দেশাত্মবোধ

ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ

‘জনগনমন’ আর ‘আমার সোনার বাংলা’ পরপর চলাকালীন শিহরণ হয়৷ হয় ভালোভাষার জন্য। কিন্তু বিশ্বাস করুন প্রাণ পড়েছিল আমার দেশের দিকেই। খুব করে চেয়েছিলাম আমার দেশ আজ জিতুক। আমার বাড়িকে হারিয়ে দিয়ে পাশের বাড়ির ভাইগুলো জিতলে ভালো লাগতে পারে কারো? তবু তো এসব দিনে পরীক্ষা দিতে হয়।

আমার দেশ ভারতবর্ষ। যে দেশের জাতীয় সঙ্গীত আর জাতীয় গান আমার মাতৃভাষায় লেখা। যে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে আমার রাজ্যের হাজারে হাজারে ছেলেমেয়ে বলিদান দিয়েছে বা কালাপানি পেরিয়েছে। দেশটার জন্যই তো। তারপর দেশ ভাগ হয়েছে। আমি ঠিক যে ভাষায় কথা বলি, জল খাই, ভাত খাই, গান গাই সেরকমই চলনবলন, কথার ধরন থাকার পরে ও রাষ্ট্র কাঁটাতার দিয়ে দিয়েছে মাঝে। আমরা মানতে শিখেছি। একান্নবর্তী পরিবার, ভাতের হাড়ি, জ্যাঠার দালান যেভাবে ভাগ হওয়া মানতে শিখতে হয়। কোনদিন জ্যাঠার বাড়ি নিজের বাড়ির চেয়ে ভালো সত্যি বলছি বলিনি। তবু এসব দিনে পরীক্ষা দিতে হয়।

মহম্মদ ইউনুস ও বাঙালি। বাংলাদেশী বাঙালি৷ অভিজিৎ আমেরিকার ভারতীয় বাঙালি। ওই যে বললাম দেশ তো ভারত। জন্মসূত্রে আমাগো। তাই ওকেই জাপ্টে ধরেছি। বিশ্বাস করুন কলকাতার সাথে, বাংলার সাথে যুক্ত ছ’জনের নাম লিখেছি। ইউনুস ওই তালিকাভুক্ত নেই৷ ওটা অন্য দেশের লিস্টি৷ তবু তো পরীক্ষা দিতে হয়৷

কাজের সূত্রে নানা গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, প্রবাসী ভারতীয়র সাথে কথা বলতে হয়। ভারতীয় সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলি। ওপার থেকে ইংরেজিতে উত্তর আসে। আমেরিকা থাকলে উচ্চারণ ওদের মতো করে ওদের ভাষা বলে। হিন্দি আমার ভালোই লাগে বলতে কিন্তু কই ওরা তো দেখি ইংরেজিতেই বলে। প্রবাসী বাঙালি, মার্জনা করবেন, প্রবাসী ভারতীয় বাঙালি কিন্তু আমার পদবি শুনে চার ছয় লাইন ইংরেজিতে বলেই বাংলাতে ঢুকে পরে। তারপর বাংলার কথা হলে ও হতে পারে, গোল্লাছুটের মাঠের কথা, ফেলে আসা একটাকার পেপসি, শীতকালে জয়নগরের মোয়া, ওমুক লেনের তমুক নম্বর বাড়ির পাশে কচুরির দোকানটা আছে কিনা তার কথা।

হয়তো সেই প্রগাঢ় অনুভব থেকেই অভিজিৎ বিনায়ক বিশ্বদরবারে নোবেল পাওয়ার পরে প্রথম প্রেস কনফারেন্সে বাংলায় কথা বলে, স্রেফ এটুকু জানতে পেরে যে সাত সমুদ্র পার থেকে কোন বাংলা সাংবাদ সংস্থা প্রশ্ন পাঠিয়েছে। আসলে বোধহয় ওসব প্রশ্ন বাড়ির গন্ধ নিয়ে আসে। “আমাগো ঘরের ছেলের পাঠানো প্রশ্ন” ফিলিং বোধহয় ওটাকেই বলে। তথাকথিত রাষ্ট্র ভাষা নেই ওতে। তাই বলে কি দেশের জন্য গৌরব চিহ্ন রাখে না ওই নোবেল? ভয় হয়, দেশত্ববোধের প্রমাণ দিতে হবে না তো ওকে?

