‘আমি এখনো ম.রিনি’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

” দু’জন খসখসে সবুজ উর্দি পরা সিপাহী কবিকে নিয়ে গেল টানতে টানতে ।
কবি প্রশ্ন করলেন : আমার হাতে শিকল বেঁধেছো কেন ?
সিপাহী দু’জন উত্তর দিল না ;
সিপাহী দুজনেরই জিভ কাটা।”

একজন কবিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো । কবির নাম লোরকা , যিনি ঘুমিয়ে আছেন দক্ষিণ গ্রেনাডায় । সত্যিই কি দক্ষিণ গ্রেনাডায় শুয়ে আছেন কবি ? কবির মৃত্যুরহস্য আজও কি উদঘাটিত হয়েছে ? কবি ও নাট্যকার লোরকা ১৯৩৬সালের ১৮ আগস্ট স্পেনীয় গৃহযুদ্ধের প্রথম দিকে গ্রেপ্তার হন । ধারণা করা হয় আরও অনেকের সঙ্গে পরের দিন ১৯ আগস্ট ফ্রাঙ্কোর ঘাতক বাহিনীর গুলিতে তিনি নিহত হন । লোরকার লাশ খুঁজে পাওয়া যায় নি । মৃত্যুময় এই রাতে নিহত হওয়ার মুহূর্তে কবির গায়ে ছিল সাদা প্যান্ট ও ব্লেজার । স্পেনের গ্রেনাডা শহরের বাইরের ছোট ছোট উপত্যকাগুলির কাছাকাছি ভিজনার আর অ্যালফাকার শহরের সংযোগস্থলে একটি মাটির রাস্তায় ঘাতকদের গাড়ি এসে ঘুটঘুটে অন্ধকারে নামিয়ে দেয় লোরকা সহ আরও তিনজন বন্দীকে । সেই বন্দীদের একজন প্রবীন স্কুলশিক্ষক , যাঁর একটি পা কাঠের তৈরি । বাকি দুজন বিদ্রোহী বুল ফাইটার । চারজন বন্দীই জানতেন তাঁদের হত্যা করা হবে ।

স্প্যানিশ কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা স্বৈরাচারী শক্তির হাতে নিহত হয়েছিলেন । তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৮ । গণতন্ত্রকামী তরুণ প্রজন্মের নিধনযজ্ঞে লোরকার মতো প্রগতিশীলদেরও খুন করা হয়েছিল । ঘাতক বাহিনীর জেনারেলরা বিশ্বাস করতেন : ‘ এই লোকটি ( লোরকা ) শুধু কলম দিয়েই আমাদের যে ক্ষতি করেছে , তা অস্ত্র দিয়েও করা সম্ভব নয় । ‘

লোরকার জন্ম ১৮৯৮ সালে গ্রেনাডার নিকটবর্তী একটি গ্রামের বেশ অবস্থাপন্ন পরিবারে । তিনি ছিলেন একাধারে সঙ্গীতজ্ঞ , নাট্যকার এবং নুতন ধারার কবি । পাবলো নেরুদা , সালভাদোর দালি , লুই বুনুয়েল প্রমুখের নাম লোরকার প্রসঙ্গ এলে আসবেই । নিজের মধ্য তিরিশেই লোরকা হয়ে ওঠেন তৎকালীন স্প্যানিশ সাহিত্যের জীবিত লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় । নিজের সমসাময়িক সাহিত্যিকদের এবং তরুণ প্রজন্মের লেখকদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্প্যানিশ কবিতায় সমগ্র ইউরোপের শৈল্পিক চেতনার সঙ্গে স্পেনের পল্লিসংস্কৃতির অভূতপূর্ব এক সম্মিলন ঘটান লোরকা , বিশেষ করে নিজের জন্মস্থান আন্দালুসিয়ার পল্লিসংস্কৃতির সঙ্গে সেখানকার জিপসি প্রভাবের মে সম্মিলন তিনি ঘটিয়েছিলেন তা এককথায় যুগান্তকারী ।‌ লোরকার স্মৃতিচারণায় চিলির প্রখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা লেখেন : ‘ মাধুর্য , প্রতিভা , বিশুদ্ধ হৃদয় আর স্ফটিকস্বচ্ছ জলপ্রপাতের মতো মননের ‌এমন সমাহার আমি আর কোনো মানুষের মধ্যে দেখি নি । ‘
অথচ যে দেশের আলো-বাতাসে তিনি বেড়ে উঠেছেন সেই স্পেনেই তিনি ব্রাত্য হয়ে ‌পড়েছিলেন । তবে তারপরেও মৃত্যুকাল অবধি তাঁর স্বদেশ ও স্বজাতির শিকড় সন্ধান থেকে তিনি কখনও সরে আসেন নি । স্পেনের অন্ধকারতম প্রবৃত্তিগুলোর অনুসন্ধান তিনি চালিয়ে যান আজীবন । লোরকা বলেছিলেন , ‘ পৃথিবীর আর সব জায়গায় মৃত্যুই শেষকথা । মৃত্যু আসে , পর্দা নামে , কিন্তু স্পেনের বিষয়টি ভিন্ন । এখানে বরং মৃত্যু সব পর্দা , সব আড়াল সরিয়ে দিয়ে সবকিছু দৃশ্যমান করে তোলে । তিনি স্পেনের ঐতিহ্যবাহী বুলফাইটের সঙ্গে মৃত্যুর প্রতি মানুষের আত্মঘাতী আকর্ষণের যোগসূত্র খুঁজে বের করেছিলেন । তিনি লেখেন ,
‘ স্পেন একমাত্র দেশ , যেখানে মৃত্যু বিষয়টি জাতীয়ভাবে সমস্ত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু । এটিই একমাত্র দেশ , যেখানে বসন্তের আগমনকালে ডঙ্কারের দীর্ঘায়ু সুরে মৃত্যুকে স্বাগত জানানো হয় । আর আশ্চর্যের কথা পুঁজিবাদী , জাতীয়তাবাদী , রাজতন্ত্র তথা ধনতন্ত্রকামীদের ভয়ঙ্কর যে জোটশক্তির হাতে নিহত হন লোরকা , তাদের রণহুংকার ছিল , ‘ মৃত্যু দীর্ঘজীবী হোক ‘ । ‘

