সুব্রতদা পর্ব ৩ : দুর্গাপুরের সেই সভায় সুব্রতদার বিস্ফোরক বক্তৃতা

কুণাল ঘোষ

বিষয় রাজ্যসভা।
কিন্তু ঘটনাটার মধ্যে সুব্রতদার অনেকগুলো দিক আছে।
একজন তরুণ সাংবাদিক হিসেবে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
১৯৯৭/৯৮ সাল হবে।
বেশ রাত।
কাজকর্ম করে বাড়ি ফিরেছি।
আমি তখন ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ।
সাংবাদিক কণাদ দাশগুপ্তের ফোন।
—‘সুব্রতদা খুঁজছে। এখনই ফোন করো।’
—‘কেন? কী হল? বিকেলেও তো কথা হয়েছে।’
—‘রাতে কোনও ডেভেলপমেন্ট হয়েছে। উনি দল ছাড়তে পারেন বললেন। ফোন করো। খুঁজছেন।’
ফোন করলাম।

আরও পড়ুন: আজ যেতে হবে, ফিরব মমতার দলেই

সুব্রতদা বললেন, ‘অমর বলল সমাজবাদী পার্টিতে জয়েন করে যেতে। ওরা রাজ্যসভায় পাঠাবে। এতকাল তো কংগ্রেসটা করলাম। এবার ভাবছি দেখি না কী হয়!’
শুনেই তো আমি খবর নিয়ে উত্তেজিত। অমর সিংয়ের সঙ্গে সুব্রতদার পুরনো সম্পর্ক। কী কী কথা হয়েছে শুনলাম। বললাম, ‘খবরটা করব তো?’
সুব্রতদা বললেন, ‘খবর করলে আমি অস্বীকার করব না।’
অতঃপর পরের দিন ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ পেজ ওয়ান সুপার লিড।

তবে লেখার সুর নরম রেখেছিলাম।
কারণ আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল, অমর সিং যত আন্তরিকভাবেই ডাকুন আর তাৎক্ষণিকতায় সুব্রতদা যতই রোমাঞ্চিত হন; শেষপর্যন্ত সুব্রতদা কংগ্রেস ছেড়ে, আইএনটিইউসি ছেড়ে, উত্তরপ্রদেশের দল করতে যাবেন না।
ফলে খবরে অমর সিংয়ের আমন্ত্রণ গুরুত্ব পেল। সুব্রতদার অংশে ‘?’ দিয়ে লিখলাম। দল কি ছাড়বেন সুব্রত? এই ধরনের।

পরদিন কাগজ হিট। সব কাগজ দাঁড়িয়ে মিস। অমর এবং সুব্রতদা দুজনেই কথোপকথন স্বীকার করেছেন। বাকিরা ফলো-আপ করতে ব্যস্ত। কংগ্রেস ছাড়ছেন সুব্রত।
সন্ধেবেলায় সুব্রতদার ফোন।
বললেন আনন্দবাজারের দুই সাংবাদিক ফোন করেছিল। (দু’জনের এক নাম। দু’জনেই এখন আনন্দবাজারে নেই) সিনিয়রজন বলেছেন, একটা ছোট কাগজকে খবরটা দিয়ে দিলে? আমাদের দিলে বড় করে করতাম। আজ ভাল করে বলো। বিরাট করে করব। সুব্রতদা তাই শুনে আরও বিস্তারিত করে বলেছেন কেন উনি কংগ্রেস ছাড়ার কথা ভাবছেন। ওরা খবরটা গুরুত্ব দিয়ে করছে।
কিন্তু, আমাকে ফোন করার কারণ কী?
মনে হল ওই যে ‘ছোট কাগজকে কেন দিলে’— এটা সুব্রতদার হজম হয়নি।
বললাম, ‘একটা কথা বলব দাদা?’
—‘বলো’।
—‘আমি নিশ্চিত, আপনি সমাজবাদী পার্টিতে যাচ্ছেন না। রাজ্যসভা দিলেও না।’
—‘কী করে বুঝলে?’
—‘আপনি গেলে কথা শুরুর প্রথম দিনেই খবরটা বার করে দিতেন না। আর যেটুকু চিনি আপনাকে, রাজ্যসভা দিলেও আপনি উত্তরপ্রদেশ থেকে সমাজবাদীর সাংসদ হতে যাবেন না।’
—‘ঠিক। একদম ঠিক।’
—‘একটা অনুরোধ করব?’
—‘বলে ফেলো।’
—‘কাল তো সবাই আজকের ফলো-আপ করবে আপনি যাচ্ছেন। আমরা লিখছি আমন্ত্রণে সাড়া দিচ্ছেন না আপনি। তা হলে বেশ জমবে।’
—‘লিখে দাও।’

