বাঙালির লক্ষ্মীপূজো

সঞ্জয় সোম

আমরা ঘটি, আমাদের বাড়িতে মা লক্ষ্মীর পুজো কালীপুজোর রাতে হয়। কিন্তু আশেপাশে প্রায় সব বাড়িতেই এই কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিনে দুপুর থেকেই শাঁখ বাজছে শুনতে পাই, মহিলারা উলু দিচ্ছেন, চতুর্দিকে এক দারুন উৎসবের আবহ। দুদিন আগে থেকে বাজারে থাকে থাকে ছোট ছোট প্রতিমার ভিড়, ফুটপাথে গোটা গোটা আখের গোছা, থোরের নৌকো, ছোট ছোট কলাগাছ ইত্যাদি নিয়ে হটাৎ-দোকানিদের ভিড়, মায়ের আসার আশায় উদগ্রীব দরদাম করা চকচকে বাঙালি মুখগুলো। লক্ষ্মীমন্ত রাজ্যে এমনটাই তো হওয়া উচিত।

জন্মইস্তক ঘরে ঘরে বাঙালির লক্ষ্মী আরাধনা দেখছি কিন্তু এই পোড়া বঙ্গভূমিতে মা লক্ষ্মীর আগমন ও অধিষ্ঠানের কোনো চিন্হ কিন্তু গত সাড়েচার দশক ধরে দেখতে পাইনি। সারা দেশ দ্রুত আর্থিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে আর আমরা কেমন যেন প্রতিনিয়ত পিছিয়ে যাচ্ছি। আমাদের বড় বড় পৈতৃক বাড়িগুলো ভেঙে ভেঙে খুপরি খুপরি ফ্ল্যাট হয়ে যাচ্ছে, এককালে গমগম করে চলা আমাদের কল-কারখানাগুলোর অবস্থাও কম-বেশী তাই, আমাদের জমানো টাকাপয়সা চিটফান্ড গিলে নিয়েছে আর আমাদের বেকার ছেলেরা সিন্ডিকেট ইত্যাদিতে ভিড়ে গিয়ে অসামাজিক উপায়ে রোজগারের পথ খুঁজছেন।

সারা রাজ্যজুড়ে আজ ঘরে ঘরে মায়ের পদচিহ্ন আঁকা হচ্ছে বটে কিন্তু মায়ের স্পর্শ বোধহয় আর তাতে পড়ে না। অথচ এই বাংলায় মায়ের স্থায়ী বসতি ছিল, সেই চাঁদ সওদাগরের আমল থেকে প্রায় পাঁচ-ছয় দশক আগে পর্য্যন্ত মায়ের অপার কৃপাদৃষ্টি ছিল আমাদের এই একফালি বঙ্গীয় ভূখণ্ডের ওপর। এই পূর্নচ্ছেদ বেশিদিন আগেকার ঘটনা নয়। ১৯৪৬এ এমনই এক লক্ষ্মীপুজোর দিন ওপার বাংলার নোয়াখালীতে যে হিন্দুনিধন এবং হিন্দুদমন শুরু হয়েছিল, ঠাকুরঘর থেকে লক্ষ্মীর ঝাঁপি বুকে আগলে নিয়ে এপারে পালিয়ে এসে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করে তা কি পুরোপুরি বন্ধ করা গেছে? মায়ের কৃপা পেতে গেলে যে ন্যূনতম আয়োজনটুকু আবশ্যিক, সেটা কি করা গেছে?

যাঁরা প্রতিস্থাপিত হয়ে এসে মার্ক্সীয় হিন্দু-বিদ্বেষীদের হাত ধরলেন এবং রক্তক্ষয়ি শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গকে লক্ষ্মীহীন করলেন, তাঁরা কি আজকের দিনে নিজেদের কৃতকর্মের ফল পরবর্তী প্রজন্মের লক্ষ্মীশ্রীহীনতায় দেখতে পান না? তাঁরা কি এখন অনুধাবন করেন কেন এই ভারতবিরোধী শক্তির দালালরা তাঁদের পন্থহীন হতে উদ্বুদ্ধ করতেন, কেন পার্টিক্লাসে বিশ্বমানবতার পাঠ পড়িয়ে তাঁদের ভারতীয়ত্বের অনুভূতিকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হতো? কেন হটাৎ করে শুধুমাত্র তাঁদের সন্তানদের বেলায় ‘শিক্ষায় মাতৃভাষাই মাতৃদগ্ধ’ গেলানো হয়েছিল আর নেতাদের নিজেদের সন্তানেরা ইংরিজিমাধ্যম স্কুল-কলেজে পড়তেন? মার্ক্সবাদের মাধ্যমে মা লক্ষ্মীর কৃপা পাওয়ার মতন আদর্শ পরিস্থিতি কি তাঁরা এই পশ্চিমবঙ্গের বুকে সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন? যদি পেরে থাকেন, আজ তার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছিনা কেন?

ইদানিং গত আট বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে যা হচ্ছে তা ভয়াবহ, এক কথায় মারাত্মক। কেউ বলতে পারেন খাগড়াগড়ে মা লক্ষ্মী আসবেন কিভাবে, বা কালিয়াচকে অথবা দেগঙ্গায় বা উস্তিতে, রাজ্যের নানা জায়গায় মায়ের আসার রাস্তা কোথায়? আমরা নিজেদের চরম নির্বুদ্ধিতার কারণে অবৈধ মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের তোষণকারী এমন এক সরকারকে দ্বিতীয়বার মসনদে বসিয়েছি যারা কেবলমাত্র ওদের অবৈধ ভোটকে ব্যবহার করে নিজেদের ব্যক্তিগত সিন্দুকটুকু ভরা নিয়েই ব্যস্ত। ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’ একথা তো বহুল প্রচলিত এবং এর চেয়ে সত্যি তো আর কিছু নেই। অথচ এ এমন এক সরকার যার জমিনীতি, করনীতি, শিল্পনীতি, পরিকাঠামোনীতি কোনোটাই শিল্পবান্ধব নয়, ওপর থেকে আবার রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতিও ভয়াবহ। কে আসবেন এখানে শিল্প গড়তে, কে দেবে আমাদের রোজগার?

আজ এই পুন্য কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিনে যতই বাঙালির ঘরে ঘরে জোড়া শাঁক বাজুক না কেন, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি,
লক্ষ্মী যখন আসবে তখন কোথায় তারে দিবি রে ঠাঁই?
দেখ্‌ রে চেয়ে আপন-পানে, পদ্মটি নাই, পদ্মটি নাই ॥
মায়ের আসন পাতার কাজটি আমাদেরই করতে হবে, তবে তো মা আবার এসে বসবেন। আসুন না, অন্যরকম এমন কিছু করি যাতে বাঙালির লক্ষ্মী আরাধনা আবার সফল হয়, বাংলার ঘরে ঘরে আমাদের হারানো লক্ষ্মী আবার ফিরে আসেন। কাজটা কিন্তু খুব কঠিন নয়।

Previous articleকোজাগরীর আরাধনায় স্বর্ণচুড়িতে সেজে উঠেছেন ‘শ্রীময়ী’
Next article“আমার অনুভুতির জগৎ”, তামিলনাড়ুর সৈকতে হাঁটার পর কবিতা লিখলেন মোদি