অঞ্জনদা শুধু খবর দেখায়নি, খবর চেপেওছিল। কুণাল ঘোষের কলম

” একটা চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করবে নাকি?”

সক্কাল সক্কাল অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোন।

সময়টা 2010। পুরভোটের মুখে। ঠিক তার দুএকদিন আগে এবিপি আনন্দে ( তখন বোধহয় স্টার আনন্দ) তৃণমূলপন্থী বুদ্ধিজীবীদের ধুয়ে দিয়েছেন অরুণাভ ঘোষ আর নির্বেদ রায়। শুভাপ্রসন্নকে তো নাস্তানাবুদ করেছেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে আমি ‘সংবাদ প্রতিদিন’এ শুভাদাদের কটাক্ষ করেই কলম লিখেছি, অরুণাভ-নির্বেদ জুটিকে মোকাবিলা এভাবে করা যায় না, তার জন্য যথাযথভাবে তৈরি থাকতে হয়। অন্যথায় হাস্যাস্পদ হতে হবেই।

তারপরেই অঞ্জনদার ফোন।
বললাম -” কী চ্যালেঞ্জ?”

-” ঐ যে তুমি লিখেছো যে শুভাদারা অরুণাভদা আর নির্বেদদাকে সামলাতে পারেননি। তো তুমি সেটা করে দেখাতে পারবে? একদিকে একা তুমি, অন্যদিকে ওরা দুজন, মানে নির্বেদদা অরুণাভদা। আমার অনুষ্ঠানে। পারবে?”

হেসে বললাম,” পারব। কিন্তু ওরা তো তিনজন। একে 24, তার উপর তুমি।”

-” একদম না। সঞ্চালক নিরপেক্ষ ভাবে। প্রমিস।”

বিচিত্র সেই অনুষ্ঠান হল। 24 তখন পোদ্দার কোর্টে। রাত আটটা থেকে নটা। অঞ্জনদা মাঝখানে। একদিকে আমি। অন্যদিকে তখনকার বিধ্বংসী জুটি। এতটাই জমল যে নটায় শেষ হল না। নটা পঁচিশ পর্যন্ত চলল। শেষে প্রথম অভিনন্দন অঞ্জনদারই,” অসাধারণ। এতটা ভাবিনি।”

অভিনন্দনের বন্যা তারপর। নির্বেদদা এবং অরুণাভদাও পিঠ চাপড়ে দিলেন।

কিন্তু আমি অভিভূত ছিলাম অঞ্জনদার সিদ্ধান্ত এবং ফোনটিতে। সেদিন আমাকে পারফরম করার যে প্ল্যাটফর্মটি অঞ্জনদা দিয়েছিল, সেটা জাস্ট ভাবা যায় না। ঐ বাজারে নির্বেদ- অরুণাভ জুটি বনাম একা আমি, এটাই তো আমার উত্তরণ।

এইরকম পরিকল্পনা করে বিচিত্র প্যানেল, অভিনব।
পরের দিন সকালেও ফোন অঞ্জনদার,” আরে দারুণ ফিডব্যাক।”

অঞ্জনদার সঙ্গে এক হাউসে কখনও কাজ করিনি। তাই একসঙ্গে বেশি সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা বা স্মৃতিচারণের বাড়াবাড়িতে আমি নেই।

আমার সঙ্গে একটি দীর্ঘ সসম্মান আন্তরিক সম্পর্ক। দাদা- ভাই সৌজন্য। হাসিখুশি। বড় মন। বিভিন্ন বিষয়ে কথা, ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ চলত। খবর নিয়ে। খবরের পিছনের খবর নিয়ে।

অঞ্জনদার সঙ্গে প্রথম কাছাকাছি থেকে কাজ 1996 সালে। দিল্লিতে। তেরো দিনের বাজপেয়ী সরকার ঘিরে উথালপাতাল কিংবা তার কমাস পর দেবগৌড়া সরকারের পতন। অঞ্জনদা তখন আনন্দবাজারের দিল্লি অফিসে। আমি প্রতিদিন থেকে দিল্লিতে। একসঙ্গে একাধিক পার্টি অফিস, নেতার বাড়ি টহল বঙ্গীয় সাংবাদিককুলের।

মজার ঘটনা, দেবগৌড়া সরকার পড়ছে। কংগ্রেসের সীতারাম কেশরী প্রধানমন্ত্রী হতে গিয়েও ব্যাকফুটে। পি এম বদলে তৃতীয় মোর্চাই আবার থাকবে। রটে গেল মুলায়ম প্রধানমন্ত্রী। অঞ্জনদা, আমি, অঞ্জন সাহারা ছুটে মুলায়মের বাড়ি। ফটো সেশন শেষ। অঞ্জনদা আর আমার সাক্ষাৎকার নেওয়া শেষ।