ছোট্ট ছোট্ট আশা প্রত্যাশা, কয়েক ডজন ভাষা, সংস্কৃতি, প্রাচীন ঐতিহ্য, নতুন ইতিহাসকে বিনিসুতোর মালার মতো তৈরি করার অপর নামই তো ভারতবর্ষ। ১৩০ কোটি মানুষের এক বিশাল দেশ। দারুণ তার বৈচিত্র্য, বিশাল তার ইতিহাস,অনবদ্য তার এক একটি গল্প। এই বহুত্বের ক্যানভাসে কিভাবে একটি মাত্র রং ব্যবহার করি বলুন ধর্মাবতার? আমরা আমাদের বৈচিত্র্য উদযাপন করে ও দেশপ্রেমিক হতে পারি।

কৈলাস সত্যার্থী নোবেল পেলে ও সমানভাবে আমরা আনন্দিত হই। খুব খারাপ লাগে গান্ধীকে শান্তির জন্য নোবেল না দেওয়ার জন্য৷ ভারতীয় হিসেবেই বলছি। পরীক্ষা নিতে চাইবেন না প্লিজ।

কিন্তু এসব আনন্দ বা ক্ষোভ জাহির তো করি বিদেশীদের সামনে। একজন গুজরাটের মানুষকে সত্যার্থীর নোবেল পাওয়া নিয়ে কি জাহির করব? সে ও তো সমান ভাগিদার আমার এই আনন্দে। কিন্তু সত্যার্থীর গ্রামের লোকের বা যে মেয়েগুলোকে ও বাঁচিয়েছে ওদের বড়াই করা সাজে। আমরা চুপটি করে সে সব গল্প শুনি। বিশ্বাস করুন ধর্মাবতার আমাদের আজ ও অন্য মতের গল্প শোনার সহিষ্ণুতা রয়েছে বাকি। দেশ ও নিয়ম করে বিরুদ্ধতার গল্প শুনুক নিয়ম করে। এই প্রস্তাব দিলাম বলে দেগে দেওয়া হবে না তো আমি বেইমান?

আসলে এই ছোট ছোট নখ দাঁতহীন প্রাদেশিক আনন্দটুকুই ছিল বিশ্বাস করুন। তারপর আপনি বললেন না, আপনার হিন্দুস্থানটাই গোটা দেশ৷ আপনার কথা বলার লব্জটাই রাষ্ট্রের বুলি৷ আমার খাবার নিয়ে আপনার বড্ড আপত্তি শুরু হলো। তারপর আমি ভয় পেলাম। ছবিতে দেখলাম কোথাও একজনের ফ্রিজে আপনার অপছন্দের মাংস ছিল বলে তাকে পিটিয়ে মেরে দেওয়া হল৷ আরও ভয় পেলাম ছিন্নমূল মানুষের মতো। ওদের দেশ ছিল। পরীক্ষা দিতে হয়েছিল৷

দেশাত্মবোধ আর জাতীয়তাবাদ বোধহয় এক না। প্রাদেশিক দেগে দেবেন না রেসে হেরে গিয়ে৷ আমরা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলে দুভাগ হলে ও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের এগারোতে আছি। আমরা সৌরভে মুখরিত হলে ও শচীনের সেঞ্চুরিতে আছি, আমরাই তো বলিউডে বচ্চন আর বাংলায় উত্তম। আমরাই তো সব সুরকার বাদ দিয়ে রহমানে দিক্ষা নিয়েছিলাম৷

সাহাব, আমাদের দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবাদ, বহুত্ববাদের মতো শব্দ শেখাতে আসবেন না প্লিজ। কলকাতায় স্রেফ একটা দিন স্ট্রিট ফুড খেয়ে কাটান৷ দেখবেন আমরা গোটা ভারতটাকে সাজিয়ে রেখেছি আপনার জন্য। কলকাতায় একটা দিন পায়ে হেঁটে ঘুরুন দেখেবেন গোটা দেশটা জমা হয়েছে ৩০০ বছরের পরতে পরতে।

ইদানিং খুব ভয় হয়৷ একদিন অনেকে এসে বলবে না তো “বল চাঁদ পশ্চিম দিকে ওঠে, বল শালা”। সূর্যের অস্ত যাওয়া ও তো পশ্চিমে, হয়তো ওটাই বলেছি এতোদিন। সূর্য নিয়ে কথা বলেছি বলে চাঁদকে অবহেলা করেছি তা কিন্তু নয়। আমি সত্যি কোনদিন ওভাবে পরীক্ষা দেওয়ার কথা ভাবিনি৷ আমার সংবিধান ভাবায়নি এতোদিন।

( ময়ূখ রঞ্জন ঘোষের ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত )

Previous articleএ কী কথা বললেন মোদি! বিরোধীরা আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন
Next articleগাড়ির ডিকি-তে পুত্র, অপহরণের অভিযোগ বাবার