অতঃপর পরের দিন আনন্দবাজার-সহ সব কাগজে বেরল অমরের আমন্ত্রণ, কংগ্রেস ছেড়ে সমাজবাদীর পথে সুব্রত।
আর প্রতিদিনে বেরল, ‘কংগ্রেস ছাড়বেন না সুব্রত, জানিয়ে দিচ্ছেন অমরকে।’
আনন্দবাজারের সিনিয়র মোস্ট সাংবাদিক ফোন করার পরেও তাঁদের ভুলের দিকে ঠেলে দিয়ে ছোট কাগজকে নিয়ে এমন খেলা সুব্রতদার পক্ষেই সম্ভব ছিল।

সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড দেখেননি সুব্রতদা। বড় কাগজ, ছোট কাগজ— সব সমান। বরুণ সেনগুপ্তকে শ্রদ্ধা করতেন। আর ওঁর নিজের কাকে ভাল লাগছে, সেটাই শেষ কথা। সে কোন কাগজে আছে বা পরবর্তীকালে টিভিতে আছে, সুব্রতদা ভেবেও দেখতেন না। এমনকী তাঁর কাগজ পক্ষে লিখবে না বিপক্ষে, এটাও তাঁর কাছে গৌণ। সদা হাস্যমুখ। মেজাজ হারাতেন কম। পঁচিশ দিন সাংবাদিকতা করছে নাকি পঁচিশ বছর, সবার অবারিতদ্বার। তাঁর দিলখোলা আড্ডা, রসিকতা, মজার কথা আর অজস্র গল্পের সঙ্গী সবাই। এই লেখায় আমি সুব্রতদার মুখে প্রিয়দার নানা গল্প, ভূতের গল্প, ভূতের ভয়, লাঠি-হাতে জমি পাহারা— এসব বহুচর্চিত বিষয়গুলি লিখছি না। কারণ, এগুলি পুনঃ পুনঃ পুনঃ প্রকাশিত। আমি শুধু বলব জরুরি অবস্থায় যিনি তথ্যমন্ত্রী হয়ে অপ্রিয় কাজের দায়িত্বে, তিনিই যেভাবে সাংবাদিকদের কাছের লোক হয়ে উঠেছিলেন, এটা অভাবনীয়। একটা সময় ছিল, যখন বেলার দিকে প্রদেশ কংগ্রেসের সম্পাদকমণ্ডলী বা রাজ্য কমিটির বৈঠকগুলি হত। সেসব সেরে সুব্রতদা বাড়ি ফিরে খেয়ে হয়ত একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন, তিনটে চারটে নাগাদ গিয়ে হাজির হতাম— ‘দাদা, মিটিং-এর ভেতরটা একটু বলুন না।’

একদিন আমি আর অমল সরকার গিয়েছিলাম। সুব্রতদা বলেছিলেন, ‘এখন জুনিয়র আছো বলে খেটেখুটে বাড়িতে আসছো। একটু সিনিয়র হলেই তো ফোনে বলবে, কী কী হল, বলে দিন তো!’

******

সুব্রতদাকে নিয়ে অসম্পূর্ণ থাকবে ‘তরমুজ’ শব্দটি না আনলে।
আটের দশক থেকেই একটা রব ওঠে কংগ্রেসের মধ্যে থেকে কেউ কেউ সিপিএমের প্রতি নরম। বাইরে সবুজ। ভিতরে লাল। এটির কপিরাইট ছিল সুব্রতদার। পরে খানিকটা চেপে যায় সোমেনদার উপর। গোটা কংগ্রেসটাই তখন কর্মীদের বড় অংশের চোখে সিপিএমের বি টিম। এই জায়গা থেকেই কিন্তু তৃণমূলের জন্ম।
এখন প্রশ্ন হল এই ‘তরমুজ’ শব্দটা সুব্রতদা কেমনভাবে নিতেন?
দেখেছি, ভারি রসিকতার মধ্যে দিয়ে নিতেন।
তরমুজ কথাটা চলল কেন?
হালকা রাজনীতি নয়, এর মধ্যে একটা গভীরতা আছে। বিশ্লেষণের অবকাশ আছে।
‘তরমুজ’ শব্দটা চলল, তার মূল কারণ তিনটি—

