‘কবে যে কোথায়’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

মেজাজটাই আসল রাজা। পেলে, মারাদোনা, আমীর খান, আলি আকবর, সুনীল গাভাসকর, ভিভ রিচার্ডস, লতা মঙ্গেশকর, কিশোর কুমার প্রমুখ যাঁদেরই নাম করা যাক না কেন প্রত‍‍্যেকেরই ক্ষেত্রে দেখা গেছে আসল রাজা কিন্তু মেজাজটাই। যেদিন এঁরা স্ব স্ব মেজাজে থাকেন সেদিন মাঠে হোক অথবা মঞ্চে সেই অনির্বচনীয় আলোর সন্ধান মেলে যার দেখা পেতে দর্শক ও শ্রোতারা হাজার হাজার মাইল হাঁটতে রাজি থাকেন।

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন ‘, কেমন যেন একটা ঘোর লাগে লেখার সময়, তারপর লেখা শেষ হলে সেই ঘোরটা কেটে যায়। ‘ এই ঘোরটাই বোধহয় মেজাজ।

তেমনই এক গায়ক ভুপিন্দর সিং, যাঁর গানের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও কিংবদন্তিদের সঙ্গে এক সারিতে বসার যোগ্যতা তিনি অর্জন করেছেন তাঁর গানের অনবদ‍্য মেজাজের সুবাদে। গান গাওয়ার মেজাজ। অসামান্য তো বটেই এমনকি বিরলও বলা যেতে পারে তাঁর কণ্ঠকে।

মিহিদানার মতো গুঁড়োগুঁড়ো সুমিষ্ট দানায় ভরা তাঁর কণ্ঠ, অপরূপা অলংকারে ঋদ্ধ তাঁর সুরের মায়াজাল যা কানের ভিতর দিয়ে একেবারে মরমে পৌঁছয় যেন আলোর চেয়েও দ্রুতগতিতে। তিনি যখন গাইতে থাকেন ‘ দিল ঢুন্ডতা হ‍্যায় ফির ওহি ফুরসত কে রাত দিন ‘ তখন আশ্চর্য এক উদাসীনতা গ্রাস করে বিভিন্ন বয়সী শ্রোতাদের যেখানে স্মৃতি, প্রেম, বিরহ, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সব মিলেমিশে এক অদ্ভুত মায়াজগৎ তৈরি হয় মুহূর্তের মধ‍্যে। প্রসঙ্গত, এই গানটির দু’রকম সুর আছে দু’রকম তাল ও ছন্দে, দু’রকম মেজাজে।

ভুপিন্দরকে এক সময় স্প‍্যানিশ গীটারের রাজা বলা হতো মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গীতের প্লেব‍্যাক গায়ক হিসেবে তিনি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও। বিশিষ্ট সুরকার মদন মোহন সাহেবের হাত ধরে সঙ্গীত জগতে তাঁর উত্থান এবং পরে রাহুল দেব বর্মণের নিত‍্যসঙ্গী হিসেবে তাঁর দীর্ঘ সঙ্গীতসফর। ‘ চুরা লিয়া হ‍্যায় তুমনে যো দিল কো ‘ গানটিতে তাঁর হাতে স্প‍্যানিশ যেন কথা বলেছে এবং গানটির অবিচ্ছেদ‍্য অংশ হয়ে উঠেছে। তেমনই আরও অনেক উল্লেখযোগ্য গানে তাঁর অনবদ‍্য স্প‍্যানিশ-সঙ্গত বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
কিন্তু গজল শিল্পী ভুপিন্দরের মধ‍্যেই যেন আসল ভুপিন্দরকে খুঁজে পাওয়া যেতো। তাঁর কণ্ঠটি যেন গজল গাওয়ার জন‍্যই তৈরি করেছিলেন ঈশ্বর। সিনেমার গানগুলিতেও তিনি বারবার এনেছেন গজলের অসামান্য সেই মেজাজ যা সচরাচর ফিল্মের গানে অনুপস্থিত। শুধুমাত্র এই জন‍্যই সঙ্গীত নক্ষত্রদের আকাশজোড়া ঔজ্জ্বল্যের মাঝেও ভুপিন্দরের গাওয়া গানগুলি মায়াবী আলোর মতো অপূর্ব এক দীপ্তি নিয়ে জেগে থাকে। জেগে থাকে, স্বমহিমায় বেঁচেও থাকে অগণন শ্রোতার হৃদয়ে।

