এক “বিরল” বাস কন্ডাক্টারের গল্প, যা আপনাকে ভাবাবে

সম্প্রতি একজন মানুষের খোঁজ পেলাম সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে। যিনি বাস কন্ডাক্টার। বলা ভালো একজন "বিরল" বাস কন্ডাক্টর

সোমনাথ বিশ্বাস:সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রতিটা পেশায় ভালো-মন্দের মিশেল। এই যেমন রাস্তাঘাটে মাঝেমধ্যেই শোনা যায় কোনও এক বাস কন্ডাক্টারের সঙ্গে কিছু যাত্রীর তর্কাতর্কি, তুমুল ঝগড়া। দোষে-গুণে মানুষ, দোষ হয়তো উভয়ের থাকে! আমাদের একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি আছে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে। আমরা সর্বক্ষেত্রে যেন ব্যতিক্রম ও নেতিবাচক দিকটি বেশি বেশি খোঁজার চেষ্টা করি। সেটা নিয়ে রসালো আলোচনা করি। আসলে মজা পাই। এই যেমন বাংলা সিরিয়ালে দেখবেন শ্বাশুড়ি -বউয়ের ঝগড়ায় আমাদের খুব ইন্টারেস্ট!!! তেমনই একজন বাস কন্ডাক্টারকে তাঁর ভুলের জন্য যদি কিছু যাত্রী উত্তম-মধ্যম দেয়, সেটা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করি। আসলে আমরা শুরু থেকেই একটা বিভাজন করে ফেলি। হয়তো আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি অজান্তেই একটা বিভাজন শিখিয়ে দেয়। আমরা যেন ধরেই নিয়েছি, শ্বাশুড়ি-বউ মানেই একটা চুলোচুলি সম্পর্ক। কিন্তু এই সম্পর্ক যে মা-মেয়ের হতে পারে, সেটা আমরা ভাবতে বা মানতে চাই না। কারণ, সেটা ভেবে আমরা আমরা মজা পাই না। আবার বাস কন্ডাক্টার মানেই অশিক্ষিত, মূর্খ, বখাটে, লম্পট। ওকে মেরেছে ঠিক করেছে, আমি হলে তো মেরে আবার পুলিশে দিয়ে দিতাম। লোকগুলো ভালো বলে ছেড়ে দিল। যেন এসব ভেবে আমরা একটা পৈশাচিক আনন্দ পাই।

আরও পড়ুন:ঠাকুরপুকুরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উলটে গেল পুলকার, আহ*ত ২ স্কুলপড়ুয়া

নেতিবাচক মানসিকতা আর এই শ্রেণীবিভাজনের মধ্যে সম্প্রতি একজন মানুষের খোঁজ পেলাম সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে। যিনি বাস কন্ডাক্টার। বলা ভালো একজন “বিরল” বাস কন্ডাক্টর। আজ তার গল্প শোনাবো। করুণাময়ী টু যাদবপুর এইট বি। বাইপাস হয়ে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ রুট। এই রুটের একটি পরিচিত বাস এসি-নাইন। আর গল্পের শুরুটা সেখান থেকেই। গোটা রুটে ওই বাস কন্ডাক্টরের উচ্চস্বরে আবেদন প্রতিদিন নজরকাড়ে যাত্রীদের। বাস কন্ডাক্টর তো নয়, যেন একজন পেশাদার গাইড। অত‍্যন্ত বিনয়ী ভাবে যাত্রীদের উদ্দেশ্যে কোন কোন এলাকার জন‍্য পরের স্টপেজে নামতে হবে তার বিস্তারিত বিবরণ। তাঁর বলার ভঙ্গিমা রীতিমতো বিনোদনের রসদ। তাড়িতে তাড়িতে উপভোগ করেন যাত্রীরাও।

যাত্রীদের মধ্যে অনেককেই বললেন, জীবনে তো কতো বাসে তাঁরা চেপেছেন। কন্ডাক্টরদের কতো আচার-আচরণ প্রত‍্যক্ষ করেছেন, কিন্তু এই তন্ময় মাহাতো তো একেবারেই আলাদা। প্রতিটা স্টপেজ আসার আগের তার গাইড সুলভ বিবরণে মনে হচ্ছিল সকলে কোথাও যেন ভ্রমনে বেরিয়েছে এবং গাইড এক একটা এলাকার সঙ্গে যাত্রীদের গড়গড় করে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। সাক্ষাৎকার পর্বে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন এমন স্টাইল? এতো মাথা বকিয়ে এক্সট্রা কিছু উপার্জন হয় নাকি? মৃদু হেসে তন্ময়ের অকপট উত্তর, “আমি গ্রামের ছেলে। প্রথম যখন কলকাতায় চাকরির খোঁজে এসেছিলাম রাস্তাঘাট চিনতাম না। একে-ওকে ঠিকানা জিজ্ঞাসা করতাম। কেউ বলতে পারতেন, কেউ পারতেন না। আমার বাসে আমার মতো কত মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করেন। যাঁরা শহরটাকে চেনেন না। তাঁদের জন্য এটুকু আমাকে করতেই হয়।”

অবাক হয়ে শুনলাম। অবশেষে ঘন্টাখানেকের যাত্রা শেষে করুনাময়ী থেকে যাদবপুর এসে গেল বাস। সকল যাত্রীকে নামতে অনুরোধ করে, যাত্রাকালীন কোনও ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকলে তার জন‍্য করজোড়ে মার্জনা প্রার্থনা করে সকলকে শেষ গন্তব্যে নামালেন। বয়স্ক ও শিশুদের নামতে সাহায্য করলেন। অল্পবয়সী অনেক প্যাসেঞ্জার আবার স্মৃতির সরণিতে তন্ময়কে জায়গা দিতে সেলফিও তুললেন। আর নিজের কর্তব্যে অবিচল বাস কন্ডাক্টার তন্ময় পরবর্তী ট্রিপের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন…!

তন্ময় কোনও ব্যতিক্রম বাস কন্ডাক্টর কিনা জানি না। কিন্তু একটা বিষয়ে নিশ্চিত, পেশাগত শ্রেণিবিভাজন দিয়ে মানুষকে বিচার না করাই ভালো, তাহলে আমার-আপনার মনুষ্যত্ব নিয়েই একদিন প্রশ্ন উঠবে। সব পেশার মধ্যে এমন তন্ময়রা লুকিয়ে আছেন। এবং এই সমাজে তন্ময়দের সংখ্যাটাই বেশি। তাই এখনও সমাজটা এতো সুন্দর।

Previous articleঠাকুরপুকুরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উলটে গেল পুলকার, আহ*ত ২ স্কুলপড়ুয়া
Next articleনে*শার আসর, র‌্যা*গিং সব জেনেও কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয়নি কখনও,বিস্ফোরক সুপার