‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

” সংগীতের মতো এমন ইন্দ্রজালবিদ্যা জগতে আর কিছুই নেই — এ এক নতুন সৃষ্টিকর্তা । আমি তো ভেবে পাই নে — সংগীত একটা নতুন মায়াজগৎ সৃষ্টি করে , না এই পুরাতন জগতের অন্তরতম অপরূপ নিত্যরাজ্য উদঘাটিত করে দেয় । সঙ্গীতে যা অনির্বচনীয় , তারই সঙ্গে আমাদের মর্মের মর্মান্তিক যোগ …
তারই জন্য আমাদের এত দুঃখ , এত সুখ , এত ব্যাকুলতা । “- ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )

এবার এই ‘ ইন্দ্রজালবিদ্যা’- র অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাণ্ডারী , যিনি বিশ্বভুবনে তাঁর নিজস্ব ক্ষেত্রে প্রায় এক ও অদ্বিতীয় , তিনি কী বলেছেন দেখা যাক ।

” ডর লাগতা হ্যায় , লয় অউর সুর সে , ইয়ে বহত বড়ি চিজ হ্যায় , হম ইসকি পুজারি হুঁ , লয় অউর সুর কি পুজারি হুঁ , অগর উও ( বো ) মঞ্জুর করলে হামারি পুজনা তো মেহেরবানী আল্লা । অউর নেহি তো , ইয়ে তো হাওবা কে সাথ খেলনা হ্যায় , হাওবা কিসি কে কাবু মে নেহি রহতি , যিস ওয়ক্ত আল্লা কি মেহেরবানী হো যাতি , কুছ হো যাতা হ্যায় ।

এইসব কথা শুনলে একাধারে ভয় ও রোমাঞ্চ অনুভূত হয় শরীরে-মনে । শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয় । একটা অদ্ভুত কম্পন জাগে । অহংকার নাশ হয় । দীর্ঘলালিত মূঢ় অহং । কে বলছেন এই সব আশ্চর্য কথা? বড়ে গুলাম আলি স্বয়ং ! তিনি যদি এই কথা বলেন তাহলে তো স্যার আইজাক নিউটন ভুল কিছু বলেন নি । একটুও বাড়িয়ে বলেন নি । একটুও বিনয় করেন নি । সেই যে , তাঁর সারা জীবনব্যাপী বিজ্ঞান সাধনা নিয়ে বলতে গিয়ে উনি বলেন , জ্ঞানসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে থাকা এক শিশুর মতো তিনি সারাজীবন নুড়ি কুড়িয়ে গেছেন । একেবারে অকপট স্বীকারোক্তি ।

ভারতবর্ষ তথা সারা বিশ্বের এক বিস্ময়কর সঙ্গীত প্রতিভা বড়ে গুলাম আলি খান । অনেকেই তাঁকে ‘ বিংশ শতাব্দীর তানসেন ‘ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন । তাঁর কণ্ঠের লালিত্য , অপরূপ বৈচিত্র এবং অসামান্য নমনীয়তা তাঁকে তাঁর সমকালীন অন্যান্য শিল্পীদের চেয়ে বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র করে তুলেছিল । ‌ তাঁর মাধুর্যপূর্ণ কণ্ঠের জাদুতে সঙ্গীতের অন্তর্নিহিত অর্থ জীবন্ত রূপ পেতো । তাঁর প্রতিভার কিরণে এবং তাঁর অনন্য শৈলীতে বারবার মুগ্ধ হয়েছে সারা পৃথিবী ।

অল্প বয়সে পাতিয়ালা ঘরানার সঙ্গীতে তিনি তালিম পান তাঁর বাবা ও কাকার কাছে । তারপর এই পাতিয়ালা ঘরানার সঙ্গীতকেই আরও উন্নত ও প্রাণবন্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন তিনি । সনাতন ঐতিহ্যকে ভেঙে এক নতুন শৈলী আনতে চেয়েছিলেন তিনি । তাঁর সমকাল থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকা এই বরেণ্য শিল্পী শ্রোতাদের মনস্তত্ত্ব বেশ ভালোই বুঝতেন।

