ডঃ সিভান, আপনি হারেননি!

কণাদ দাশগুপ্ত

তিনি কঠোর বাস্তববাদী একজন বিজ্ঞানী হতেই পারেন। হতেই পারেন তিনি ISRO-র প্রধান। হতেই পারে পরিচিত-বৃত্তে তাঁর পরিচয় ‘রকেট-ম্যান’।কিন্তু তাই বলে তিনি আবেগশূন্য কেন হবেন! এত কিছুর পরেও তাঁর চোখে দু’ চোখে জল আসবে না ? তিনি কাঁদতেও পারবেন না? এ কেমন কথা !

সবই ঠিকঠাকই ছিলো। কিন্তু তেমন আর থাকলো না। ঠিক ছিলো, শুক্রবার রাতেই চাঁদের মাটি ছোঁবে চন্দ্রযান 2-এর ল্যান্ডার বিক্রম৷ কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভেঙ্গে গিয়েছে স্বপ্ন। চাঁদ ছোঁয়ার মাত্র 1 মিনিট আগে ISRO-র সঙ্গে ল্যান্ডার বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। এখনও তা ফিরে আসেনি। আর বুকে পাথর চেপে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘোষণা করতে হলো ISRO-র চেয়ারম্যান ডঃ কে সিভান-কেই। এটাই রীতি, প্রোটোকল। কোনও চিকিৎসকের নিজের সন্তানের মৃত্যু ঘোষনা করার শোক কি এর থেকেও বেশি হতে পারে ? ISRO-প্রধান হিসাবে তাঁকেই তো ঘোষনা করতে হয় অভিযানের সাফল্য-ব্যর্থতা। তাই শুক্রবার রাতে সিভান’ই জানালেন তাঁর এবং তাঁদের স্বপ্নভঙ্গের কথা।

আরও পড়ুন-চন্দ্রযান-2 এর উপদেষ্টা বিজ্ঞানীই আজ দেশহারা!

ডঃ কে সিভান, আপনি হারেননি। হারেননি ডঃ মুথাইয়া ভানিথা, ডঃ রীতু কারিধাল, ডঃ এস সোমনাথ, ডঃ পি কুনহিকৃষ্ণন, ডঃ চন্দ্রকান্ত কুমার-সহ দেশের এক ঝাঁক উজ্জ্বল মহাকাশবিজ্ঞানী, আপনারা কেউই হারেননি।
আমরা তো জানি, গত 1 বছর ধরে চন্দ্রযান-2 অভিযানকে সফল করতে কঠোর পরিশ্রম করেছেন আপনারা। শেষ মুহূর্তে ল্যান্ডার বিক্রমের সঙ্গে যখন ISRO-র যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হল, তখন টিভির পর্দায় দেখেছি আপনাদের কর্তব্যে অবিচল অথচ যন্ত্রনাবিদ্ধ মুখগুলি। নতমস্তক। চোখে সব হারানো শূন্যদৃষ্টি। কর্তব্যের খাতিরে মাউথপিসে কাউকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছেন। চেয়ার ছেড়ে একে একে সরে গেলেন আপনারা। হয়তো একটু ফাঁকায় গিয়ে একান্তে চোখের জলও ফেললেন। সন্তান-হারানোর শোক এমনই হয়। শুক্রবার রাতে এবং শনিবার সকালে টিভির পর্দায় দেখেছি, আবেগ লুকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছেন ইসরোর ডঃ কে সিভান। কিন্তু শুরুর ছবিটা ছিলো অন্যরকম। হাসিমুখে ঘোষণা করলেন, চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে 2.1 কিমি পর্যন্ত বিক্রমের অবতরণের কথা। তারপরই তো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখনও দেখলাম এই ডঃ কে সিভান’ই মাথা নিচু করে জানালেন, “খোঁজ মিলছে না বিক্রমের। কেন এমন হলো, তথ্য বিশ্লেষণ না করে বিস্তারিত বলা সম্ভব নয়। সেই চেষ্টাই চলছে”।
চন্দ্র-অভিযান আপাতত কোথায় দাঁড়িয়ে, তা আমরা জানি। সে সব জেনেই বলছি, ডঃ কে সিভান এবং তাঁর সহ-বিজ্ঞানীগণ, আপনারা হেরে যাননি। হেরে যাওয়া তো দূরের কথা, বরং দেশকে গর্বিত করেছেন। শনিবার টিভিতে দেখলাম, প্রধানমন্ত্রী সকালেই জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার জন্য ISRO গিয়েছেন। বেঙ্গালুরুর এই স্পেস সেন্টার থেকে বেরিয়ে আসার মুখে ‘রকেট-ম্যান’ ডঃ সিভানকে জড়িয়ে ধরেন মোদি। আমরা দেখলাম, আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন দু’জনই। কাঁদছেন ISRO প্রধান৷ আর বুকে জড়িয়ে ধরে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী৷ এই দৃশ্য দেখে কোন ভারতবাসীর চোখের কোল চিকচিক করে ওঠেনি, তা খুঁজে দেখার বিষয়। প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘক্ষণ সিভানকে জড়িয়ে ধরে তাঁকে উত্সাহিত করছেন। সিভানের চোখে জল। আর দেখা যায়, তিনি নেতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছেন। হয়তো অশ্রুসজল চোখে ISRO-প্রধান প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাইলেন, “আমরা পারলাম না”।

