আমার তিন মনে রাখার মত পঁচিশে বৈশাখ: কুণাল ঘোষের কলম

 

কুণাল ঘোষ

রবীন্দ্রজয়ন্তী মানেই প্রাণ ভরানো, তৃষা হরানো দিন। অন্যরকম অনুভূতি। বছর বছর নানা অনুভূতি, অভিজ্ঞতায় ভরা কর্মসূচি। কখনও আয়োজক, কখনও দর্শক, একনিষ্ঠ শ্রোতা। মনে রাখার মত অনেক কিছু।
আজ তার মধ্যে থেকে তিনটি পঁচিশে বৈশাখকে একটু বেশি করে মনে পড়ছে। একটু লিখতেও ইচ্ছে করছে। হলেই বা স্মৃতিরোমন্থনের পুনরাবৃত্তি, ভালো অন্যরকম স্মৃতি বেঁচে থাকুক।

প্রথম : ভোরের রবীন্দ্রসদনে লিটল ম্যাগাজিন হাতে…..

সেই 1983- রবীন্দ্রজয়ন্তীর সকাল। তখন সরকারের মূল অনুষ্ঠান হত রবীন্দ্রসদনের উল্টোদিকের চত্বরে, সকালে। পরের পর শিল্পীর গান। আর তার মধ্যে একটি নতুন কাজে হাতেখড়ি। সেটি হল হাতে করে লিটল ম্যাগাজিন বিক্রি। আমাদের স্কুলের বাংলার শিক্ষক এখন প্রয়াত সুদীপ্ত চক্রবর্তী এবং আরও কয়েকজন সাহিত্যপ্রেমী শিক্ষক, যেমন অঙ্কের অরবিন্দ চক্রবর্তী, ইতিহাসের শঙ্কর দত্তরায় প্রমুখ একটি ছোট্ট সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশ করতেন -“পদ্যবন্ধ”। আমাদের ক’জনের দায়িত্ব পড়ল রবীন্দ্রজয়ন্তীর সকালে পদ্যবন্ধর বিশেষ সংখ্যাটি বিক্রির। মহা উৎসাহ। প্রশান্ত, আমি, সম্ভবত অরুণাশিস, অকালপ্রয়াত অনির্বাণ, আরও দুএকজন বন্ধু সাতসকাল থেকে উৎসবপ্রাঙ্গনে ব্যস্ত। একদিকে ওই সঙ্গীতমুখর পরিবেশ, যে রবীন্দ্রগানের সঙ্গে ছেলেবেলা থেকে আমার পরিচয় করিয়েছিলেন ঠাকুমা ; অন্যদিকে, সেই প্রথম ঘুরে ঘুরে লিটল ম্যাগাজিন বিক্রি। দেখার অনুরোধ, কেউ হাতে নিয়ে দেখলে উৎসাহ। কিনলে তো উল্লাস। আবার পাত্তা না পেলে কষ্ট। এই রবীন্দ্রজয়ন্তী ভোলা যায় না। রবীন্দ্রউৎসবের সঙ্গে সেই প্রথম গানের গন্ডি টপকে আরও গভীরভাবে মনেপ্রাণে যুক্ত হয়ে যাওয়া।

