‘পাবলো পিকাসো’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

” আমাকে একটি জাদুঘর দিয়েই দেখো , একে পূর্ণ করার দায়িত্ব আমার ” ।

এমন কথা বলতে একটা জীবন যথেষ্ট নয় , জীবনের চেয়েও বড়ো হতে হয় ‌। চোখে ভাসে ‘ ব্লু পিরিয়ড ‘ । আহা , নীল নীল ঘন নীল , কতো নীল , কত ধরনের কত রকমের নীল হালকা নীল , গাঢ় নীল , আকাশী নীল , চাপা নীল , ফিকে নীল , জমাট , উজ্জ্বল , ফ্যাকাশে নীল , আহা নীলাভ ছটার সমাহার ! আর কি সব পোর্ট্রেট ! একমুখ দাড়িওয়ালা এক যুবক , একচোখ নিয়ে এক মহিলা , আরও কতো যে নীল নীল । ১৯০৬-এ আঁকা তাঁর আত্মচিত্রটি কিন্তু মোলায়েম গোলাপী রঙে রাঙানো । চিত্রকর পিকাসো ভাস্কর পিকাসো । রং তুলি , কাঠ , পাথর , বিভিন্ন ধাতু , কাচ , এমনকি পুরোনো গাড়ির ভাঙা অংশ পর্যন্ত সবই তাঁর শিল্পসৃষ্টির জরুরি উপাদান । তাঁর প্রবর্তিত ‘ কিউবিজম ‘ কিন্তু শুধু দেখলে চলবে না , বুঝতেও হবে ।

একটা গোটা দশক ধরে আঁকা ‘ সুররিয়ালিজম ‘ সিরিজের চিত্রমালা । ছবির মালা গাঁথা । গিটার ও বেহালা নিয়ে আশ্চর্য কাজ । কিউবিজমের অভিনব ধারা । নানা আকারের ফ্রেম । নানা রেখা, নানা আঙ্গিক , নানা ভঙ্গিমা । সরল , জটিল , মূর্ত , বিমূর্ত , কত যে রহস্য ! আহা কত রঙের ছবি দিয়ে আঁকা চুম্বন , প্রেমিক- প্রেমিকারা ।

বালক পিকাসোর মা ভাবতেন ছেলে বড় হয়ে বেশ উঁচুদরের মানুষ হবে । সে ধারণা মিথ্যে হয় নি । তবে স্পেনের গ্রাম্য পোশাক ও গেঁয়ো ভাষা সারা জীবন ছাড়তে পারেন নি পিকাসো । চুল নিয়ে চুলচেরা বিচার ছিল তাঁর । চুল কাটাতে বাড়ির বাইরে যেতেন না কখনও । চুল , দাড়ি , নখ নিজেই কাটতেন । এটা ছিল তাঁর স্প্যানিশ সংস্কার ।‌ কেউ যাতে চুল-দাড়ি-নখ নিয়ে তুকতাক করতে না পারে । তিনি বলতেন , ‘ আই ডু নট সার্চ , আই ফাইন্ড ‘ । তাঁর ছিল জীবনভর এক অদ্ভুত অস্থিরতা , যা দিয়ে তিনি একটা শতাব্দীর চেহারা পাল্টে দিয়ে গেছেন ।

১৮৮১ সালের ২৫ অক্টোবর স্পেনের মালাগা শহরে জন্ম হয় পিকাসোর ।‌ লোকে তাঁকে কমিউনিস্ট ভাবলেও কমিউনিস্ট আদর্শ বা ফর্মুলা মেনে তিনি ছবি আঁকেন নি । প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত ধারণার বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি । কমিউনিস্ট দুনিয়া যেমন তাঁকে নিয়ে স্বস্তিতে ছিল না , তেমনই তাঁকে নিয়ে স্বস্তিতে ছিলেন না স্বয়ং হিটলারও ।