এবং তখন খবর এলো লালু মুলায়মকে মানবেন না। তাই গুজরাল প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। মুলায়মের সাক্ষাৎকার তখন কী হবে? আমরা হেসেই খুন। ছোটা শুরু গুজরালের সন্ধানে।

যাত্রাপথে এমন কিছু টুকরো টুকরো ঘটনা।

বলে রাখা ভালো, আমার কোনো অনুষ্ঠান বা কর্মসূচি থাকলে কভারেজের অনুরোধ জানাতাম অঞ্জনদাকে, তেমনই, একটি বার একটি ‘খবর’ চেপে দেওয়ার অনুরোধও করেছিলাম।

তখন আমি বন্দি। রোজ শিরোনামে।
কোর্ট থেকে ফিরছি।
জেলে ফেরার পথে এক ভ্রাতৃপ্রতিমের রেস্তোরায় মাঝেমধ্যে ঢুকতাম। পুলিশের যে অফিসার আমার সঙ্গে থাকতেন, এতে আপত্তি করতেন না। সবকজন পুলিশই থাকতেন সঙ্গে।

সেদিন সেই একান্ত ঘনিষ্ঠের রেস্তোরায় খেয়ে বেরোচ্ছি। জেলে ফিরব। সবে দোকান থেকে রাস্তায় পা রেখেছি, সামনে 24 ঘন্টা। কোনো সাংবাদিক/চিত্রসাংবাদিক যাচ্ছিলেন। ওখানে আমাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে ছবি ইত্যাদি।

তারপর জেলে ঢোকার আগে অঞ্জনদাকে ফোন করলাম পুলিশের ফোন থেকেই। অবাক। প্রথমে একটু গল্প। তারপর বললাম,” দাদা, খবরটা কোরো না। আমার কিসসু হবে না। পুলিশরা সাসপেন্ড হবে।”
অঞ্জনদা বলল,” মজাদার খবর। পুলিশবেষ্টিত কুণাল রেস্তোরায়।”
আমি বললাম আমার কোনো সমস্যা নেই। পুলিশকর্মীদের বিরাট ক্ষতি। এই যন্ত্রণার জীবনে একটু হাল্কা মুহূর্তে অনুমতি দিয়ে ওরা বিপদে পড়বে। দেখিও না।

অঞ্জনদা বুঝল। এবং বলল,” নিশ্চিন্ত থাকো। যাবে না।”

অঞ্জনদা বড় হাউসের ডিজিটাল শাখার দায়িত্ব ছেড়ে নতুন চ্যানেলে যাবে।

ফোন করল। কেন যাচ্ছে ইত্যাদি বলল। তারপর বলল,” এখানকার সিইওর সঙ্গে বোধহয় তোমার পুরনো আলাপ। বলছিলেন। একদিন গল্প করা যাক। আসবে?”

অতঃপর একটি রাজপ্রাসাদসম পাঁচতারা হোটেলে দীর্ঘ আড্ডা। অঞ্জনদা, আমি, সেই কর্তা। রাজনীতি থেকে চারপাশ- দীর্ঘ প্রাণখোলা আড্ডা।

আবার কদিন পরেই অঞ্জনদার ফোন।
– ” ওটা ছাড়ছি। 24এই ফিরব।”

কেন, কীভাবে, অকপট গল্প। লেখা অনুচিত।

শেষ দিকটায় অঞ্জনদার অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়নি।
-” তোমাকে পাওয়া যাচ্ছে না কেন বলো তো?”
বললাম: “দাদা, আছি আছি। দেখা হবে।”

নাঃ।
দেখা আর হল না।
প্রিন্ট মিডিয়া এবং টিভিতে সমান সাবলীল পারফরমার খুব বেশি নেই।
সেরকম একজন প্রথম সারির সাংবাদিক চলে যাওয়া এই বৃত্তটির ক্ষতি।

অঞ্জনদার পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের জানাই আন্তরিক সমবেদনা।

আর মৌপিয়া ‘অঞ্জন’ নন্দী। তোমার অকপট পোস্ট, মর্মস্পর্শী ব্যাকুলতাকে সেলাম জানালাম।

অঞ্জনদা তো থাকবেই। তোমার মধ্যে। তোমাদের মধ্যে।

 

Previous articleবঙ্গোপসাগরে তৈরি হচ্ছে ঘূর্ণিঝড় যশ, বাংলায় আছড়ে পড়তে পারে ২৩ মে?
Next article৪ নেতা-মন্ত্রীর তরফে রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি গ্রহণ হাইকোর্টে, বুধবার শুনানি