ফুটবলার নয়, মানুষ সমাজপতিকে কাছে পেয়ে কেঁদে ফেললেন ইস্টবেঙ্গলের স্বর্ণযুগের কারিগর শ্রীমানী

‘খাঁটি ঘটির ছেলে, সে কি না বাঙাল ক্লাব ইস্টবেঙ্গলের কর্তা! ইয়ার্কি হচ্ছে? একে এক্ষুণি ভিতরে নিয়ে গিয়ে আমাদের মেম্বার করে দাও।’ বক্তা, মোহনবাগানের প্রবাদপ্রতিম কর্তা ধীরেন দে। একবার ধীরেনবাবুর কাছে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের একটা জরুরি চিঠি দিতে এসেছিলেন এক যুবক। তাঁকে দেখেই ধীরেন দে-র প্রশ্ন, ‘তোমার নাম অজয় শ্রীমানী না? তুমি ঘটি বাড়ির ছেলে হয়ে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে কাজ করছ?’ এরপরই একজনকে জোর গলায় ডেকে এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন ধীরেন দে।

এরপর থেকে ৫২টা বসন্ত পার হয়ে গিয়েছে। সেই থেকে আজও ইস্টবেঙ্গলের স্বর্ণযুগের কারিগর তথা প্রবাদপ্রতীম কর্তা অজয় শ্রীমানী মোহনবাগানের সদস্য! কিন্তু তাঁর হৃদয় শুধুই লাল-হলুদময়। জ্বলন্ত মশালের কক্ষপথেই আবর্তিত তাঁর আবেগ।

১৯৭০ থেকে ১৯৭৫, ইস্টবেঙ্গলের সোনালী যুগের কর্তা। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল, টানা চার বছর ফুটবল সচিব। শতবর্ষের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ইস্টবেঙ্গলের এই বর্ষীয়ান কর্তা ৮৬ বছরের অজয় শ্রীমানী তাই সিংহের মতো বলতেই পারেন, টানা পাঁচ বছর লিগ, পাস ক্লাবকে হারানো, পিয়ং-ইয়ংকে হারানো, মোহনবাগানকে পাঁচ গোল দেওয়া-তাঁর মত গর্ব ক’জনের আছে? এই রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারবে? তিনি ছিলেন সত্তরের বাদশা! অথচ, ক্লাবের স্বর্ণযুগের কারিগর ডাক পাননি শতবর্ষের আলোয় আলোকিত ইস্টবেঙ্গল প্রাঙ্গণে। যা নিয়ে ক্লাবের অন্দরেও রয়েছে বিতর্ক। যদিও এ নিয়ে অভিমানী হলেও মুখে কিছু বলতে চান না শ্রীমানী।

উত্তর কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর শতাব্দী-প্রাচীন বাড়ি। যেখানে পরতে-পরতে আভিজাত্য। ইতিহাস। শতবর্ষের ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গেই বড়ই মিল এই বাড়ির আবহ। বিছানায় শুয়ে থাকা বৃদ্ধের চেহারাতে আজও উত্তর কলকাতার বনেদিয়ানা।

                                                     ছবি – প্রকাশ পাইন

এখন অবশ্য অজয় শ্রীমানীকে দেখে বোঝার উপায় নেই, সাফল্য আর লাল-হলুদ রং, দুটোই এক সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটেছিল তাঁর জমানায়। বয়স অনেক কিছুই ভুলিয়েছে। তবে ভুলতে দেয়নি প্রিয় ক্লাবের স্মৃতি। এবার সেই স্মৃতি উসকে দিলেন, তাঁর সময়কার তারকা ফুটবলার সুকুমার সমাজপতি। শ্রীমানী যেমন ভুলতে পারেননি সমাজপতিকে, ঠিক একইভাবে সমাজপতিও ভুলতে পারেননি তাঁর সময়কার প্রবাদপ্রতীম কর্তাকে। তাই এক ফাঁকে প্রিয় দাদাকে দেখতে তাঁর বাড়িতে গেলেন সুকুমার সমাজপতি। এখানেও অদ্ভুত ভাবে এক ইস্টবেঙ্গল সংযোগ। অজয় শ্রীমানীর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়ির ঠিক উল্টো প্রান্তে শ্যামা মায়ের আরাধনায় সেজে উঠেছে শতবর্ষের ইস্টবেঙ্গল। রামমোহন রায় রোড তরুণ সংঘের এবারের কালীপুজোর থিম শতবর্ষে ইস্টবেঙ্গল। সেখানেই আমন্ত্রিত ছিলেন ষাটের দশকের ময়দান কাঁপানো ফুটবলার সুকুমার সমাজপতি। আমন্ত্রণ রক্ষা করার পর এক ফাঁকে চলে গেলেন শ্রীমানীর বাড়ি।

প্রিয় ফুটবলারকে দেখেই অসুস্থ ভগ্ন শরীর নিয়েই যেন কিছুটা অক্সিজেন পেলেন লাল-হলুদের স্বর্ণযুগের কর্তা। বেশ কিছুক্ষণ একান্ত আলাপচারিতা হলো দুজনের মধ্যে। সুকুমার সমাজপতির হাত ধরে একটা সময় কেঁদেও ফেললেন অভিমানী শ্রীমানী। বললেন, “সমাজপতি তুমি আমার কাছে শুধুমাত্র ফুটবলার নও, তার থেকেও আগে অনেক বড় মানুষ।” অবহেলিত শ্রীমানী হয়তো এই কথার মধ্যে অনেক কিছুই বুঝিয়ে দিলেন। সত্যি, এখন ক্লাবের কেই-বা তাঁর খোঁজ রাখেন। সুকুমার সমাজপতি তো এখানেই ব্যতিক্রমী। শ্রীমানীর বাড়ি গেলেন, তাঁকে দেখলেন এবং মন জয় করলেন সমাজপতি। জানলেন, তিনি প্রিয় শ্রীমানীদার কাছে একজন ফুটবলারের থেকেও আগে একজন বড় মানুষ।