আরও পড়ুন-এই পর্যন্ত পৌঁছনোও কম কৃতিত্বের নয়, দেশ আপনাদের জন্য গর্বিত: ট্যুইট প্রধানমন্ত্রীর

ডঃ কে সিভান, আমরা জানি, NASA-র লোভনীয় চাকরি ছেড়ে ISRO-তে যোগ দিয়ে আপনি দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। আমরা জানি, আপনি এক কৃষক পরিবারের সন্তান। আমরা জানি, এই অভিযানের আরেক স্তম্ভ, বাংলার হুগলির ছেলে ডঃ চন্দ্রকান্ত কুমারও এক কৃষক পরিবারেরই ছেলে। চন্দ্রকান্তও দেশবিদেশ থেকে অসংখ্য চাকরির প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়েছেন দেশের জন্য। আমরা এসব জানি বলেই বিশ্বাস করি, আপনারা ব্যর্থ হননি। আপনাদের জন্য দেশ গর্বিত।
ডঃ কে সিভান, আজ হয়তো আমাদের অভিযান সফল হয়নি। কিন্তু আমরা আশা হারাবো কেন? এই ব্যর্থতায় আমরা পিছিয়ে পড়বো কেন ? পরাধীন ভারতের প্রথম স্বাধীনতা-সংগ্রামী যিনি ছিলেন, দেশকে তিনি তো মুক্ত করতে পারেননি। কিন্তু পথ নির্দিষ্ট করে দেন তিনিই। আমরা জানি, ক্রিকেটের আঙ্গিনায় পা রাখার প্রথমদিনেই ভারত বিশ্ববিজয়ী হয়নি, রাজনৈতিক জীবনের প্রথম দিনেই নরেন্দ্র মোদি বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাফল্যের চূড়ায় পা রাখেননি। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, ভবিষ্যত অন্যভাবে লেখা হয়েছে। আমরা সবাই আমাদের মহাকাশ-বিজ্ঞানীদের পাশে আছি। ভারতবাসী হিসাবে আমাদের বিজ্ঞানীদের নিয়ে আমরা আজও গর্বিত।

ডঃ কে সিভান, এখন একবার শুধু আপনার মুখ থেকে আমরা শুনতে চাইছি, “চাঁদে পৌঁছনোর জন্য ভারতের ইচ্ছাশক্তি এবার আরও প্রবল হয়েছে। সংকল্প আরও দৃঢ় হয়েছে”। বাধা এবার এসেছে। হয়তো ফের আসবে, কিন্তু একবার বলুন, “চাঁদের পাহাড়ের রাস্তা থেকে আমরা সরব না”। চাইছি একবার বলুন, “লক্ষ্যে না পৌঁছনো পর্যন্ত আমরা থামবো না। এবং ডঃ কে সিভান জোর গলায় বলুন, “আমরা আত্মবিশ্বাসী, সফল আমরা হবোই”।
ব্যর্থতা তো আগেও একাধিকবার এসেছে। অতীতে প্রতিবারই ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে ISRO, ভারতবাসী নিশ্চিত এবারও তা সম্ভব হবে।

আরও পড়ুন-চন্দ্র অভিযানকে ব্যর্থ বলতে যাব কেন?