…
আপনারা না থাকলে তো আমরা এতদূর আসতেই পারতাম না…

এই এতগুলো দিন…
কয়েকশো পরিবারের সাথে আমাদের যোগাযোগ তৈরি হওয়া…
সকলের বাড়ীর বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ হিসেবে আমাদের শ্রমজীবী ক্যান্টিন কে বেছে নেওয়া…
ভালোবাসায় ঋদ্ধ হয়েছি প্রতিদিন…
দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাড়িয়ে দেওয়া হাত গুলোর পরশ…
তাদের বার্তা…
আমাদের সমৃদ্ধ করেছে সবদিক দিয়েই…

আজ নির্বাচনের ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর ফেসবুক জুড়ে কিছু স্বঘোষিত বামপন্থী কর্মী শ্রমজীবী ক্যান্টিনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন…
‘বন্ধ করে দেওয়া হোক এই সব ক্যান্টিন’ বলে নিদান জারি করেছেন কেউ কেউ…

কি জানি!…
আমরা ভাবিনি…
ওনারা বোধহয় ভেবেছিলেন একমাত্র ক্যান্টিন, রেড ভলান্টিয়ার এর উদাহরণ টেনে নির্বাচনের কঠিন বৈতরণী কমিউনিস্ট পার্টি পার করতে চাইছে…
আজ তাই কোনপ্রকার পর্যালোচনার আগেই তাদের সব রাগ-ক্রোধ-ঘৃণা বর্ষিত হচ্ছে নানান সুললিত ভাষায় আমাদের উদ্দেশ্যে…

কি আর বলি বলুন তো!…
শুধুমাত্র দুটো তিনটে কথা…

১/ আমাদের কাছে শ্রমজীবী ক্যান্টিন বা শ্রমজীবী বাজার নিছক একটি সমাজসেবা মূলক কর্মসূচি নয়…
উঠতে বসতে মার্কস-লেনিন কপচানো বন্ধুরা জানেন বোধহয় সমাজতান্ত্রিক উত্তর সোভিয়েটে কমিউনিটি কিচেন চালু হয়েছিলো মূলত দুইটি কারণে..

* মহিলাদের গৃহদাসত্ব থেকে মুক্তি।
‘অর্ধেক আকাশ’ যেন সত্যি সত্যিই দাসত্বের আগল চূর্ণ করে সমাজ গঠনের কাজে পুরুষদের সাথে একইযোগে হাত মেলাতে পারেন।

তাই কেবলমাত্র যৌথ রান্নাঘর নয়, কাপড় কাচা-বাসন মাজার মতো ক্ষেত্র গুলোতেও যৌথ উদ্যোগ, বাচ্চাদের খেয়াল রাখবার জন্য ক্রেশ ইত্যাদি শুরু হয়েছিলো সেইদিন…

# আর একমাত্র যৌথ রান্নাঘর হলেই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে পুষ্টিকর খাবার অনেক কম খরচে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়…

দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টি সেকারণেই যৌথ রান্নাঘরের আন্দোলনে নিজেদের যুক্ত রেখেছে…

২/ আমাদের শ্লোগান
‘কেউ খাবে, কেউ খাবেনা
তা হবে না, তা হবে না’
এই সমাজের বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা ছাড়া আর কিছু নয়…

আমাদের সমাজবিপ্লবের স্বপ্নের কথা আমরা সোচ্চারে বলেছি
‘স্বপ্ন আমার
প্রতিটি পাড়ায়
প্রতিটি গ্রামে
যৌথ খামার’ শ্লোগানে…

আমাদের কাছে এই শ্রমজীবী ক্যান্টিন এক দিকে আমাদের শ্রেণীমিত্রদের সাথে দৈনন্দিন যোগাযোগের এক প্ল্যাটফর্ম…
এই দুর্যোগের দিনে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে, তাদের বাঁচিয়ে রাখবার এক ক্ষুদ্র প্রয়াস…
অন্যদিকে এই সমাজব্যবস্থায় সরকারি অকর্মণ্যতা, দুর্নীতি, বড়লোকদের স্বার্থবাহী নীতিগুলোর বিরুদ্ধে প্রচারের এক ছোট্ট হাতিয়ার…

এক দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক কর্মসূচি…

রাতারাতি ভোটের বাক্সে রিফ্লেক্সন না দেখে ক্ষুব্ধ উপদেশদানকারী বন্ধুদের কথা সেকারণেই আমরা ইগনোর না করে পারছি না…

সেই সমস্ত ‘বন্ধুদের’ জানানোর জন্য আর দু-তিনটি তথ্য-

১/ এই মুহুর্তে আমাদের রাজ্যে কেবলমাত্র চারটি শ্রমজীবী ক্যান্টিন চলছে-
* যাদবপুর জ্যোতিদেবী শ্রমজীবী ক্যান্টিন, আজ ৪০০ দিনে
* Priyonath Manna Bastee Community Kitchen, ২৬৬ দিনে
* ঝাড়গ্রাম শ্রমজীবী ক্যান্টিন, ২১০ দিনে…

আর একটি শ্রমজীবী ক্যান্টিন চলছে সল্টলেকে (বিধাননগরে),
*শ্রমজীবী ক্যান্টিন – বিধাননগর

প্রতিদিন কি পরিমাণ নিত্যনতুন আঘাত ঘরের ভেতর বা বাইরের থেকে এই কমরেডদের যে সহ্য করতে হয়…
যে বা যারা তার খবর রাখেন না, তার মর্ম বুঝবেন কি করে…

