একটা কলমের জন্য আদালতের সমন পাবেন, ভাবেননি রবীন্দ্রনাথ

থানার বড়বাবু চোরের থেকে উদ্ধার হওয়া কলমটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখালে
গুরুদেব শিশুসুলভ উচ্ছ্বাসে প্রগলভ হয়ে বলেছিলেন এই তো আমার কলম,
এই কলমে আমি লিখি,
ক’দিন হল হারিয়েছে,কোথায় পেলেন?
কে নিয়েছিল?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুশি হয়েছিলেন কলমটা উদ্ধার হয়েছে সেটা ফেরত পাবেন,দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন নি এই কলমের জন্য আদালতের সমন আসবে তাঁর কাছে৷

জোড়াসাঁকো থানার বড়বাবুর গাড়ি এলাকায় চক্কর দিচ্ছে,গাড়ির মধ্যে বসে আছেন বড়বাবু,সঙ্গে সেই চোর৷

দিনগুলি দিব্যি কেটে যাচ্ছিল বেশ, রাতটা যখন একটু গভীর হত,বাড়ির মানুষগুলো গভীর ঘুমের দেশে তখন দিব্যি সিঁদ কেটে চুরির আসল কাজটা সেরে ফেলত নিপুন দক্ষতায়,তারপর ভরদুপুরে সুযোগ বুঝে বাড়িগুলি থেকে জিনিসপত্র হাতিয়ে নেওয়া৷

Advt

তবে ওই যে কথায় আছে চোরের সাতদিন আর গৃহস্থের একদিন, শেষপর্যন্ত অবশ্য পুলিশের হাতে ধরা পড়তেই হল৷চোরের থেকে উদ্ধার হওয়া গয়না,বাসনকোসন থেকে কলম,দোয়াত,ঘড়ি সব তখন থানার টেবিলে ছড়ানো৷
আর একপ্রস্থ জেরা করে চোরকে সঙ্গে নিয়েই বড়বাবুর গাড়ি ছুটল৷প্রথমে কলুটোলা,তারপর ফলপট্টি কোন বাড়ি থেকে কি জিনিস চুরি হয়েছে বড়বাবুকে কাঁচুমাচু মুখে দেখিয়ে দিচ্ছে চোর৷হুজুর আর একটু এগিয়ে….
কতটা…
এই তো এই বাড়িটা হুজুর৷
বাড়ি দেখে বজ্রাহত বড়বাবু৷
কলমটা এখান থেকে চুরি করেছিলাম একদিন দুপুরবেলায়৷
আর বাড়ি পেলি না,হতভাগা তোর এই বাড়িতেই নজর পড়ল৷
যিনি বাড়ির বাসিন্দা তিনি তখন বারান্দায় পায়চারি করছেন,জোড়াসাঁকো থানার বড়বাবু দেখা করতে চেয়েছেন বলে নিজেই নীচে নেমে এলেন৷
থানার বড় বাবু বললেন গুরুদেব আপনাকে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী৷
চোরের থেকে উদ্ধার হওয়া কলমটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখালেন বড়বাবু৷
গুরুদেব শিশুসুলভ উচ্ছ্বাসে প্রগলভ হয়ে ওঠেন, বললেন এই তো আমার কলম,এই কলমে আমি লিখি,ক’দিন হল হারিয়েছে,কোথায় পেলেন?কে নিয়েছিল?

তাঁর কলম কবে ফেরত পাবেন কবিগুরুর এই প্রশ্নে থানার বড়বাবু বললেন আপাতত তিনি কলম ফেরত দিতে অপারগ,কারন কলম নিয়ে মামলা-মকদ্দমা হবে,সেটা শেষ হলেই তিনি কলম পাবেন৷

আইনের ব্যাখ্যাও শুনতে হল কবিগুরুকে,বড়বাবু বললেন কলমটি ‘ recovered’ সম্পত্তি৷আগে শনাক্ত হবে,তারপর বিচারকের লিখিত নির্দেশে কলম ফেরানো হবে৷

গুরুদেব অবশ্য অত আইনি মারপ্যাঁচ নিয়ে ভাবতে রাজি নন,বরং তিনি খুশি কলমটা উদ্ধার হয়েছে সেটা ফেরত পাবেন৷

কিন্তু আরও বড় বিপদ যে ছিল ঘাপটি মেরে কিভাবে বুঝবেন গুরুদেব!

