দোলে দোদুল দোলে, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

দেখাও তোমার রংবাজি

রঙ মেখে আজ সঙ সাজি ।

কিন্তু মনে রেখো ,
সময় লাগে চর্ম থেকে
মর্মে যেতে রঙের ;
অবহেলায় মর্মেও ছোপ পড়ে
জং-এর ।

প্রেমের এমন রঙিন উৎসবের বিকল্প কোথায় ? দোলে তো দোলা লাগবেই হৃদয়ে । ফাগুয়া খেলিতে ব্রজে কে চলে রে ? গৃহবাসীর এমন হাটখোলা হৃদয়ের দ্বার এদিন ছাড়া আর কবেই বা দেখতে পাও তুমি ! বৃন্দাবনে জীবনের সব রঙ থেকে বঞ্চিত বিধবারাও রঙিন হবার লাইসেন্স পান এই বিশেষ দিনটিতে । ছোট্ট কানাই মা যশোদাকে প্রশ্ন করে , ‘ রাধা কেন ফর্সা , আর আমি কেন কালো ? ‘ যশোদা বলেন রাধাকে কালো রঙ মাখিয়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায় । ব্যাস , অমনি দলবল নিয়ে রাধা ও গোপিনীদের রঙ মাখাতে গেলে কৃষ্ণ ও তার সখাদের বেদম লাঠিপেটা করে রাধার বান্ধবীরা । সেই থেকে প্রচলন হয় লাঠমার হোলি খেলার । ফাগুনের পূর্ণিমা তিথিতে জমে ওঠে প্রেমের রঙ । গাছের পাতার ফাঁকে লেগে থাকা রঙের আভা আর খোলা আকাশে উড়তে থাকা আবিরের শোভায় চারদিক কেমন রঙধনুর মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে । বসন্তে ফুল গাঁথা হয় । আহা রাধাকৃষ্ণ লীলা ! আহা মথুরা বৃন্দাবন ! মথুরা নগরপতি কাহে তুম গোকুল যাও ? মথুরায় প্রায় সাত দিন ধরে চলে রঙের উৎসব । সারা বছর কিসের প্রতীক্ষায় প্রহর গোনে বৃন্দাবন বিলাসী রাই আমাদের ? অথচ তার তো প্রেমে পড়া বারণ !

দোল ফাগুনে
মন আগুনে সেঁকে
বেরিয়ে পড়ো শুভলগ্ন দেখে ।

জ্যাঠাদের দল নাক সিটকোয় চিরকাল , খেলাটা ভালোই , তবে বড্ড শরীরী ! তাই নাকি ? ও জেঠু , বলো তো নিরামিষ কারে কয় ? সত্যিই কি তেমন কিছু হয় ? শরীরী বলেই তো রঙের এতো টান ! শরীর বেয়ে হৃদয়পানে চলে ধেয়ে প্রেম , নিকষিত হেম । বিমূর্ত মন জাপটে আছে শরীরকেই , রঙে মাখামাখি । এ তো গৌরপূর্ণিমা হে ! চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম হয়েছিল গো এই পুণ্য তিথিতে । সবার রঙে রঙ মেলানোর ডাক আজ থেকে পাঁচশো বছর আগেই দিয়ে গেছেন নদের নিমাই । ভাবা যায় ! সবাইকে সামিল করতে না পারলে কিসের উৎসব ? দোলযাত্রা তো একটা বার্তা । ধর্মনিরপেক্ষতার বার্তা । পক্ষপাতহীনতার বার্তা । প্রীতি ও সৌহার্দ্যের বার্তা । আসলে ভালবাসার বার্তা । চেতনা কীভাবে ‘ চৈতন্য ‘ ক’রে দিতে হয় তা তো সেই কবেই শিখিয়ে দিয়ে গেছেন জননেতা শ্রী শ্রী গৌরাঙ্গ । হরিনাম সংকীর্তন , নগর পরিক্রমা আর দোলের প্রেমালিঙ্গনের আহ্বানের আড়ালে লুকিয়ে থাকে এক অমোঘ ‘ দর্শন ‘ । প্রেম বিনিময় । রাধামাধবের প্রেমলীলা আর নিমাই সন্ন্যাসীর চৈতন্যলীলা রঙে রঙে মিলেমিশে একাকার ! তুমি দেখেছো কি ?

ডাকছে অশোক
ডাকছে পলাশ
ও মেয়ে তুই
সাবধানে যাস ।

রঙ ও ঋতু বসন্ত । নীল দিগন্তে ফুলের আগুন । শুধু কি ব্রজগোপী খেলে হোরি ? জোড়াসাঁকো খেলে না ?
শান্তিনিকেতন খেলে না ? মুগ্ধ বর্ণময়তার স্নিগ্ধ প্লাবন কি এক জায়গায় থেমে থাকতে পারে ? রঙে-রসে জাল বোনার এক রঙচঙে তিথি ডাক দেয় ভালোবাসার , এ ডাক উপেক্ষা করার সাধ্য কার ? মন্দমধুর হাওয়ায় অঙ্গে অঙ্গে জ্বলে রঙমশাল ! রবিকবির বসন্ত-ভাবনা তো বাংলা মুলুক ছাড়িয়ে একেবারে বিশ্বজনীন । এই এক আশ্চর্য উৎসবে ইতিহাস,পুরাণ , আদি ও আধুনিক সংস্কৃতি সমবেত হয় এক সমতলে , সমস্ত অহং ভুলে রঙ মাখে ও মাখায় হাসিমুখে ‌। ভুললে চলবে না বহুকাল আগে গোলাপজল আর আবির নিয়ে রঙ খেলে গেছেন মোগল বাদশারা ।

