কে থামায় কাকে, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

কে থামাবে নাচ ?
মেতেছে নটরাজ !

মায়াবী রাত । মঞ্চে নৃত্যরত শিল্পী । নাচের অপরূপ ছন্দে যেন দুলছে জন্ম-মৃত্যু , সমগ্র চরাচর । সহসা সবাইকে চমকে দিয়ে মঞ্চে উঠে পড়লো একদল দুষ্কৃতী । প্রথমে শিল্পীর দুটো হাত কেটে ফেললো তারা । তবু নাচ থামলো না । তারপর কাটলো দুটো পা । তাতেও নড়তে লাগলো মঞ্চে পড়ে থাকা ধড়সহ মাথা । এবার বিচ্ছিন্ন করা হলো ধড় ও মাথা । মঞ্চ জুড়ে রক্তের বিছানায় পড়ে রইলো কাটা মুণ্ডু , ধড় এবং কাটা হাত ও পায়ের টুকরোগুলো । কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলো তাতা থৈ । আর তারপর , কী আশ্চর্য ! নড়ে উঠলো একটা কাটা হাত। নাচের ছন্দে দুলতে লাগলো । তারপর একে একে সবকটা বিচ্ছিন্ন অঙ্গ নানা ভঙ্গিতে , নানা মুদ্রায় দুলতে লাগলো । যেন নতুনভাবে নতুনরূপে শুরু হলো নাচ । যেন একটা ভয়ঙ্কর দু্ঃস্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠলো পৃথিবী ।

রোমহর্ষক এই নৃত্যায়নের স্রষ্টা বিশ্ববিশ্রুত মাইকেল জ্যাকসন। নাচের দৃশ্যায়নে তিনি যা মূর্ত করেছেন , তা বাস্তবে অসম্ভব । কিন্তু এই বিষয়বস্তু থেকে যেটি শেখার , তা হলো , শিল্পীর মৃত্যু আছে কিন্তু শিল্প মৃত্যুহীন। জীবনব্যাপী শিল্পসাধনায় নিমগ্ন একজন শিল্পীর রক্তে , অস্থিমজ্জায় , শিরা-উপশিরায় , কোষে কোষে অর্থাৎ সমগ্র অস্তিত্বে মিলেমিশে একাকার হয়ে ওঠে শিল্পকলা । তাই শিল্পীকে থামিয়ে দেওয়া গেলেও শিল্পকে থামানো যায় না । শিল্পীর শিল্পবোধ এবং শিল্পস্বত্বা অনির্বাণ ।

পরাবাস্তব , মায়াবাস্তব থেকে অতিবাস্তবে ফেরা যাক ।‌ বাস্তবেও এমন নানা ঘটনা ঘটে , বুদ্ধি দিয়ে যার ব্যাখ্যা করা যায় না । আসলে কোনও একটি শিল্প নিয়ে দিনরাত পড়ে থাকলে , মানে সেই নির্দিষ্ট শিল্পটি নিয়ে চর্চা ও অনুশীলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোলে সেই শিল্পটি শিল্পীর শরীরে ঢুকে যায় । চৈতন্য অচৈতন্য সব পার ক’রে ঘিরে থাকে ।‌ সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে বিরাজ করে ঘুমে ও জাগরণে । শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলতেন , যখন লিখি তখন একটা ঘোরের মধ্যে থাকি , লেখার ঘোর লাগে ।‌ ঘোর ভেঙে গেলে লেখা থেমে যায় ।
এ এক আশ্চর্য ঘোর যা বোধের অতীত ।

এমনই আরেক ঘটনার কথা লিখেছেন বাংলা সাহিত্যের এক বিখ্যাত লেখিকা । ঘটনাটি শুনিয়েছেন তবলিয়া সুরেশ তলওয়ালকর । সুরেশ ছিলেন কিংবদন্তি তবলা শিল্পী উস্তাদ আল্লারাখা খান কুরেশীর শিষ্য । একদিন তিনি গুরুর কাছে গেছেন সারাদিন ধরে গুরুসেবা করবেন বলে । গুরুকে রেঁধে বেড়ে খাওয়াচ্ছেন । গানবাজনার চর্চা ও আলোচনা তো চলছেই । রাত হয়ে গেছে এই করতে করতে । গুরু ও শিষ্য মিলে খুব তবলা বাজিয়েছেন । এবার গুরু আল্লারাখাকে ঘুম পাড়িয়ে বাড়ি ফিরবেন শিষ্য । তিনি ইতিমধ্যেই গুরুকে বিছানায় শুইয়ে চাদর টেনে দিয়েছেন । ঘুমোনোর মুহূর্ত পর্যন্ত বোলতাল মুখে মুখে বলে যাচ্ছেন গুরুজী । থামার নাম নেই । তখন শিষ্য সুরেশ বললেন , ‘ গুরুজী , এবার আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন । আপনার বিশ্রাম দরকার । ‘

