” সংগীতের মতো এমন ইন্দ্রজালবিদ্যা জগতে আর কিছুই নেই — এ এক নতুন সৃষ্টিকর্তা । আমি তো ভেবে পাই নে — সংগীত একটা নতুন মায়াজগৎ সৃষ্টি করে , না এই পুরাতন জগতের অন্তরতম অপরূপ নিত্যরাজ্য উদঘাটিত করে দেয় । সঙ্গীতে যা অনির্বচনীয় , তারই সঙ্গে আমাদের মর্মের মর্মান্তিক যোগ …
তারই জন্য আমাদের এত দুঃখ , এত সুখ , এত ব্যাকুলতা । “- ( রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )
এবার এই ‘ ইন্দ্রজালবিদ্যা’- র অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাণ্ডারী , যিনি বিশ্বভুবনে তাঁর নিজস্ব ক্ষেত্রে প্রায় এক ও অদ্বিতীয় , তিনি কী বলেছেন দেখা যাক ।
” ডর লাগতা হ্যায় , লয় অউর সুর সে , ইয়ে বহত বড়ি চিজ হ্যায় , হম ইসকি পুজারি হুঁ , লয় অউর সুর কি পুজারি হুঁ , অগর উও ( বো ) মঞ্জুর করলে হামারি পুজনা তো মেহেরবানী আল্লা । অউর নেহি তো , ইয়ে তো হাওবা কে সাথ খেলনা হ্যায় , হাওবা কিসি কে কাবু মে নেহি রহতি , যিস ওয়ক্ত আল্লা কি মেহেরবানী হো যাতি , কুছ হো যাতা হ্যায় ।
এইসব কথা শুনলে একাধারে ভয় ও রোমাঞ্চ অনুভূত হয় শরীরে-মনে । শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয় । একটা অদ্ভুত কম্পন জাগে । অহংকার নাশ হয় । দীর্ঘলালিত মূঢ় অহং । কে বলছেন এই সব আশ্চর্য কথা? বড়ে গুলাম আলি স্বয়ং ! তিনি যদি এই কথা বলেন তাহলে তো স্যার আইজাক নিউটন ভুল কিছু বলেন নি । একটুও বাড়িয়ে বলেন নি । একটুও বিনয় করেন নি । সেই যে , তাঁর সারা জীবনব্যাপী বিজ্ঞান সাধনা নিয়ে বলতে গিয়ে উনি বলেন , জ্ঞানসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে থাকা এক শিশুর মতো তিনি সারাজীবন নুড়ি কুড়িয়ে গেছেন । একেবারে অকপট স্বীকারোক্তি ।
ভারতবর্ষ তথা সারা বিশ্বের এক বিস্ময়কর সঙ্গীত প্রতিভা বড়ে গুলাম আলি খান । অনেকেই তাঁকে ‘ বিংশ শতাব্দীর তানসেন ‘ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন । তাঁর কণ্ঠের লালিত্য , অপরূপ বৈচিত্র এবং অসামান্য নমনীয়তা তাঁকে তাঁর সমকালীন অন্যান্য শিল্পীদের চেয়ে বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র করে তুলেছিল । তাঁর মাধুর্যপূর্ণ কণ্ঠের জাদুতে সঙ্গীতের অন্তর্নিহিত অর্থ জীবন্ত রূপ পেতো । তাঁর প্রতিভার কিরণে এবং তাঁর অনন্য শৈলীতে বারবার মুগ্ধ হয়েছে সারা পৃথিবী ।
অল্প বয়সে পাতিয়ালা ঘরানার সঙ্গীতে তিনি তালিম পান তাঁর বাবা ও কাকার কাছে । তারপর এই পাতিয়ালা ঘরানার সঙ্গীতকেই আরও উন্নত ও প্রাণবন্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন তিনি । সনাতন ঐতিহ্যকে ভেঙে এক নতুন শৈলী আনতে চেয়েছিলেন তিনি । তাঁর সমকাল থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকা এই বরেণ্য শিল্পী শ্রোতাদের মনস্তত্ত্ব বেশ ভালোই বুঝতেন।
