‘আনন্দ হরমোন’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

‘ দুঃখকে স্বীকার করো না ,—
সর্বনাশ হয়ে যাবে ।
দুঃখ করো না , বাঁচো ,
প্রাণ ভ’রে বাঁচো ।
বাঁচার আনন্দে বাঁচো ।
বাঁচো , বাঁচো এবং বাঁচো ।

যদি মরতেই হয়
আনন্দের হাত ধ’রে মরো ।
বলো , দুঃখ নয় , আনন্দের মধ্যেই আমার জন্ম ,
আনন্দের মধ্যেই আমার মৃত্যু ,
আমার অবসান ।
( কবিতা: দুঃখ করো না বাঁচো
কবি : নির্মলেন্দু গুণ )

কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন , দুঃখগুলি দশজনের সঙ্গে ভাগ করে নিলে দুঃখ কমে যায় এবং আনন্দ ভাগ করে নিলে আনন্দ বেড়ে যায় । কে না জানে , হতাশার ফল গভীরতর হতাশা । একথাও ঠিক যে , সবসময় ইতিবাচক থাকা সম্ভব নয় , কিন্তু ইতিবাচক না থাকতে পারলে নিরাশা এসে মগজে বাসা বাঁধে । তাহলে উপায় ?

উপায় ‘ আনন্দ হরমোন ‘ ।
‘ ফিল গুড ‘ হরমোন ।
ভয়াবহ চাপের এই পৃথিবীতে বাঁচতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই ।
কোথায় পাওয়া যায় এটা ?

পাওয়া যায় অনেক জায়গাতেই । শুধু খুঁজে নেওয়ার আগ্রহ চাই । আমাদের মানব শরীরেই রয়েছে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন একটি হরমোন , যেটির নাম ডোপামিন । এটি হলো মস্তিষ্কে তৈরি একটি নিউরোট্রান্সমিটার , যা সারা শরীর জুড়ে বহুসংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আনন্দের অনুভূতি জাগাতে সক্রিয়ভাবে কাজ করে ডোপামিন , মস্তিষ্কে তৈরি হওয়া রাসায়নিক অনুভূতি ছাড়াও আরও অনেক কাজ করে ডোপামিন । আনন্দের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি কোনো কাজে আনন্দ পেলে সেই কাজ পুনরায় করার অনুপ্রেরণা জোগায় এই হরমোন । মানব শরীরের অনেকগুলো হরমোনের মধ্যে ৪ টি মৌলিক হরমোন হলো ডোপামিন , সেরোটোনিন , অক্সিটোসিন এবং এন্ডোরফিন । এগুলোকে বলা হয় ‘ হ্যাপি ‘ হরমোন । শরীরে এগুলোর মাত্রা যথাযথ থাকলে মানুষ হাসিখুশি ও প্রাণবন্ত থাকে । আর কমে গেলে এর উল্টোটা ঘটে , মন খারাপ হয় , বিমর্ষতার অন্ধকার গ্রাস করে মনকে । খাবারদাবারের পাশাপাশি কিছু অভ্যাস আমাদের শরীরে হ্যাপি হরমোনের নিঃসরণ বাড়িয়ে দেয় । একাগ্রতা , নিবিষ্টতা , স্মৃতি ,
মনঃসংযোগ ও কর্মক্ষমতা বাড়ায় ডোপামিন । এটি উৎপন্ন হয় শরীরের অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিতে । শরীরে এই হরমোন উৎপাদনে সাহায্য করে অ্যামিনো অ্যাসিড। মাছ এবং হাঁস ও মুরগীর মাংসে অ্যামিনো অ্যাসিড বেশি থাকে । এগুলো উচ্চ-প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার । এছাড়াও দুধ , পনির , দই ইত্যাদি নিরামিষাশীদের জন্য অ্যামিনো অ্যাসিডের বড়ো উৎস । স্ট্রবেরি , আপেল এবং অন্যান্য ফলমূল ডোপামিনের উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে । সবুজ শাকসবজি যেমন লেটুস , পালং শাক , বাঁধাকপি , ফুলকপি ও ব্রকলির মতো সবজি ডোপামিন বুস্টার হিসেবে কাজ করে । অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাদ্য ও পানীয় এক্ষেত্রে খুব প্রয়োজনীয় । গ্রিন টি খুব গুরুত্বপূর্ণ । ডিম তো আছেই , কারণ ডিম সুপারফুড । ছোলা ও বাদাম খুব উপকারী। এছাড়াও মাত্রা বুঝে কফি পান করলে তাৎক্ষণিকভাবে শরীর ও মন তাজা ও চনমনে হয়ে উঠতে পারে ।
ডোপামিন বৃদ্ধির ওষুধ বাজারে পাওয়া যায় । কিন্তু এইসব ওষুধ ডাক্তারের নির্দেশ ছাড়া খাওয়া উচিত নয় । অ্যালকোহল , নিকোটিন , মাদকদ্রব্য এবং শরীরে তাৎক্ষণিক উত্তেজনা আনে , এমন ওষুধ থেকে দূরে থাকাই শ্রেয় ।‌ মাত্রাতিরিক্ত কোনো কিছুই শরীরের পক্ষে ভালো নয় । ডোপামিনের মাত্রার ভারসাম্য বজায় রাখাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ।