দ্বিতীয়: কবিগুরুর বিলেতবাড়িতে

অনেকবছর পর, 2010.
রবীন্দ্রসার্ধশতবর্ষ উৎসব পালন শুরুর আগে।
মার্চ মাসে লন্ডন গেছি, হ্যারো আর্ট সেন্টারে একটি বাংলা সংস্কৃতির উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে। জমজমাট অনুষ্ঠান। মনে হল যেন রবীন্দ্রউৎসব পালন প্রায় শুরুই হয়ে গেল।
তখনও ভাবিনি সামনে আসছে আরও দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা।
বর্ষীয়ান রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় আর আমি ছিলাম রুমমেট। সেই সান্নিধ্যই অপূর্ব অভিজ্ঞতা। বর্ণময় জ্ঞানভান্ডার। কথায় কথায় রবীন্দ্রজীবন। এই লন্ডনেই কবিগুরুর উপস্থিতি। এমনকি, নোবেলপ্রাপ্তির গীতাঞ্জলীর সঙ্গেও জড়িত লন্ডন।
রবি ঠাকুরের বিলেতবাড়িতে গেলে হয় না???
কথায় কথায় প্রসঙ্গ উঠতেই দুজনই একমত। যাওয়া যাক বিলেতবাড়িতে।
উৎসব সমাপ্তিতে পরদিন সবাই নানা আলাদা কর্মসূচিতে। রঞ্জনদা আর আমি চললাম হ্যাম্পস্টেড হিথ, রবীন্দ্রনাথের বাড়ি খুঁজতে।
নির্দিষ্ট ঠিকানা জানা নেই। শুধু এলাকা। ট্যাক্সিচালক সম্ভবত প্রবাসী আফগান। তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যাপারটা বোঝানোই অসম্ভব।
যাই হোক, ক্রমশঃ পৌঁছন গেল মূল শহর থেকে দূরে শহরতলীর সবুজমোড়া পাহাড়ি হ্যাম্পস্টেডে। অপূর্ব এক পরিবেশ। একে ওকে জিজ্ঞাসা করতে করতে পাওয়া গেল সাহিত্যের ঈশ্বরের বিলেতবাড়ি। এ এক আবিষ্কারের রোমাঞ্চ। তীর্থক্ষেত্র স্পর্শের অনুভূতি।
“ইন্ডিয়ান পোয়েট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্টেড হিয়ার ইন 1912.” বাড়িটি সরকারি অধিগৃহীত না হলেও, ব্যক্তিমালিকানার রাগীমুখ মেমসাহেব থাকলেও, পরিচয়ের স্বীকৃতির তকমাটি লাগানো।
নির্জন, নিরিবিলি এলাকা। মেঘলা আকাশ। বেল বাজালেও দরজা খোলা হল না। সিঁড়িতে প্রণাম করে বসলাম। টিপটিপ বৃষ্টি।
সঙ্গে রঞ্জনদার ধারাবিবরণী।
-“রবীন্দ্রনাথ তখন গীতাঞ্জলীর অনুবাদের কাজ প্রায় করে ফেলেছেন। কিছুটা বাংলাদেশে বসে, কিছুটা বিলেতে আসার পথে জাহাজে। সঙ্গে পুত্র, পুত্রবধূ। লন্ডনে এসে টিউব রেলে হারিয়ে ফেললেন খাতা। রথীন্দ্রনাথ ছুটে গিয়ে হারানো সামগ্রীর ঘর থেকে নিয়ে এলেন খাতাটি। প্রথমে হোটেলে উঠেছিলেন তাঁরা, পরে খরচ বাঁচাতে শহরতলীর হ্যাম্পস্টেডে বাড়িভাড়া। এতদিনে ইংরেজি গীতাঞ্জলী শেষ। যোগ হয়েছে শুধু – সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি। খাতাটি কবিগুরু দিলেন বন্ধু রথেনস্টাইনকে। লন্ডন ছাড়লেন কবি। পরে সেই খাতাসূত্রেই ‘দ্য সং অফারিংস’ নোবেলজয়ের পথে। 1913 সালে।”
বলে যাচ্ছেন রঞ্জনদা, আমি মন্ত্রমুগ্ধ স্রোতা। ওই পরিবেশটাই আরও নতুন মাত্রা দিচ্ছে ধারাবিবরণীর।
হঠাৎ মনে হল, বললাম, ” এবার রবীন্দ্রজয়ন্তী এইখানে পালন করলে হয় না? সবাই মিলে এসে। এটাই হয়ে যাবে সার্ধশতবর্ষের প্রথম অনুষ্ঠান।”
রঞ্জনদা তো রাজি। কিন্তু এটা মার্চ, সময় কম, মে মাসে সম্ভব????
সম্ভব হল। প্রতিদিন সম্পাদক সৃঞ্জয় বোস সম্মত। স্পনসরশিপের দায়িত্ব নিলেন প্রবাসী শিল্পপতি প্রসূন মুখোপাধ্যায় আর টেকনো ইন্ডিয়ার সত্যম রায়চৌধুরী। যৌথ উদ্যোগে এল বিলেতের প্রবাসী বাঙালি সংগঠন পঞ্চবটি এবং চিকিৎসক সুনীত ঘটক।
রঞ্জনদা লিখে ফেললেন আলেখ্য, মিলনে বিরহে রবীন্দ্রনাথ। গদ্য, কাব্য, গানের সংকলন। আমি দুএকটি গান প্রস্তাব করলাম, রঞ্জনদা গ্রহণ করলেন।
সে এক হইহই প্রস্তুতি। এবং রবীন্দ্রজয়ন্তী হল হ্যাম্পস্টেড টাউনহলে। উপচে পড়া হল। ঐতিহাসিক বিলেতি স্থাপত্য। মেঘলা বিকেল। সকালে কবিগুরুর বিলেতবাড়ির সামনে অনুষ্ঠান, প্রণাম, গান। পাশের সবুজ প্রান্তরে মেঘ- কুয়াশামোড়া উইপিং উইলো আর ঝিলের পাশে গান, আবৃত্তি। সন্ধ্যায় টাউন হলে মূল অনুষ্ঠান। গানে লোপা, জয়তী, শান্তনু। বাংলা পাঠ, আবৃত্তি শতাব্দী, সত্যমদা, ঐশ্বর্যা। ইংরেজি পাঠে রঞ্জনদা, অনুরাধা ঘোষ। এক অসামান্য অনুষ্ঠান। একদম শেষে বৃষ্টিঝরা রাতে লোপা যখন নিজেকে উজাড় করে দিয়ে গাইছেন “তবু মনে রেখো”, তখন গোটা হল আচ্ছন্ন এক ভিন্ন উপলব্ধির সম্মোহনে। অনেকের চোখে আবেগের অশ্রু।
এই রবীন্দ্রপ্রণাম ভোলা যায় না, যাবে না।

