দেবী পীঠ কি সত্যিই একান্ন? বিশেষ প্রতিবেদন

গবেষকদের একাংশ মনে করছেন যে পীঠের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথমেই তন্ত্র সার গ্রন্থের মূল চারটি পীঠের কথা জানা যায়। এই চারটি পীঠ হলো জালন্ধর, উদ্দীয়ান, পূর্ণগিরি ও কামরূপ। কালিকাপুরাণে চতুষ্পীঠের বর্ণনা রয়েছে।

সায়নজিৎ ভৌমিক

আমরা কালীপুজোর (Kali Puja) ঠিক আগেই বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে (TV Channel) বিশেষ সম্প্রচারে দেবীর (সতীর) ৫১ পিঠের নানান মাহাত্ম্য কথা শুনে থাকি। কিন্তু কোনোদিন ভেবে দেখেছেন ৫১টাই পীঠ কেন? ‘পীঠ’ কথাটির সাধারণ অর্থ হল আসন। দেবী যেখানে বিশেষভাবে বিরাজমান এইখানেই তাঁর পীঠ। ভারতবর্ষে সাধারণভাবে ৫১টি পীঠের কথা বলা হলেও, বিভিন্ন আধ্যাত্মিক সাহিত্য অনুসারে পীঠের সংখ্যা বিভিন্ন রকমের। পীঠনির্ণয় অনুসারে ৫১, শিবচরিতে ৫১ পীঠ, কুবজিকাতন্ত্রে পীঠ সংখ্যা ৪২ ও জ্ঞানার্নবতন্ত্রে ৫০ টি পীঠের কথা বর্ণনা করা আছে।

গ্রন্থানুসারে পীঠের সংখ্যা ভিন্ন কেন তা স্পষ্টভাবে জানা সম্ভব না। তবে গবেষকদের একাংশ মনে করছেন যে পীঠের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথমেই তন্ত্র সার গ্রন্থের মূল চারটি পীঠের কথা জানা যায়। এই চারটি পীঠ হলো জালন্ধর, উদ্দীয়ান, পূর্ণগিরি ও কামরূপ। কালিকাপুরাণে চতুষ্পীঠের বর্ণনা রয়েছে। দেবী কাত্যায়নীর অধিষ্ঠানক্ষেত্র ওড্রা, চণ্ডীর জালশৈল, পূর্নেশ্বরীর পুর্ণশৈল এবং দেবী কামেশ্বরীর ক্ষেত্র কামরূপ। কিন্তু এই পুরাণেরই অষ্টাদশ অধ্যায়ে পীঠসংখা বেড়ে ৭ করা হয়।

যাই হোক, সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, দেবীপীঠ যে দেবীর দেহাংশ পতনের ফলেই গড়ে উঠেছিল এই তত্ত্ব প্রথমে জানতে পারা যায় ষোড়শ শতাব্দীর আইন-ই-আকবরী থেকে। পরে বিভিন্ন সাহিত্যে এই তত্ত্বকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ঠিক এই জন্যই গবেষকদের মতে সতীদেহের অংশ থেকে পীঠ গড়ে ওঠার বিষয়টি পীঠস্থানের উৎপত্তির অনেক পরে সংযোজিত হয়েছে।

এই ৫১টি সতীপীঠের ব্যাখ্যা আবার দুই ভাবে সম্ভব। এক, আধ্যাত্বিক এবং দুই, সামাজিক। ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে ‘কাজ’ এবং ‘ভাব’ – এই দুই হলো মূল। তবে বলাই বাহুল্য আধ্যাত্বিক প্রসঙ্গে ভারতীয় সমাজ প্রতিটি কাজের মধ্যে একটি ভাবকে আরোপ করতে স্বচ্ছন্দ ও তৃপ্তি বোধ করেন। তাই ভাবগত দিক থেকে পীঠস্থানের কিছু মূল্য থেকেই যায়। হিন্দু শাস্ত্র সতী অঙ্গ থেকে ৫১ পীঠের উদ্ভবের তত্ত্ব প্রসঙ্গে একটি ব্যাখ্যা দান করেছে। সেই মত অনুযায়ী এই তত্ত্ব সৃষ্টির পিছনে ‘শিব’ ও ‘শক্তি’ – এই দুটি ক্ষেত্র কাজ করে। শিব ও শক্তির একত্রিত প্রয়াসে সৃষ্টি হয় অনাহত নাদ। আবার এই নাদ থেকে ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয় ৫১টি বর্ণ। যা আমরা শব্দব্রহ্ম বলে চিহ্নিত করে থাকি। সতীর একান্নপীঠ হলো এই একান্নটি বর্ণের প্রতীক।