প্রতিযোগিতাময় পৃথিবীতে কেউ হারতে হারতে জেতে , কারোর আবার জেতাটাই অভ্যাস , কেউ আবার হেরেও দমে না গিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় । এসবই মানব শরীরে ডোপামিন হরমোনের খেলা । হাসি , কান্না , রাগ , বিরক্তি , মান-অভিমান , উৎকণ্ঠা , উদ্বেগ , যৌনতা , ভালবাসা ও বিদ্বেষ ইত্যাদি ব্যক্তিগত অভিব্যক্তিগুলোর সমস্তটাই নিয়ন্ত্রণ করে এই হরমোন । চোখে দেখা যায় না বলে আমজনতার এই হরমোন নিয়ে মাথাব্যথা নেই । তাই অধিকাংশ মানুষ বুঝতেই পারেন না তাঁদের আচার , আচরণ ও বিভিন্ন রকম অভিব্যক্তির আড়ালে রয়েছে ডোপামিনের খেলা । এই বিশেষ হরমোনটি আমাদের মনে যে উদ্দীপনা তৈরি করে তাক ‘ reward effect ‘ বলা হয় ।

এবার শরীরের বাইরে আসা যাক । ধরা যাক , মনখারাপের এক সন্ধ্যায় হঠাৎ একটা গান শুনে মনটা ভালো হয়ে গেল । মনের ভার তাৎক্ষণিকভাবে নেমে গেল , চাপ কেটে গিয়ে মেজাজ হয়ে উঠলো ফুরফুরে । এটাও তো ডোপামিনের কাজই করলো , হ্যাঁ , অবশ্যই শরীরের বাইরে থেকে , বিমূর্তরূপে । একটা কবিতা কিংবা একটা ছোট গল্প কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে আলো জ্বেলে দিতে পারে ।

আলি আকবর খানের সরোদ , নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতার , বিসমিল্লার শানাই , জাকিরের তবলা কিংবা কিশোর কুমারের গান কি আসলে ডোপামিনের কাজই করে না ? নাচ , গান , গল্প , কবিতা , উপন্যাস , নাটক , সিনেমা এবং খেলাধুলা শরীরের বাইরে থেকে ডোপামিনের কাজই তো করে । সঙ্গে যোগ করতে হবে মহাপুরুষদের বাণী । তবে হ্যাঁ , পারিবারিক ভালবাসার সম্পর্কগুলোর কথা উল্লেখ করার পরেও বলতেই হয় যে , সেরার সেরা ‘ ডোপামিন ‘ হলো একজন ভালো বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটানো ।

আরও পড়ুন- দল থেকে সাসপেন্ডের পর এবার সন্দেশখালিকাণ্ডে গ্রে.ফতার উত্তম সর্দার

Previous articleজয়ে ফিরল মোহনবাগান, হায়দরাবাদ এফসিকে হারালো ২-০ গোলে
Next articleBreakfast Sports : ব্রেকফাস্ট স্পোর্টস