১. কেন্দ্রের কংগ্রেস বারবার রাজ্যে বামনির্ভর হয়েছে। জ্যোতি বসুকে শ্রদ্ধা করতেন তাঁদের সর্বোচ্চ নেতারা। পরে নরসিংহ রাওয়ের সংখ্যালঘু সরকার আরও বামনির্ভর হয়। ফলে দিল্লি একটা স্তরের পর বামেদের খোঁচাতে সবুজ সঙ্কেত দিত না। ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই অত বড় গণহত্যার পরেও যে কারণে কেন্দ্র থেকে কিছুই করা হল না। এগুলোর দায় চেপেছে রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের উপর। এই বেড়াটা ভাঙতে গিয়েছিলেন মমতাদি। সুব্রতদারা সেইভাবে নামেন নি।

২. সুব্রতদার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে জ্যোতি বসু থেকে হাসিম আবদুল হালিম, শীর্ষ বাম নেতাদের সম্পর্ক খুবই ভাল ছিল। এটার ব্যাখ্যা এবং অপব্যাখ্যা ছড়াতে ছড়াতে তরমুজ-তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
৩. এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তা হল শ্রমিক আন্দোলন। এটি ছিল সুব্রতদার অগ্রাধিকার। তিনি আইএনটিইউসির রাজ্য সভাপতি। কখনও সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। আইএলওতে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন বারবার।
শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে সুব্রতদার একটা স্পষ্ট নীতি ছিল। তা হল— সংস্থাকে বাঁচিয়ে শ্রমিকদের কাজ করতে হবে। আর শ্রমিকদের স্বার্থে শ্রমিক সংগঠনগুলিকে এক হয়ে থাকতে হবে। সেখানে বাইরের রাজনীতির অবস্থানগত ভেদাভেদ যেন না আসে।

ফলে, এমন দৃশ্য প্রায়ই দেখা যেত, কংগ্রেস হয়ত সিপিএমের বিরুদ্ধে কর্মসূচি নিচ্ছে, তাতে সুব্রতদাও আছেন। কিন্তু তার পরেই দেখা যেত শ্রমিক আন্দোলনের কোনও বৈঠকে সুব্রতদা সিটু, এআইটিইউসি, ইউটিইউসি-সহ বাম ট্রেড ইউনিয়নগুলির নেতাদের সঙ্গে বসে আছেন। কখনও সেই বৈঠক হত সিটু অফিসে। কখনও আইএনটিইউসি অফিসে। সেসব খবর, ছবি যত বেরত, তত সুব্রতদার গায়ে ‘তরমুজ’ তকমা জোরদার হত।
এর ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন সুব্রতদা, ‘ট্রেড ইউনিয়ন আর জেনারেল পলিটিক্স মেলালে সমস্যা। যদি সত্যিই শ্রমিকদের ভাল করতে হয়, তা হলে কারখানাগুলিতে বাইরের রাজনীতির বিভেদগত অবস্থানের রাজনীতি রাখলে বিরাট ক্ষতি। ওখানে শ্রমিক-ঐক্য দরকার। এটা সব ট্রেড ইউনিয়নকে বুঝতে হবে। সাধারণ মানুষকেও বুঝতে হবে।’
একটা উদাহরণ দিই। আমি তখন ‘আজকাল’-এ। কেন্দ্রে মনমোহন সিং সরকার। দুর্গাপুরে সব ট্রেড ইউনিয়নের মিলিত সভা। উদার অর্থনীতি নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। ইস্পাতমন্ত্রী সন্তোষমোহন দেব। সুব্রতদা অন্যতম বক্তা। আমি গিয়েছি সুব্রতদার সঙ্গে।

সুব্রতদা তখন কংগ্রেসের নেতা।
লালঝান্ডা, তিরঙ্গা ঝান্ডার মিলিত সমাবেশে তিনি ভাষণে বললেন, ‘দেশের সর্বনাশ করছেন দুই মোহন— মনমোহন আর সন্তোষমোহন। অবিলম্বে নীতি বদলাতে হবে।’
ভাষণ হিট। শিরোনাম।
কিন্তু গাঢ় হয়েছে ‘তরমুজ’ বিশেষণ।
পাত্তা দেননি সুব্রতদা।