আবার প্রাক্তন লাল-হলুদ কর্তা যখন জানলেন, তাঁর কাছে আসার আগে সুকুমার সমাজপতি তরুণ সংঘের পুজো ঘুরে এসেছেন, তিনি আরও বেশি খুশি হলেন। কারণ, এবার তরুণ সংঘ তো তাঁর হৃদয়ের ক্লাবকেই কিছু সময়ের জন্য বাড়ির পাশে এনে দিয়েছেন। শরীর পারমিট করলে, একবার অন্তত তরুণ সংঘে গিয়ে প্রাণের ক্লাবের শতবর্ষ থিম একবার নিজে চোখে দেখতে চান। এবং তরুণ সংঘের কর্তাদের শতবর্ষের ইস্টবেঙ্গল তুলে ধরার জন্য কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাতেও চান তিনি।

যে ক্লাবকে আজও ‘মা’ বলে ডাকেন অজয় শ্রীমানী। স্পষ্ট মনে আছে প্রথম দিন। শোনালেন সেই স্মৃতিও। ১৬ বছর বয়সে ইস্টবঙ্গলের সদস্য হয়েছিলেন ১৯৪৯ সালে। সেবার পয়লা বৈশাখের দিন বারপুজো দেখে মাঠ থেকে বের হচ্ছিলেন, হঠাৎ একজন বললেন, জ্যোতিষ গুহ ডাকছেন। তিনি গেলেন। জ্যোতিষ গুহ তাঁকে মায়ের অনুমতি নিয়ে
ক্লাবের হয়ে কাজ করতে বললেন। সে দিন রাতেই জ্যোতিষ গুহ নিজে তাঁর বাড়িতে ফোন করে মায়ের অনুমতি নিলেন। আর তরতাজা কিশোর ঢুকে গেলেন ফুটবল সাব কমিটিতে। বাকিটা ইতিহাস! এমনভাবে বলছিলেন অজয় শ্রীমানী, মনে হচ্ছিল যেন এই সে দিনের কথা!

‘৭৫ সালে মোহনবাগানকে পাঁচ গোলের পর সব ফুটবলারকে সোনার আংটি উপহার দিয়েছিলেন শ্রীমানী। নিজের জন্মদাত্রী মা-কে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন। সেই সময় গাঁটের কড়ি খরচ করে ক্লাব করতে গিয়ে তিন-তিনটে বাড়ি চলে গিয়েছে শ্রীমানীর। তার জন্য অবশ্য কোনও আফসোস নেই। নিজের চেয়েও প্রিয় ক্লাবের সাফল্যের জন্য প্রয়োজনে আরও তিনটে বাড়ি দিতে তৈরি ছিলেন তিনি।

সাতের দশককে পিছনে ফেলে বহু দশক অতিক্রান্ত। বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা জিতে নিয়েছে ইস্টবেঙ্গল। ফিফা র‍্যাঙ্কিং-এ দেশের সেরাও হয়েছে মশাল ক্লাব। তবুও ঘুরেফিরে পাস ক্লাবকে হারানো, পিয়ং ইয়ং সিটি ক্লাবকে দুরমুশ করার স্মৃতিতেই বিভোর অতীতের লাল-হলুদ ফুটবল সচিব।

এখন ক্লাবের খেলার খবর রাখেন? ভগ্ন গলায় শ্রীমানীর উত্তর, “এখন তো কিসব ডার্বি-টারবি শুনি। আমাদের সময়ে এসব কিছু ছিল না। তবে টিভিতে খেলা হলে ইস্টবেঙ্গলের সব খেলা দেখার চেষ্টা করি। দেখতে না পারলেও কারও কাছ থেকে খবর নিয়ে নি। এখন শুনি কারা সব বিদেশি আসছে। আমাদের ছেলেরা গেল কোথায়? আমার সময় তো নিজেদের ছেলে দিয়েই খেলাতাম। মাঠেও লোক আসতো।”বর্তমান কর্তারা আপনার খোঁজ খবর নেয়? বললেন বিতর্ক বাড়াবেন না। আসলে বিচিত্র সৌরজগতের বাইরে বের হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও তাঁর নেই। কারণ, ওখানেই অজয় শ্রীমানীকে আলোকিত করে চলেছে তাঁর সূর্য, গ্রহ, চাঁদ। আসলে শ্রীমানি বর্তমান লাল-হলুদ কর্তাদের রংবেরঙের আলোক ছটা নয়, সেই জ্যোতিষের মধ্যেই তিনি খুঁজে পান সূর্য-চন্দ্রকে।

Previous articleআটকে যাওয়া বাংলাদেশের সফর ফোনেই ‘অন’ করে ফেলেন মহারাজ!
Next articleসংকল্প থেকে অতিথি আপ্যায়ন- বাড়ির পুজোতে ব্যস্ত মমতা