চিরপিপাসিত ‘শ‍্যামা’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

ইন্দ্রমণির হার। এনেছে বজ্রসেন সুবর্ণদ্বীপ থেকে। কার গলায় পরাবে সে অমূল্য ‘ হার মানা হার ‘? শ‍্যামার? কিন্তু কোথায় সে রাজনর্তকী? বজ্রসেন কি নগর কোটালের চরেদের শ‍্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে পালাতে পারবে? কার জন‍্য প্রাণ দিলো উত্তীয়? তার এই প্রাণ বলিদান কি সার্থক হয়ে উঠলো? তার মৃত্যুর জন‍্য দায়ী কে? শ‍্যামা? বজ্রসেন কি শ‍্যামার প্রতি ক্ষমাসুন্দর হয়ে উঠতে পারলো? শেষ পর্যন্ত কী হলো শ‍্যামার?

‘ প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা। ‘

১৯৩৯ সালে রচিত রবি ঠাকুরের ‘শ‍্যামা’ নৃত্যনাট‍্যের অভিনয় হয়েছে অসংখ্যবার দেশ-বিদেশের নানা মঞ্চে। আজও বছরের পর বছর হয়ে চলেছে বিরামহীন ভাবে। গল্পটাও সবাই জানে। তবুও বারবার প্রেক্ষাগৃহ ভরে যায় শ‍্যামা নামের জাদুতে। কী আছে শ‍্যামায়, যার আকর্ষণ এমন অমোঘ ও শাশ্বত? অতৃপ্ত প্রেম ও চিরবিরহের সাধনা নিয়ে বিশ্বসাহিত‍্যে গল্প, উপন‍্যাস ও নাটক তো কম লেখা হয় নি। তাহলে?

‘ শ‍্যামা’-র গানগুলোর দিকে তাকানো যাক। গানগুলিতে কাফি, বেহাগ, বাহার, কেদার, বিভাস ( বাংলা ), মালকোষ, খাম্বাজ, ভৈরব, বৃন্দাবনী সারং, দেশ ইত্যাদি রাগরাগিনী ব‍্যবহৃত হয়েছে। এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কীর্তন ও লোকগানের শাশ্বত ধারা। স্বর ব‍্যবহারে কোথাও বা পশ্চিমের ছোঁয়া। ছন্দে ও চলনেও। প্রাচ‍্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের অনবদ‍্য মিশেলের রহস্য জানতেন রবীন্দ্রনাথ। শাস্ত্রীয় ও লোকগান আধারিত এই গানগুলি কিন্তু শাস্ত্রকে সম্পূর্ণ আড়ালে রেখে আধুনিকতায় ও মৌলিকত্বে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল। এখানেই অনন‍্য রবি ঠাকুরের ‘ শ‍্যামা ‘। আবার, ‘ সুন্দরের বন্ধন ‘, ‘ প্রেমের জোয়ারে ‘ ইত্যাদি গানে তীব্র দাবদাহে হঠাৎ আসা একঝলক ঠাণ্ডা হাওয়ার মতো দেখা দিয়ে যান মহামহিম বাখ্, বেটোফেন ও মোজার্ট সাহেব। শ‍্যামার গান তো অমৃতসমান। এছাড়াও মঞ্চসজ্জা, আলো, পোশাক, আবহ ও নৃত্যাভিনয়ের প্রতিটি স্তরে রয়েছে সৃজন সম্ভাবনার হাজার দুয়ার।

‘ শ‍্যামা’-র বিষয়বস্তু নির্মিত হয়েছে উত্তর আধুনিকতার সমস্ত পথ খোলা রেখে। সময়কাল যদি আপনি বৌদ্ধযুগের শেষ অবশিষ্টাংশ থেকে আজকের এই ২০২২-এ এনে ফেলতে চান কোনো বাধা নেই। ঘটনাস্থল ও পটভূমিতে যদি আপনি কাশির কায়ার সঙ্গে কলকাতার ছায়া মেশান তাহলে টাইম-মেশিনের নাগরদোলা বরং কাঙ্খিত গতি পাবে। মঞ্চসজ্জায় আপনি খাপ পঞ্চায়েত থেকে কোর্টমার্শাল, এমনকি কারাগার ছুঁয়ে আদি রাজসভায় খাদির পোশাকে ঢুকলেও কেউ প্রশ্ন তুলবে না।

পোশাকের কথা যখন এলোই তখন মনে রাখতেই হয় যে সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত আবরণ ও আভরণের জৌলুসে চিরকালের দলিত ও হরিজন সম্প্রদায়ের পোশাক তথা সংস্কৃতির আদি উপাখ‍্যান যেন ভুলে না যাওয়া হয়।