ক্রোধোন্মত্ত ষাঁড় , ভুলুণ্ঠিত ম্যাটাডোর , আতঙ্কিত সাদা ঘোড়ার ছবি কে না দেখেছেন ? এমনকি ষাঁড়ের লড়াই থেকেও নাকি সৃষ্টির প্রেরণা পেতেন পিকাসো । নারীর দুটি চোখ যেন দুটি ভিন্ন দিকে তাকিয়ে আছে , এমনই পিকাসোর তুলির অনন্য আঁচড় । এই নারী পাবলো পিকাসোর এক সময়ের প্রেমিকা ডোরা । রঙধনুর সাত রঙে রাঙানো ডোরার পোশাক । চেয়ারে বসে আছেন তিনি । এটি পোর্ট্রেট হিসেবে বিশ্বখ্যাত । পিকাসোর অসংখ্য প্রেমিকাদের অনেকেই ঠাঁই পেয়েছেন তাঁর ক্যানভাসে । ব্যক্তিজীবনের প্রেম অমরতা পেয়েছে অতুল তুলির কারুকার্যে ।

যুদ্ধকে ঘৃণা করতেন এই অসামান্য শিল্পী । বছরের পর বছর ধরে এঁকেছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের ছবি । পীড়িত নারী ও অসহায় শিশুদের ছবি । পিকাসোর আঁকা ধবধবে সাদা পায়রার ছবিই বিশ্ব শান্তি কংগ্রেসে শান্তির প্রতীক হিসেবে মনোনীত হয় ।

তাঁর অন্যতম সেরা শিল্পকর্ম ‘ গোয়ের্নিকা ‘ ( ১৯৩৭ ) সাদা কালো তৈলচিত্র । স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় জার্মানি এবং ইতালির বিমানবাহিনী বোমা ফেলেছিল গোয়ের্নিকায় । নৃশংসতার সেই ভয়ঙ্কর ছবি চিত্রিত করেন তিনি । ৯১ বছরের দীর্ঘ জীবন পিকাসোর । ১৯৭৩ সালে মৃত্যু। প্রায় ১৩৫০০ টি চিত্রকর্ম এবং প্রায় এক লক্ষ প্রিন্ট ও খোদাই সম্পন্ন হয়েছে তাঁর হাতে , এমনই অনুমান গবেষকদের । দ্য ওল্ড গিটারিস্ট , গারসন আ লা পাইপ , দ্য ব্লু রুম , টু ন্যুডস , থ্রি ম্যাজিশিয়ানস , সেলফ পোর্ট্রেট , তেতে দি ফ্রেমে ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম ।

তিনি বলতেন চিত্রশিল্প হলো এমন এক মিথ্যা , যা আমাদের সত্যকে উপলব্ধি করতে শেখায় । পরপর প্রেম , পরপর বিচ্ছেদ আর একের পর এক বাঁকবদল তাঁর জীবনের জলছবির মূল চিত্রকর । গার্ল বিফোর অ্যা মিরর , উইমেন অফ আলজিয়ার্স এবং দ্য উইপিং ওমেন এমনই কয়েকটি অসামান্য জলছবির শিরোনাম। কবি ও নাট্যকার পিকাসোর রয়েছে কয়েকশত কবিতা ও বেশ কয়েকটি নাটক । ‘ শিকাগো পিকাসো ‘ তাঁর বিখ্যাত ভাস্কর্য । কথিত আছে পিকাসো জন্মানোর পর ধাত্রী ভেবেছিলেন মৃত শিশুর জন্ম হয়েছে ।‌ তাই ধাত্রী শিশুটিকে একটি টেবিলের ওপর রেখে তার মায়ের সেবায় ব্যস্ত ছিলেন । এমন সময়ে পিকাসোর কাকা এগিয়ে এসে মুখে থাকা সিগারেটের ধোঁয়া শিশুর মুখে নিক্ষেপ করেন । এরপরেই নড়েচড়ে ওঠে শিশু পিকাসো। পৃথিবী পেয়ে যায় এক অবিস্মরণীয় শিল্পীকে , যাঁকে ঘিরে বিস্ময় শতাব্দীর পর শতাব্দী ফুরোয় না ।

আরও পড়ুন- নির্বাচনে প্রচারের নামে ধর্মীয় বিভাজন করছে বিজেপি, কমিশনে অভিযোগ জানাল দেশ বাঁচাও গণমঞ্চ

Previous articleনির্বাচনে প্রচারের নামে ধর্মীয় বিভাজন করছে বিজেপি, কমিশনে অভিযোগ জানাল দেশ বাঁচাও গণমঞ্চ
Next articleরবিবার বর্ধমান-দুর্গাপুরে সভা মমতার, জোড়া কর্মসূচি অভিষেকেরও