১৬ অগাস্ট: ফুটবল প্রেমীদের জন্য কান্নাভেজা চোখে মান্নার গান, ব্যান করেছিল সিপিএম

সোমনাথ বিশ্বাস: এবার ১৬ অগাস্ট “খেলা হবে দিবস” পালন করবে রাজ্য সরকার। বাংলার ক্রীড়া প্রেমী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং এমন উদ্যোগ নিয়েছেন। এই আয়োজনের প্রস্তুতিও তুঙ্গে। যা নিয়ে বিরোধী বিজেপি তাল ঠুকছে। কিন্তু এই দিনটি ফুটবল প্রেমী বাঙালির কাছে আবেগের একটি দিন। এই দিনের মাহাত্ম একটু অন্যরকম। হৃদয় বিদারকও বটে। এখন থেকে ৪০ বছর আগে এই দিনেই ঘটেছিল সেই মর্মান্তিক ঘটনা। সেই ঘটনাকে স্মরণে রেখেই প্রতি বছর এই দিনটি “ফুটবল প্রেমী” দিবস হিসেবে পালন করে আইএফএ-সহ রাজ্যের বিভিন্ন ক্লাব সংগঠন। বৃহৎ রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়। মান্না দে গেয়েছিলেন, ‘খেলা ফুটবল খেলা/খোকা খেলতে গেল/সেই সকালবেলা../ আর ফিরল না৷’সেই দিনটিকে এখনও ময়দানে শহিদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়৷ আর ফুটবল প্রেমীরা প্রার্থনা করেন, এমন শোকের দিন যেন ফুটবলের ইতিহাসে আর না ফিরে আসে৷ আর ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ১৬ আগস্ট দিনটিকে স্মরণ করেই, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা-মাটি-মানুষের সরকার এবার পালন করবে “খেলা হবে দিবস”।
রাজ্যের ক্রীড়া ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে ১৬ অগাস্ট
কী ঘটেছিল সেদিন। কলকাতা ফুটবলে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের সাক্ষী ছিল বাংলা তথা কলকাতা। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ চলাকালীন এক মর্মান্তিক ঘটনা। ১৯৮০ সালের ১৬ অগাস্ট ইডেন গার্ডেনসে চলছিল কলকাতা ফুটবল লিগে  মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ। সেই মর্মান্তিক ঘটনা এখনও তাড়া করে বেড়ায় ময়দানের অনেককেই। ইডেনে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ দেখতে এসে আর বাড়ি ফেরেননি ১৬টি তরতাজা প্রাণ৷ স্টেডিয়ামের ডি ব্লকে অতিরিক্ত দর্শক প্রবেশ, সাময়িক অশান্তি, ধস্তাধস্তি, পদপিষ্ট, সামলাতে ব্যর্থ পুলিশ৷ তারই মাঝে প্রাণ হারান ১৬ জন দর্শক।
অমর ফুটবল প্রেমীদের শ্রদ্ধা জানিয়ে মান্না দে’র কালজয়ী গান “খেলা ফুটবল খেলা…”
১৯৮১। সেই অমর ফুটবলপ্রেমীদের শ্রদ্ধা জানিয়ে মান্না দে গাইলেন এক ভীষণ মর্মস্পর্শী গান। অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন এক অসাধারণ কবিতা—‘খেলা ফুটবল খেলা/খোকা খেলতে গেল/সেই সকাল বেলা/দুটো বড় টিমের খেলা/শত লোকের মেলা।’ তখন ‘কল্পতরু’ প্রোডাকশনের ‘টাকার ফানুষ’ ছবির গানের রেকর্ডিং-এর কাজ চলছে। গান লিখেছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। সুরকার সুপর্ণকান্তি ঘোষ। সে দিন গাইছেন মান্না দে। স্টুডিওতে উপস্থিত ‘কল্পতরু’র দুই প্রাণ-পুরুষ সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় ও তরুণকুমার। এক সময়ে সত্যবাবু মান্না দে-কে কবিতাটি পড়ে শোনান। উপস্থিত সকলের মনে হল এই কবিতাটা একটা দারুণ গান হতে পারে। এর আগে পুলক-নচিকেতা-মান্না সৃষ্টি করেছেন বাঙালির ফুটবলের “জাতীয় সঙ্গীত” ‘আহা, সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’। এই কবিতাটাও তো সেই ফুটবল নিয়ে। আর এমন কবিতাধর্মী, কাহিনিমূলক গান সুর করতে সুপর্ণকান্তি ঘোষের তো জুটি নেই। এর আগে করেছেন—‘কফি হাউস’, ‘সে আমার ছোট বোন’-এর মতো গান। অতএব সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুপর্ণকান্তি ঘোষ অনেক দিনের সিটিং, কথাগুলোকে সুরের উপযোগী করে তোলা এবং অসাধারণ একটি সুর সংযোজন। সমীর খাসনবিশের মিউজিক অ্যারে়ঞ্জমেন্টে মান্না দে গাইলেন—‘খেলা, ফুটবল খেলা’। শোনা যায়, রেকর্ডিংয়ের সময়ও গায়ক এবং সুরকার নানা ভাবে গানটির ইম্প্রোভাইজেশন করছেন। গানের মধ্যে ‘খোকা’ বলে যে ‘কল’টি আছে, সেটি কিন্তু মূল সুরে ছিল না—গাইতে গাইতে রেকর্ডিং-এর সময়ে তৈরি হল। এক একটা মহান সৃষ্টি এমন ভাবেই হয়। গানটি গাইতে গাইতে মান্না দে বারবার অশ্রুরুদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন। হওয়ারই কথা। অত্যন্ত নরম মনের মানুষ, ফুটবল-অন্ত প্রাণ, সেই খেলার জন্য এত মানুষের মৃত্যু। অমন কথা, অমন সুর—চোখে জল তো আসবেই। কোথাও কোথাও কান্না-ভেজা গলাটা গানের সঙ্গে মিশে গেল—অনেকে চাইলেন গাওয়াটা এ ভাবেই থাকুক। আপত্তি করলেন স্বয়ং মান্না দে। এক মূল্যবান কথা বলেছিলেন সুপর্ণ ঘোষকে —‘গায়কির মধ্যে আবেগটা কতটুকু প্রকাশ করবে, কী ভাবে করবে সেই হিসাবটা জানা চাই। নইলে সব গোলমাল হয়ে যাবে’। সুপর্ণ ঘোষ মনে করতে পারলেন—‘সে আমার ছোট বোন’ গানের রেকর্ডিংয়ের সময়ও এমন ঘটনা ঘটেছিল। গাইতে গাইতে অনেক বার কেঁদে ফেলছিলেন। ফাইনাল ‘টেক’-এ নিজেকে সামলে নিয়েই গেয়েছিলেন। ফল কি হল? মান্না দে গাইলেন, কাঁদতে কাঁদতে গাইলেন। অবশেষে কলকাতা ক্রীড়া সাংবাদিক ক্লাবে ১৯৮১ সালে ফুটবল নিয়ে এই ক্যাসেটটি উদ্বোধন হয়। গায়ক-গায়িকা-সুরকার ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন মান্না দে’র পরম বন্ধু সেবাব্রত গুপ্ত, স্নেহাংশু আচার্য আর তৎকালীন সব ফুটবল নক্ষত্র।
পুলিশি ব্যর্থতা ঢাকতে তৎকালীন বাম সরকার ব্যান করেছিল গানটিকে
রেকর্ডিং হওয়ার পর বাজারে এই গানের ক্যাসেট আসতেই নিমেষে তা বিক্রি হয় যাচ্ছিল। শহর থেকে গ্রাম, তখন সকলের মুখে মুখে ফিরছে কিংবদন্তি শিল্পীর কালজয়ী “খেলা ফুটবল খেলা…”! শোনা যায়, মান্না দে-সহ এই গানের সঙ্গে যুক্তরা কেউ পারিশ্রমিক নেননি। বরং, রেকর্ড বিক্রির টাকা তুলে দেওয়া হয়েছিল ১৬ জন ফুটবল প্রেমীর পরিবারের হাতে। আর তাতেই বিড়ম্বনায় পড়েছিল সিপিএম তথা বামেরা। ১৬ আগস্টের ঘটনা নিয়ে তৎকালীন বাম সরকার ও তাদের পুলিশের গাফিলতির দিকেও আঙুল উঠেছিল। অগত্যা বিতর্ক এড়াতে  কিংবদন্তি শিল্পীর কালজয়ী গানটিকে ব্যান করেছিলো সিপিএম।


Previous articleহলুদ সতর্কতা জারি উত্তরবঙ্গে, বৃষ্টিতে ভিজবে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গও
Next articleযান্ত্রিক গোলযোগ, উৎক্ষেপণের পরেও কক্ষপথে পৌঁছতে পারল না ইসরোর কৃত্রিম উপগ্রহ