১৯৪০ সালে পঞ্জাবের পাতিয়ালায় জন্ম ভুপিন্দর সিং-এর। দীর্ঘ পাঁচ দশকের বর্ণময় তাঁর সঙ্গীত জীবন।
নাম গুম যায়েগা, চেহেরা ইয়ে বদল যায়েগা, মেরি আওয়াজ হি পহচান হ‍্যায়, যথার্থই গেয়ে গেছেন এই অসামান্য শিল্পী। তাঁর আওয়াজ তো সত‍্যিই যুগ যুগ ধরে থেকে যাবে। এই হিরন্ময় আওয়াজ তো অনির্বান, অমর।

মৌসম, সত্তে পে সত্তা, আহিস্তা আহিস্তা, দুরিয়াঁ, হকিকত এবং আরো বেশ কিছু অবিস্মরণীয় গান তিনি উপহার দিয়ে গেছেন আমাদের। তাঁর বিরল কণ্ঠ ও আশ্চর্য গায়কী দিয়ে কয়েক প্রজন্মের শ্রোতাদের বুঁদ করে রেখেছিলেন এই অসাধারণ শিল্পী।

এক আকেলা ইস শহর মে, গানটিতে নিজেকে খুঁজে পান নি এমন শ্রোতা খুব কমই আছেন। দুঃখ, বেদনা, বিষাদ, অসহায়তা ও বিপন্নতা অতিক্রম করে একা একা পথ চলা, নতুন পথ খোঁজা আর নতুন আশ্রয়ের সন্ধান করতে করতে শেষ পর্যন্ত নিজেই নিজের সাহারা হ’য়ে ওঠার মৃদু আলো যেন ভোরের শিশিরের মতো খেলা করতে থাকে গানের সুরের পদ্মপাতায়।

কী অসাধারন যে গেয়ে গেছেন ‘ করো গে ইয়াদ তো হর বাত ইয়াদ আয়েগি ‘, ভাবা যায় না। বুঁদ করে দেওয়া অলংকারে ঠাসা গমক ও চমকে ভরা মেঘমন্দ্র কণ্ঠ! অমোঘ কথার সঙ্গে তাল রেখে সুর যেন চুঁইয়ে পড়ছে সারাটা গান বেয়ে।

আর, বিতি না বিতায়ে রৈনা?

শ্রাবণের উদাস মেঘের দল যেন বালিকার চোখের জলের মতো থেকে থেকে থেমে থেমে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরতে থাকে স্বপ্ন ভাঙার অব‍্যক্ত বেদনা নিয়ে যা একইসঙ্গে ব‍্যথাকাতর অথচ অপরূপ ঐশ্বর্যময়। ভোলা যায় না ‘ কভি কিসিকো মুকম্মল জাহাঁ নেহি মিলতা… ‘।

‘ কবে যে কোথায় কী যে হলো ভুল ‘ শুনলেই মনে হয় বাংলা গজলের এক অপরূপ শৈলী হয়ে ওঠার সমস্ত সম্ভাবনা নিহিত আছে এই গানটিতে। অথচ এটি বাংলা ছায়াছবির গান। আসলে ভুপিন্দর সাহেবের বিরল দানাদার কণ্ঠ আর বৈচিত্র্যময় মেজাজ গানটিকে অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। এভাবেই বেঁচে থাকেন ভুপিন্দরের মতো জাত শিল্পীরা।

আরও পড়ুন- জয় হিন্দ বাহিনীর উদ্যোগে উত্তর কলকাতায় ঘুরে ঘুরে ঘুড়ি বিতরণ

Previous articleBreakfast news : ব্রেকফাস্ট নিউজ
Next articleএখনও আশঙ্কাজনক গ্যাস বেলুন ফেটে আহত কৌতুক শিল্পী আবু হেনা রনি