তিনি বুঝেছিলেন যে , রসজ্ঞ শ্রোতাদের কাছে তাঁর এই নতুন রীতির গায়নধারা প্রশংসিত হবেই । শ্রোতারা উপভোগ করবেন এই অভিনবত্ব । সঙ্গীতপ্রেমী শ্রোতাদের রুচির বদলটাও তিনি ধরতে পেরেছিলেন সময়মতো । তাই অন্য ঘরানার গানের ধারা ও শৈলীর চর্চাও শুরু করেন তিনি । এর ফলে ক্রমে ক্রমে পাতিয়ালা-কসুর , ধ্রুপদ , গোয়ালিয়র এবং জয়পুর ঘরানার এক সুমিষ্ট মিশ্রণ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন তিনি । ঠুমরি গানের ধারার যে ঐতিহ্যবাহী ‘ বোল-বানভ ‘ রীতি , তার সীমা অতিক্রম করে নতুন কোনো রীতির সন্ধান করেছিলেন তিনি । নতুন মিশ্র রীতিতে গান গেয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি সাহেব । এখনও তাঁর নিজস্ব ঠুমরি গানের ধারা আধুনিক প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যেও প্রবহমান । এছাড়াও , খুব বেশি পরিবর্তন না করেই খেয়াল গানের ধারায় নিজেকে দারুণভাবে উপস্থাপিত করতে পেরেছিলেন তিনি । একেবারে সোজা সরলভাবে গানের স্বরলিপিকেও খানিকটা পেলব ও কমনীয় করে তোলার চেষ্টা করেন এই মহাশিল্পী । তাঁর গাওয়া ‘ ক্যা করুঁ সজনি আয়ে না বালম ‘ ও ‘ ইয়াদ পিয়া কি আয়ে ‘ শুনলে আজও থমকে দাঁড়ায় সময় , মুগ্ধ বিস্ময়ে । তাঁর বিদ্যুতগতির তান শুনে রোমাঞ্চিত হন না এমন শ্রোতা বিরল । বড়ে গুলাম আলির ‘ সাপাট ‘ শুনে বাকরুদ্ধ হতে হয় । বলা হয় , একটা সুইচ
‘ অন-অফ ‘ করার সময়টুকুর মধ্যেই সারেগামাপাধানিসা -সানিধাপামাগারেসা সাপাট করতে পারতেন তাঁর প্রৌঢ় বয়স পর্যন্ত । শ্রাবণের কালো আকাশে মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমকের মতো মন্দ্রসপ্তক থেকে তারসপ্তকে খেলে বেড়াতো তাঁর অসামান্য কণ্ঠ ।

অনুষ্ঠানে গিয়ে সাজঘরে বিশ্রামরত অবস্থায় চোখ বুজে আটগুণ-এ গুনগুন করতেন বিচিত্র সব তান , ভাগ্যবান আয়োজকবৃন্দ শিহরিত হতেন ক্ষণে ক্ষণে । আজও তাঁর গানের রেকর্ডগুলি শুনলে এইসব প্রবাদের সারবত্তা নিয়ে কোনো সংশয় থাকে না।

কোনো মানুষের কণ্ঠে যে এমন বিরামহীন বিস্ময় লুকিয়ে থাকতে পারে , অতল সাগরের অন্তহীন ঢেউয়ের মতো অমন অবাধগতির সুরলহরী এসে প্রতিমুহূর্তে যে সঙ্গীত সাগরের সৈকতে আছড়ে পড়তে পারে , তা বড়ে গুলাম আলি সাহেবের গান না শুনলে সম্ভবত জানা যেতো না ।

আরও পড়ুন- স্বেচ্ছাচারিতা করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছেন রাজ্যপাল, কটাক্ষ ব্রাত্যর

Previous articleস্বেচ্ছাচারিতা করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছেন রাজ্যপাল, কটাক্ষ ব্রাত্যর
Next articleলোকসভা ভোটের মুখে অস্বস্তিতে বিজেপি! RSS নেতার বাড়ি থেকে উদ্ধার ৭৭০ কেজি বি.স্ফো.রক