তৃতীয় : বন্দিজীবনে, প্রেসিডেন্সি জেলে

কী বৈপরীত্য! 2015. প্রেসিডেন্সি জেল।
রবীন্দ্রজয়ন্তী, বন্দিদের অংশগ্রহণে। অফিসারদের উৎসাহ। অনুরোধ এল, থাকতে হবে, অংশ নিতে হবে। এম ডি বিভাগের পেল্লায় হল সাজিয়ে অনুষ্ঠান। যৌথ গান, নৃত্যনাট্য। কদিন মহড়া।
অনুষ্ঠানে আমি শুধু আবৃত্তি আর একটি গান।
দুই বিঘা জমির “তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ আমি আজ চোর বটে!” কিংবা “কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কী পাও….” থেকে …”পারিবে না চিনিতে আমায়, হে বন্ধু বিদায়”…দিয়ে আবৃত্তি শেষ।
আর গান.. যখন শেষ লাইন…”আমি আছি সুখে হাস্যমুখে দুঃখ আমার নাই/ আমি আপনমনে মাঠে বনে উধাও হয়ে যাই…”, গেয়ে মঞ্চ থেকে নামছি, জেল সুপার দেবাশিস চক্রবর্তী উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “অনেকদিন পর রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ।”
অনুষ্ঠানে থাকা, দেখা, শোনা, নিজে একটু অংশ নেওয়া, বন্দিজীবনেও রবীন্দ্রজয়ন্তী মন ভরিয়ে দিয়েছে। এই দিনটাও তো ভোলার নয়।

সুখ, দুঃখ, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, পূর্ণতা, শূন্যতা, জীবনের সব পরিস্থিতিতে অস্থির মনের সঙ্গী, আশ্রয় তো সেই একজনই- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

পঁচিশে বৈশাখ চিরকাল থাকুক প্রাণছুঁয়ে।
আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরকাল থাকুন প্রাণভরিয়ে।

এবং চিরন্তন থাক তাঁর মন্ত্র: যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।

Advt

 

Previous articleসর্বনন্দ না হিমন্ত? অসমে মুখ্যমন্ত্রী বাছাই করতে গিয়ে দল ভাঙার আশঙ্কায় বিজেপি
Next articleBreaking: মমতার মন্ত্রিসভায় এবার কিছু ভাঙাগড়া, কিছু চমক