” তবু হায়
তীরন্দাজের দল
ভালবাসার মতোই তারা দৃষ্টিহীন । ”
লোরকার ‘ বুক অফ পোয়েমস ‘ , ‘ পোয়েম অফ দ্য ডিপ সংস্ ‘

এবং ‘ সিলেক্টেড পোয়েমস অফ ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা ‘ সম্ভবত বাঙালি পাঠকবৃন্দের পড়া ।
” যে গন্ধে যীশু মাতোয়ারা হন এবং শয়তানও
বল সেই সুগন্ধী গোলাপ কোথায় ? ”

” জানোই তো
তোমার ধূসর তরবারি
বিঁধবে না দিকচক্রবাল ,
পাহাড় তখন ঢাল হবে । ”
বুলেটে ঝাঁঝরা কবি লোরকার মৃতদেহ কোথায় আছে কেউ জানে না আজও ।‌ কিন্তু তার লেখাগুলি আজও জীবন্ত ।

” গাছ !
তোমরা কি কোনদিন
আকাশের নীল থেকে মাটিতে বিদ্ধ হয়েছিলে ?
কার সেই প্রবল গাণ্ডীব
তোমাদের গেঁথে দিয়ে গেল ?
আকাশের তারা নাকি সে ? ”

লোরকা চাইলেই কলম্বিয়া কিংবা মেক্সিকোয় রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে পারতেন , অথবা চলে যেতে পারতেন অন্য কোনো দেশে । তাহলে তিনি প্রাণে বাঁচতে পারতেন । তিনি যে শত্রুদের হাতে খুন হবেন , তাঁকে যে অচিরেই হত্যা করা হবে , সেই কথা তিনি লিখেও গেছেন । কিন্তু আপসহীন অকুতোভয় লোরকা স্বদেশ ত্যাগ করে পালিয়ে বাঁচতে চান নি । নিজের মর্মান্তিক পরিণতির কথা আগাম টের পাওয়া সত্ত্বেও নিজের নৈতিক অবস্থান থেকে সরে যান নি ।

স্বদেশ ও স্বজাতির শিকড় সন্ধান , নাগরিক যন্ত্রণা , ধর্মীয় বিশ্বাস , একাকীত্ব , প্রতিবাদ , জীবন সংগ্রাম ও প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ লোরকার কবিতায় গানের সুরের মতো বেজে উঠেছে বারবার । সুর অসীমের মতো ছেয়ে ছিল কবির মনে ও প্রাণে ।

একটি তেলাপোকার সঙ্গে একটি প্রজাপতির হলো ভালবাসা ; এই ছিল লোরকার লেখা একটি নাটকের বিষয়বস্তু । যা তাঁর সমকালে আলোড়ন তুলেছিল । প্রচলিত ঘরানার বাইরে পা ফেলা এই নাটকটি মঞ্চস্থ হয় ১৯২০ সালে । নাটকের নাম ‘ মালেফিসিও দে লা মারিপোসা ‘ বা ‘ প্রজাপতির দুরভিসন্ধি ‘ ।

ঘাতক বাহিনী তথা দেশের শত্রুদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা ক’রে বুর্জোয়া ধনতন্ত্রকামীদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ সংগঠিত করার জরুরি কাজ থেকে কখনও বিচ্যূত হন নি এই মানবতাবাদী কবি ও নাট্যকার । কেন হত্যা করা হয় কবিকে ? কারণ, ক্ষমতাবান অপশক্তি ভয় পায় মানবতার আদর্শে উজ্জীবিত কবির ক্ষুরধার কলমকে এবং কবির হৃদয় থেকে উৎসারিত অগ্নিস্ফুলিঙ্গকে ।
” ঘুম দেব আমি একমুহুর্ত
একমুহুর্ত , এক মিনিট ,
এক শতাব্দী
কিন্তু সবাই জেনে রেখো ,
আমি এখনো মরিনি । ”

আরও পড়ুন- পড়ুয়াদের আ.তঙ্ক কাটাতে ভাঙা হল বাহনাগা হাইস্কুল, তৈরি হতে চলেছে মডেল স্কুল 

Previous articleমোদি সরকারের বিরুদ্ধে পথে কেজরিওয়াল! রামলীলা ময়দানে ‘মহা সমাবেশ’ আপের
Next articleবেপ.রোয়া গতির জের! পিক আপ ভ্যানের সঙ্গে বাসের মুখোমুখি সং.ঘর্ষে আ.হত ২২