তিনি বুঝেছিলেন যে , রসজ্ঞ শ্রোতাদের কাছে তাঁর এই নতুন রীতির গায়নধারা প্রশংসিত হবেই । শ্রোতারা উপভোগ করবেন এই অভিনবত্ব । সঙ্গীতপ্রেমী শ্রোতাদের রুচির বদলটাও তিনি ধরতে পেরেছিলেন সময়মতো । তাই অন্য ঘরানার গানের ধারা ও শৈলীর চর্চাও শুরু করেন তিনি । এর ফলে ক্রমে ক্রমে পাতিয়ালা-কসুর , ধ্রুপদ , গোয়ালিয়র এবং জয়পুর ঘরানার এক সুমিষ্ট মিশ্রণ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন তিনি । ঠুমরি গানের ধারার যে ঐতিহ্যবাহী ‘ বোল-বানভ ‘ রীতি , তার সীমা অতিক্রম করে নতুন কোনো রীতির সন্ধান করেছিলেন তিনি । নতুন মিশ্র রীতিতে গান গেয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি সাহেব । এখনও তাঁর নিজস্ব ঠুমরি গানের ধারা আধুনিক প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যেও প্রবহমান । এছাড়াও , খুব বেশি পরিবর্তন না করেই খেয়াল গানের ধারায় নিজেকে দারুণভাবে উপস্থাপিত করতে পেরেছিলেন তিনি । একেবারে সোজা সরলভাবে গানের স্বরলিপিকেও খানিকটা পেলব ও কমনীয় করে তোলার চেষ্টা করেন এই মহাশিল্পী । তাঁর গাওয়া ‘ ক্যা করুঁ সজনি আয়ে না বালম ‘ ও ‘ ইয়াদ পিয়া কি আয়ে ‘ শুনলে আজও থমকে দাঁড়ায় সময় , মুগ্ধ বিস্ময়ে । তাঁর বিদ্যুতগতির তান শুনে রোমাঞ্চিত হন না এমন শ্রোতা বিরল । বড়ে গুলাম আলির ‘ সাপাট ‘ শুনে বাকরুদ্ধ হতে হয় । বলা হয় , একটা সুইচ
‘ অন-অফ ‘ করার সময়টুকুর মধ্যেই সারেগামাপাধানিসা -সানিধাপামাগারেসা সাপাট করতে পারতেন তাঁর প্রৌঢ় বয়স পর্যন্ত । শ্রাবণের কালো আকাশে মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমকের মতো মন্দ্রসপ্তক থেকে তারসপ্তকে খেলে বেড়াতো তাঁর অসামান্য কণ্ঠ ।
অনুষ্ঠানে গিয়ে সাজঘরে বিশ্রামরত অবস্থায় চোখ বুজে আটগুণ-এ গুনগুন করতেন বিচিত্র সব তান , ভাগ্যবান আয়োজকবৃন্দ শিহরিত হতেন ক্ষণে ক্ষণে । আজও তাঁর গানের রেকর্ডগুলি শুনলে এইসব প্রবাদের সারবত্তা নিয়ে কোনো সংশয় থাকে না।
কোনো মানুষের কণ্ঠে যে এমন বিরামহীন বিস্ময় লুকিয়ে থাকতে পারে , অতল সাগরের অন্তহীন ঢেউয়ের মতো অমন অবাধগতির সুরলহরী এসে প্রতিমুহূর্তে যে সঙ্গীত সাগরের সৈকতে আছড়ে পড়তে পারে , তা বড়ে গুলাম আলি সাহেবের গান না শুনলে সম্ভবত জানা যেতো না ।
আরও পড়ুন- স্বেচ্ছাচারিতা করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছেন রাজ্যপাল, কটাক্ষ ব্রাত্যর