এরপর ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়লেন আল্লারাখা । কিন্তু অচিরেই ওঁর আঙুলগুলো নড়তে লাগলো , তবলায় বোল ফোটানোর মতো নাচতে লাগলো । তাঁর হাতের আঙুল সজ্ঞানে তবলায় যেমন ঝড় তোলে , ঘুমের ঘোরেও তেমনি দ্রুত ছন্দে নাচতে লাগলো । ঘোড়া ছোটার মতো যেন ছুটতে লাগলো আঙুলগুলো ।
দুহাতে যেন ঝড়ের গতি । বাতাসে যেন অশ্রুত তবলা বাজাচ্ছেন তিনি । কী অদ্ভুত ! পরিপূর্ণ ঘুমে বিভোর একটি মানুষের আঙুলগুলো যেন থামতেই চাইছে না । একি আশ্চর্য ঘটনা ! কিন্তু আশ্চর্যের তখনও কিছু বাকি ছিল । শিষ্য সুরেশ তখন মরিয়া হয়ে গুরুর দু’হাতের আঙুলগুলো নিজের বুকে চেপে ধরে থামানোর প্রাণপন চেষ্টা করলেন । একসময় আঙুল নড়া বন্ধ হয়ে গেলো ।

কয়েক মিনিট সব কিছু থেমে থাকলো । কিন্তু তারপর ? তারপর একি দেখছেন সুরেশজী ? এ যে অবিশ্বাস্য !
তিনি দেখলেন ধীরে ধীরে আল্লারাখার পায়ের আঙুলগুলো নড়তে লাগলো । তিনি যেন পায়ের আঙুল দিয়ে হাতের আঙুলে বোল তোলার অনুভব ব্যক্ত করতে লাগলেন । যে অনুভব আসলে একটা শরীরী অনুভব। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আল্লারাখার মনে-মননে , অনুভবে-উপলব্ধিতে , চেতনায় এবং সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে তবলা ছাড়া আর কিছু তো নেই । তাঁর জীবন মরণ সবকিছুই তো আটঘাটে বাঁধা। তবলাই তাঁর জগত , তাই এমন ঘটলো ।‌ হাতের আঙুল বাধা পেলে পায়ের আঙুল , পায়ের আঙুল বাধা পেলে তাঁর মাথা সহ সারা শরীর তবলা বাজাতে চাইবে । এ সাধনা অন্তহীন । প্রকৃত সাধক না হলে এমন হয় না ।

এবার ‘ চিল্লা ‘ নিয়ে কিছু কথা। চিল্লা শব্দের অর্থ চল্লিশ। শব্দটি ফার্সি শব্দ ‘ চেহেল ‘ থেকে এসেছে । আরবি ভাষাতেও চিল্লার একই অর্থ । এটি সুফি জীবনধারায় প্রচলিত প্রায়শ্চিত্য ও নির্জনতা বিষয়ক আধ্যাত্মিক চর্চা , যা ভারতীয় ও ফারসি ঐতিহ্যে বহুলভাবে পরিচিত । এই রীতিতে একজন ধ্যানস্থ মানুষ বা সন্ন্যাসী মাটিতে একটি চক্রাকার সীমারেখা এঁকে তার মধ্যে বসে ধ্যানচর্চা করে ।‌ এটি করা হয় শিয়াদের আরবাঈন বা চেহলোম উৎসবের অনুকরণে ৪০ দিন একটানা অনশনের মাধ্যমে । চেহলোম উৎসব আশুবার ৪০ দিন পর হোসাইন ও তাঁর পরিবারের মৃত্যুর চল্লিশা হিসেবে তাঁদের স্মরণে ইরানের শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে উদযাপিত হয়ে থাকে । চিল্লা সাধারণত চিল্লাখানা নামক একটি নির্জন কক্ষে ( স্থানে ) পালন করা হয় ।

প্রাচীন ভারতের সঙ্গীত আচার্যবৃন্দও চিল্লার অনুকরণে তাঁদের শিষ্যদের অন্তরে সঙ্গীতবোধ উদ্বোধিত করার লক্ষ্যে চিল্লা বাধ্যতামূলকভাবে চালু করেছিলেন । তাতে নির্দিষ্ট একটি সুর , তান অথবা তাল টানা ৪০ দিন ধরে রেওয়াজ করতে হতো শিষ্যদের । কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও নিবিড় নিবিষ্টতায় একটি নির্জন কক্ষে একটানা ৪০ দিন ধরে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের চূড়ান্ত অনুশীলনের এই পর্বটি অবশ্যই সাধনার পর্যায়ে পড়ে । চিল্লা করার পর একজন শিষ্যের জীবনবোধের বিরাট বদল ঘটে যায় । ‘ মরা ‘ কখন যেন ‘ রাম ‘ হয়ে ওঠে । দস্যু রত্নাকর হয়ে ওঠেন ঋষি বাল্মীকি । এই দীর্ঘ সাধনপথ অতিক্রম করা বড়ো সহজ নয়। এই তপস্যা কঠোর কৃচ্ছসাধনের । ঋষিপ্রতিম আল্লারাখা তালবাদ্য তথা সঙ্গীতের এই সুদীর্ঘ সাধনপথ অতিক্রম ক’রে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন । তাই তাঁর সমগ্র অস্তিত্বে বাসা বেঁধেছিল তাঁর ভালোবাসার তবলা । তাঁর জীবন , তাঁর বেঁচে থাকার প্রাণবায়ু হয়ে উঠেছিল প্রিয়তম বাঁয়া-তবলা ।

আরও পড়ুন- ভোটারদের মধ্যে সচেতনতা প্রচার ও ভোটদানে উৎসাহ প্রদান, কমিশনের পুরস্কার পাচ্ছেন তিন জেলাশাসক

Previous articleভোটারদের মধ্যে সচেতনতা প্রচার ও ভোটদানে উৎসাহ প্রদান, কমিশনের পুরস্কার পাচ্ছেন তিন জেলাশাসক
Next articleবারাকপুরের চু.রি যাওয়া বাইক উদ্ধার কলকাতায়! সৌজন্যে ওসি সৌভিক