আর, আলো? ‘ আলো আমার আলো ‘? এখানেও অমিত সম্ভাবনার হাজারদুয়ারী।
আলো কখনো বজ্রসেন, কখনো শ‍্যামা, আবার কখনও বা উত্তীয়র হয়ে কথা বলবে। প্রেমের উদ্ভাসে উচ্ছল ও উজ্জ্বল ছটা পরমুহূর্তেই বিষন্ন ম্রিয়মানতায় বিবর্ণ ধূসর কিরণে চির-বিচ্ছেদ জর্জর মজ্জা। হে মহামহিম তাপস সেন, আলোর সরঞ্জাম প্রস্তুত, আপনি কোথায়?
প্রিয় খালেদ চৌধুরী, মঞ্চ সাজাচ্ছি আমরা, আপনাকে যে খুব দরকার আমাদের।

বাকি রইলো নৃত্যাভিনয় ও আবহ। এই সেই আশ্চর্য পটভূমি যেখানে প্রকৃতই
‘ নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু ‘।
এ কি শুধু নাচ? শুধু শুকনো ব‍্যাকরণ আর আর মুদ্রা প্রদর্শন? শুধুই অভিনয় আর শরীরী বিভঙ্গ? গোটা ব‍্যাপারটা আত্তীকরণ করলে সত‍্যিই পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে। এ তো শুধু ‘ উপজ ‘ আর ‘ আওচার ‘ দিয়ে ঘেরা সহজ উঠোন নয়।

কথাকলি, কত্থক, ওডিশি, কুচিপুডি, মণিপুরী কিংবা সৃজনশীল নৃত্যের ধরাবাঁধা সিলেবাসও নয়। একটা নয়, দুটো নয়, তিন- তিনটে তরতাজা জীবন একেবারে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার এক ভয়াবহ করুণ পরিণতির
নৃত্যাভিনয়! সহজ-সম্ভব?

আনন্দধারায় পরিপ্লাবিত প্রাণের উচ্ছাস হঠাৎই গতি হারিয়ে ম্লান, বিবর্ণ ও পাংশু মুখে যখন এসে দাঁড়ায়’ মৃত্যু ‘ নামক কৃষ্ণগহ্বরের দরজায়,তখন অনাদিকালের বিরহবেদনায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় পরাজিত প্রেম আর চিরকালের রক্তমাখা চোখের জল।
কোন্ আবহ দিয়ে ধরা যাবে এই সমবেত অন্তর্লীন দাহকে?

আসলে শ‍্যামায় লুকিয়ে আছে চিরপিপাসিত বাসনা বেদনার সেই আলো-আঁধারি যা চেপে রাখা অন্তহীন কান্নার মতো গভীর গোপনে রয়ে যায় হৃদয়ের স্তরেস্তরে। তাই শ‍্যামাকে বারবার নতুন করে আবিষ্কারের মাঝেও সংশয় থেকেই যায় যে এই নৃত্যনাট‍্যের সিগনেচার টিউন কি ঠিকঠাক ধরতে পারবে বিপুল অন্ধকারে ধ্রুবতারার মতো একা জেগে থাকা শ্রীমান উত্তীয়কে? আকাশভরা সূর্য তারা ও বিশ্বভরা প্রাণের মাঝেও ‘শ‍্যামা’-র সমন্বয়-সঙ্গীতটি সঠিকভাবে রচনা করে নেওয়া যাবে কি সূচনায়? একাধিক সুরযন্ত্র ও বাদ‍্যযন্ত্রের সঘন-গহন মিতালি কি পারবে বজ্রসেনের প্রেমিকসত্বার তীব্র আনন্দ ও অনন্ত হাহাকারকে চিত্রায়িত করতে?

আর শ‍্যামা? তুমি কাঁদো। যত পারো কেঁদে যাও তুমি অনন্তকাল। অসীম ছেয়ে থাকা তোমার মর্মবেদনার অতলে কোনোদিন পৌঁছবে না কোনো তৃষিত হৃদয়। সারা পৃথিবীর বুকভরা সহানুভূতি ও সমবেদনা পেয়েও তুমি একা, সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ। কেন না তুমি বেশ জানো সমবেদনার আড়ালে তোমার জন‍্য আসলে রয়ে গেছে তথাকথিত সভ‍্য সমাজের নিন্দাপঙ্ক, যেখানে একগলা জলে চিরকাল ডুবে থাকতে হবে তোমাকে।
ও শ‍্যামা, তোমার যন্ত্রণার ভাষা কেউ বুঝবে না গো, তোমার অন্তরের কথা কেউ শুনবে না। কাঁটার মুকুট প’রে রক্তাক্ত শরীরে ও মনে চিরকাল নরকযন্ত্রনা ভোগ করো তুমি প্রেমহীন এই বিশ্বসংসারে।

আরও পড়ুন- ‘বঙ্গভঙ্গ চাই না’, বিজেপির বিভাজননীতির বিরোধীতায় হাজার কিমি হাঁটবে তৃণমূল