নির্বাচনের বিপর্যয়ের পর শীততাপনিয়ন্ত্রিত স্টুডিও বা ঘরে বসে নানান নিদান দেওয়া সহজ…
কিন্তু নিঃশব্দ রক্তপাত সহ্য করে পরদিন থেকেই আবার রাস্তায় নেমে আসা…
হ্যাঁ…
এই ছেলেমেয়েরাই পারে…
আপনারা ফেসবুক জুড়ে রম্যরচনা লিখে যান…
ওদের কাজ করতে দিন…

২/ এই বিপর্যয়ের মধ্যেও যাদবপুরের ৯৬ ও ৯৯ নং ওয়ার্ডে ৩০% এর বেশি ভোট আমরা পেয়েছি…
আমরা জিততে পারিনি…
ব্যথিত শুধু নই লজ্জিত…
কারণ অনুসন্ধান করতে হবে…
ভয়ঙ্কর প্লাবনের সময় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মজবুত ভিতের বাড়িও নিজেকে রক্ষা করতে পারে না…
সে যাই হোক, ঘুরে দাঁড়াবার সংগ্রামে সকলের সাথে আমরাও রাস্তাতেই থাকব..
শুধুমাত্র এই সময় আমাদের সমালোচনা করবার সময় আপনারা প্লিজ আপনাদের নিজস্ব শ্রমজীবী ক্যান্টিন বা রেড ভলান্টিয়ার বিহীন বুথে কতটা ভোট পেলেন একবার দেখে নেবেন…
ওপরের দিকে বা অন্যের দিকে কাদা ছোঁড়ার আগে আসুন না আমরা সবাই একবার আয়নার মুখোমুখি দাঁড়াই…

৩/ যদিও এই তথ্য এখানে দেওয়ার নয়, তা সত্বেও বলে যাই আমাদের কলকাতা জেলায় যাদবপুর এরিয়া কমিটি বা দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার পূর্ব যাদবপুর ও মধ্য যাদবপুর শুধুমাত্র ‘ক্যান্টিন’ করিনা…
গণশক্তি বিক্রি, সংগ্রামী তহবিল বা লেভি সংগ্রহ, পার্টি বা গণসংগঠনগুলোর দৈনন্দিন রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মসূচি পালন, কমরেডদের উপস্থিতি জেলার মধ্যে একেবারেই প্রথমসারিতে…
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রথম স্থানে…

আসলে যে রাঁধে,
সে চুলও বাঁধে,
আর যে কিছুই করেনা
বসে বসে কাঁদে…

আর ইদানিং কালে তোড়ে
ফেসবুকে কাদা ছোড়ে!…

৪/ আমাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে শ্রমজীবী ক্যান্টিনের নাম গন্ধও ছিলো না…
লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়ই…
নেতারা বা আপনারাও বক্তৃতার সময় জানি একে অগ্রাহ্য করতে পারেন নি…
কিন্তু ইস্তেহারে না থাকা দুইটি শব্দ কে আমাদের বিপর্যয়ের মূল কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে লজ্জা লাগছে না…
পার্টির ঘোষিত দাবী-ব্যাখ্যা-আগামী কর্মসূচি সম্পর্কে কিছুই জানেন না, নাকি জেনেও উল্লেখ করতে চান না…
৫/ কেরালায় এই মুহুর্তে ১০০০ টি কমিউনিটি কিচেন চলছে…
এই মুহুর্তে সেই সব ক্যান্টিন থেকেই সমস্ত পরিবার ও ‘অতিথি শ্রমজীবী মানুষদের’ বিনামূল্যে খাবার সরবরাহের কথা ঘোষণা করেছে সরকার…

যারা বলছেন ‘সরকার উদ্যোগ নিলে আপত্তি নেই, পার্টি কেন এই সমস্ত কাজে শ্রম, সময়, অর্থ খরচ করবে’…
তাদের বলি, দয়াকরে কেরালার বুকে Community kitchen শুরুর ইতিহাস টা জেনে নেবেন…

আর এই সমাজে দাঁড়িয়ে কেবলমাত্র ‘রাষ্ট্র বিরোধী বৈপ্লবিক কর্মসূচি’ পালনই আমাদের একমাত্র কাজ হওয়া উচিৎ বলে রচনা লেখবার আগে পার্টি কর্মসূচি টা একটু পড়ে নেবেন…
তার জন্য আপনাকে আমাদের পার্টি সদস্য হতে হবে না, এইটি কোন গোপন দলিল নয়..

আরও পড়ুন- নারদে ববিদের চার্জশিটে সায়, টুইটে ঢাক পেটালেন ধনকড়

আরো অনেক কিছু বলবার আছে…
আসলে এই ৪০০ দিনের দিন, এই সমস্ত লেখা পড়ে অনেকে বিরক্ত হবেন, বিশেষত আমাদের ভালোবাসার জনেরা…

রাগ করবেন না…
আসলে ওই যে কবি বলেছিলেন না

বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে,
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে,
রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসেনাক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে !
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে !….

যাই হোক,
ভালো থাকবেন…
সুস্থ থাকবার চেষ্টা করবেন…
আগামীকাল ৪০১ তম দিনে বা তারপরও ক্যান্টিন থাকবে…
আজকের মতোই পাশে থাকবেন!…

আরও পড়ুন- মন্ত্রিসভায় নতুনরা: অধিকারীগড়ে মন্ত্রী এবার অখিল, তালিকায় হুমায়ুন থেকে বীরবাহা

Advt

Previous articleনারদে ববিদের চার্জশিটে সায়, টুইটে ঢাক পেটালেন ধনকড়
Next articleআপাতত বিদেশ যেতে পারছেন না খালেদা জিয়া; রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় পরিবার