দিন কয়েক পরে হঠাৎ জোড়াসাঁকো থানার জমাদার ঠাকুরবাড়িতে এসে স্বয়ং রবীন্দ্রমাথের হাতে ধরিয়ে দিলেন আদালতের সমন৷

এবার সত্যিই বিচলিত হলেন কবিগুরু,একটা কলমের জন্য আদালতের সমন পাবেন তিনি যে আশা করেন নি৷
বিষন্ন চিত্তে গোপালকে বললেন সে যেন এক্ষুনি কাছারিতে গিয়ে সৌরীনের সঙ্গে যোগাযোগ করে৷

সৌরীন অর্থাৎ সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়,যিনি ব্রিটিশের চাকরি করতে চাননি বরং চেয়েছিলেন সাহিত্যসাধনায় জীবনটা কাটিয়ে দেবেন,শেষপর্যন্ত কবিগুরু বোঝানোয় তিনি ওকালতিকে পেশা করেন৷

গোপালকে মাঝদুপুরে কোর্টে দেখে অবাক হবার পালা সৌরীন্দ্রর,
আপনার কাছে এসেছি কবির বড় বিপদ৷

গোপালকে বলেই পাঠিয়েছিলেন গুরুদেব এই তলব বন্ধ করতে হবে,না হলে বিশ্বকবি যে হার্টফেল করে মরে যাবেন৷সঙ্গে গোপালকে এটাও বলেছিলেন সৌরীন যদি এই তলব বন্ধ না করতে পারে তা হলে সে যেন খাট কিনে দলবল নিয়ে এই বাড়িতে আসে৷

সৌরীন্দ্র আর একটি সেকেন্ড অপেক্ষা না করে ছুটলেন ম্যাজিষ্ট্রেটের ঘরে,শোনালেন তাঁকে সমনের আসল গল্প৷

সব শুনে আনিস সাহেব তখন বাকহারা,তিনি নিজে সাহিত্যরসিক,অকৃত্রিম রবীন্দ্রভক্ত৷
এবার কোর্ট ইনস্পেকটর শরৎকুমার ঘোষের ডাক পড়ল৷
সমনটি আনিস সাহেব প্রায় ছুঁড়েই মারলেন শরৎবাবুর দিকে,বললেন তুচ্ছ চুরির মামলায় সাক্ষী দিতে রবীন্দ্রনাথকে তলব করেছেন পুলিশ কোর্টে,তাঁর কতটা অপমান হয়েছে সে ধারনা আপনাদের আছে৷

শরৎবাবু অবশ্য বলার চেষ্টা করলেন এই বিষয়ে তাঁর কোনও দোষ নেই,কারন রবীন্দ্রনাথ নিজে কলম শনাক্ত করেছেন সেকথা অফিসারের রিপোর্টে আছে৷এসব শুনে আরও রেগে গেলেন আনিস সাহেব,বললেন অত আইন দেখাবেন না,আমি আপনার থেকে কম আইন জানি না,আইন মানুষের জন্য৷

সৌরীন্দ্রবাবু,যে ভদ্রলোক ঠাকুরবাড়ি থেকে এসেছেন সমন নিয়ে তিনি নিশ্চয়ই এই কলমটি অনেকবার দেখেছেন,দেখলেই চিনতে পারবেন নিশ্চয়ই বললেন আনিস সাহেব৷

সৌরীন্দ্রমোহন সন্মতিসূচক ঘাড় নাড়তেই আনিস সাহেব নির্দেশ জারি করলেন সাথেসাথেই গুরুদেবের নামে যে সমন জারি হয়েছিল সেটি আমি বাতিল করলাম৷

রবীন্দ্রনাথ যাঁকে পাঠিয়েছেন তাঁর নামে সমন জারি করার নির্দেশ দিয়ে তিনি বললেন তিনিই আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে কলম শনাক্ত করবেন৷

আদালতের কাজের পর সৌরীন্দ্রমোহন রবীন্দ্রনাথকে রিপোর্ট দিলে তিনি হেসে বললেন তোমার জন্য রবিঠাকুর আজ অকালমৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলো৷

রবি ঠাকুর সাক্ষীর কাঠগড়ায় এই দৃশ্য নিশ্চিতভাবে ভারী বিড়ম্বনার হত আবালবৃদ্ধ বনিতার কাছে,সে যাত্রায় সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় তৎপর হয়েছিলেন বলেই রবি ঠাকুর সাক্ষীর কাঠগড়ায় এই বিড়ম্বনার দৃশ্য দেশের মানুষকে দেখতে হয়নি৷হ্যাঁ সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের আর একটি পরিচয় আছে তিনি কিংবদন্তি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্রের পিতা৷

তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা-অচেনা লালবাজার
সুপ্রতিম সরকার৷

Previous articleকবিগুরুর ১৬০তম জন্মজয়ন্তী পালিত হলো বাংলাদেশে
Next articleশিশিরকে তুলোধনা তৃণমূলের, স্পিকারের কাছে যাচ্ছে চিঠিও