যারা পৌরাণিক কাহিনীতে অবিশ্বাস করেন কিংবা যুক্তিবাদী মনের একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন, সতীর দেহের একান্নটি টুকরো শুধুমাত্র ভারতবর্ষেই পড়ল? ভারতবর্ষের বাইরে নয় কেন? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ভারতীয় তীর্থ সম্বন্ধে ভগিনী নিবেদিতার একটি উল্লেযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলতেই হয়। তার মতে এই তীর্থগুলো আধ্যাত্বিক ফলদানের সঙ্গে একটি সামাজিক ফলও দান করে। তীর্থগুলি ভারতের ঐক্য ও জাতীয়তাবোধকে ত্বরান্বিত করে। প্রাচীন ভারতের সমাজ পরিচালকেরা ধর্মের মাধ্যমে জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করার চেষ্টা করে গেছেন। বৈচিত্রের ভারতে তীর্থ যাত্রীদের মাধ্যমে সংস্কৃতির আদান – প্রদানই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। এককথায় এটা বলা যায়, সামাজিক গঠনে সভ্যতার প্রসার। সতীপীঠ গুলি ভারতে গড়ে ওঠার কারণ হয়ত তাই।

কিন্তু শুনলে অবাক হবেন এই সতীর একান্নপীঠ শুধুমাত্র ভারতবর্ষের সংস্কৃতির একটি অংশ নয়, সংস্কৃতির বিশ্বায়নও বটে। আপনারা অনেকেই মিশরের প্রিয় দেবতা ওসিরিজ (Osiris)- এর নাম শুনে থাকবেন। কিন্তু জানেন কি? এর বাহন ষাঁড়, পরনে বাঘছাল, মাথার ভূষণ সাপ এবং শিবের ত্রিশূলের মতোই হতে দন্ডধারী। কি অবাক হচ্ছেন নাকি? দাঁড়ান তবে রোমাঞ্চ এখনও বাকি।

কথিত আছে ঈর্ষাজনিত কারণে ওসিরিজের ভাই সেট, ওসিরিজকে হত্যা করেন এবং নীল নদের জলে ভাসিয়ে দেন। ওসিরিজের স্ত্রী দেবী আইসিস স্বামীকে খুঁজতে খুঁজতে নীল নদীর ধারে খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু সেট সেই মৃতদেহ আইসিসের থেকে ছিনিয়ে নিয়ে টুকরো করে মিশরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেন। যে যে স্থানে ওসিরিজের দেহাংশ পড়েছিল সেই সেই স্থানে সৃষ্টি হয় তীর্থের। এবার প্রশ্ন হল, এই কাহিনীর জন্ম কোথায়? ভারতে না মিশরে? দুই দেশের বাণিজ্যগত কারণে জাহাজের সাথে দক্ষযজ্ঞের কাহিনী বণিক মারফত কোনও এক দেশ থেকে ভিনদেশে পৌঁছে যায়নি তো? কে বলতে পারে? তাই ভারতীয় সংস্কৃতি আজও বিশ্বজুড়ে চর্চার বিষয়।

Previous articleদীপাবলিতে শোকের ছায়া, প্রয়াত জাতীয় পুরস্কারজয়ী চিত্র পরিচালক পিনাকী চৌধুরী
Next articleকালীপুজোয় কালী সেজে ধর্মতলায় অভিনব ধরনা প্রাইমারি টেট উত্তীর্ণদের