তা ছাড়া সুব্রতদার চিমটিকাটা মজাদার সব বিবৃতি। কিছু ক্ষেত্রে সিপিএমের বিরুদ্ধে। কিছু ক্ষেত্রে দলের নেতানেত্রীদের সম্পর্কেও। সোমেনদা, প্রিয়দা, এমনকী মমতাদিও বাদ যাননি। তাতে হয়ত মুখে মুখে প্রচার হয়েছে, কিন্তু সুব্রতদার ইমেজ যতটা গভীরতা স্পর্শ করতে পারত, সেটা ধাক্কা খেয়েছে।

একটা সময় সুব্রতদা যখন অনুভব করেছেন রাজ্যে কংগ্রেসটা বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। আর তাঁরও এককভাবে প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার জমিটাও সেভাবে নেই; তখন বহুরকম গুণ সত্ত্বেও সাধের আইএনটিইউসিও কালের নিয়মে হাতের মুঠো থেকে ছেড়ে দিতে হয়েছে।
শ্রমিক সংগঠনে সুব্রতদা দলের মধ্যেই যাঁদের তরফে আগাগোড়া নীতিগত বিরোধিতা পেয়েছেন তাঁরা হলেন লক্ষ্মীকান্ত বসু ও শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। শোভনদেবদা বামসহাবস্থানের নীতির পক্ষে ছিলেন না।
আর সুব্রতদার যুক্তি, বামেদের বাইরে রেখে শ্রমিক আন্দোলন কঠিন।

আরও পড়ুন: সুব্রতদা পর্ব ২ : সুব্রতদার কথা শুনে তখন মাথায় বাজ!

আবার উল্টোদিকে বাম শ্রমিক নেতাদের মধ্যে চিত্তব্রত মজুমদার, কালী ঘোষরা সুব্রতদার প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতেন। বলতেন, ‘রাজনৈতিকভাবে বিরোধী হলেও শ্রমিক আন্দোলনে ইস্যুভিত্তিকভাবে ঐক্য থাকাটা জরুরি ছিল।’
এ এক বিস্তর বিতর্কের বিষয়। আমি বিচারের কেউ নই। কিন্তু সুব্রতদার কথা আলোচনার সময় তরমুজের উৎস সন্ধানে না গেলে সেটা অসম্পূর্ণ লেখা হবে। শুধু ক’টা বহুচর্চিত গল্প লিখে পাঠকদের পুনরাবৃত্তিজনিত বিরক্তির কারণ হতে চাই না।

*******

সুব্রতদা বর্ণময়।
তাঁর অনেকগুলি সত্তা ছিল।
অসামান্য দক্ষতায় সেই সত্তাগুলির মধ্যে বিভাজনরেখা টেনে রাখতে জানতেন।
বিরোধী দলের বিধায়ক সুব্রতদা যে খেলাচ্ছলে বিধানসভা জমিয়ে রাখতেন; সেই মানুষটাই বিকেলে আইএনটিইউসি দপ্তরে সভাপতির চেয়ারে যখন জুট ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে বৈঠক করছেন, তখন অন্য চেহারা।
আবার এক্সাইড মোড়ে মেটাল বক্স খোলার দাবিতে অবরোধ থেকে যে সুব্রতদা পটাং করে একটা বাসের কাচ ভেঙে দিলেন, তার থেকে ঢের আলাদা মেয়র বা মন্ত্রীর চেয়ারে বসা প্রশাসক সুব্রতদা।
ইন্দিরা গান্ধীকে শ্রদ্ধা করতেন। মমতাদির অনুমতি নিয়ে কলকাতায় সেই ইন্দিরাজির মূর্তি বসিয়ে গিয়েছেন সুব্রতদা। বিড়লা তারামণ্ডলের পাশে।
আর উত্তর কলকাতায় তাঁর এমন একটি কীর্তি রয়েছে, যা শুধু এটির কারণেই তাঁকে অমর করে রাখবে।
প্রশাসক সুব্রতদা যেন আরেক গ্রহ থেকে আসা।
(এরপর আগামিকাল)

 

Previous article১০ বছর পর ফের অভিনয় জগতে সাংসদ, কী বলছেন শতাব্দী
Next articleঅষ্টভূজা: মুখ্যমন্ত্রীত্ব ছাড়াও হাতে আরও ৮ গুরুত্বপূর্ণ দফতর