ও হ্যাঁ , দোলের আগের দিন খড় , বাঁশ , কাঠকুটো আর শুকনো পাতা ও ডালপালা এক জায়গায় জড়ো করে তাতে আগুন ধরিয়ে এক বিশেষ বহ্নুৎসবের আয়োজন ছেলে বুড়ো সকলের কাছেই বড়ো আনন্দের । সেই যে , আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া কাল আমাদের দোল ! এরই অন্যনাম হোলিকা দহন ।

কে কার হৃদয় ভেঙে
চলে গেছে সব আমি জানি
যদিও চাই না হোক
কোনো পক্ষেরই মানহানি
তবুও তোমাকে আজ
এইবেলা চুপিচুপি বলি
কেননা আজকে দোল
রাত পোহালেই কাল হোলি …

অশুভকে বিদায় করে শুভশক্তির জয়গান গায় এই প্রেমপরব । সেই কবেকার দ্বাপর যুগে দুই দুর্ধর্ষ দৈত্যকে হত্যা করে মথুরাবাসীদের রক্ষা করেন কৃষ্ণ ও বলরাম ।

সেও ছিল ঠিক ফাল্গুনী পূর্ণিমার আগের দিন শুক্লা চতুর্দশী তিথি ।‌ সেই সন্ধ্যায় শুকনো কাঠ ও খড়কুটো জড়ো করে দাহ করা হয় সেই দুই ভয়ঙ্কর দৈত্যের মরদেহ । ত্রাসমুক্ত মথুরাবাসী সমবেত উল্লাসে পরস্পরকে রঙ মাখান মহানন্দে । সেদিন থেকেই নাকি শুরু হয় দোল উৎসব । তার মানে এই উৎসব এক হিসেবে সাধারণ মানুষের মুক্তির দিন । আবার বসন্তকে স্বাগত জানাতেও ফাগ উৎসব , যা কৃষি মরশুমের সূচনা করে । চিরন্তন প্রেমের মূর্ত প্রতীক বসন্তের আগুন পলাশ ‌। বাঙালির প্রাণের দোলযাত্রা কিন্তু মূলত হিন্দু বৈষ্ণবদের উৎসব । বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী , এদিন শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে রাধিকা ও তাঁর সখীদের সঙ্গে আবির খেলেছিলেন । জীবনের নানা রঙের খেলায় কামনা ও সমর্পনের রঙ নিয়ে আসে দোল । সবই রঙের খেলা জানে ফাগুন , বুকে পাথর চেপে জ্বালে আগুন ।

বসন্তের এই মন্দমধুর হাওয়া
মনে পড়ায় বন্ধুদের
অকালে চলে যাওয়া
আজকে প্রাচীন পর্দা
ঠেলে দেখি
রঙ খেলতে তৈরি ওরাও ,
একি !

পাড়ায় পাড়ায় তৈরি রঙিন বাহিনী । সারাটা দিন রচিত হয় কত যে নতুন কাহিনী ! খাটুদা কেন রঙ দিল না লীনাদিকে ? অপর্ণাদের বাড়িতে আজ তালা কেন ? বেঁচে থাকলে টুকুন আজ গান শোনাতো অবশ্যই । নন্দনকে মনে আছে ? সেই যে রঙ মেখে ভূত হয়ে ভরদুপুরে ভাঙ খেয়ে ছাইগাদায় ঘুম ? চলো ওদের সবার কথা ভেবে দু’মিনিট বন্ধ রাখি হাসিখেলা।
সবাই যে যার জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াও । ………..

আর মণিদীপা ? সে অসময়ে সবকিছু ফেলে চলে গেছে বলে তাকে কি ভুলে গেছে নক্ষত্রের আকাশ ? ও দীপনাথ , এই নাও লাল আবির , মনে মনে ভরিয়ে দাও ঘুমন্ত মণিদীপার সিঁথি । জয় টুকুন , জয় নন্দন , জয় মণিদীপা , জয় দোলযাত্রা ।

আরও পড়ুন- একদিনে বাতিল ৩০০ ট্রেন! দোল উৎসবে বিপাকে পড়তে চলেছেন রেলযাত্রীরা

 

Previous articleএকদিনে বাতিল ৩০০ ট্রেন! দোল উৎসবে বিপাকে পড়তে চলেছেন রেলযাত্রীরা
Next articleরঙের উৎসবে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি! পশ্চিমি ঝঞ্ঝার জেরে দুর্যোগের অশনি সংকেত