পুনর্মুষিক ভব

কণাদ দাশগুপ্ত

সেই যে একটা গল্প আছে, সবাই পড়েছি, এক মুনির দয়ায় এক ইঁদুর প্রথমে হলো বিড়াল, বিড়াল থেকে কুকুর এবং কুকুর থেকে বাঘ। বাঘ তখন ভাবলো, যতদিন এই মুনি বেঁচে থাকবেন, ততদিন সকলেই বলবে যে আমি আগে ইঁদুর ছিলাম, মুনির দয়ায় বাঘ হয়েছি। এই ভেবে সে মুনিকে মারতে গেল। তখনই ক্ষমতা দেখালেন সেই মুনি। বাঘের গায়ে জল ছিটিয়ে মুনি বললেন, ‘খুব বড় ভাবছিস নিজেকে।ছিলি তো ইঁদুর। আমার দয়ায় বিড়াল হলি, কুকুর হলি, বাঘ হলি। এখন আমার দয়া ভুলে আমাকেই মারতে এলি। তুই দয়ার যোগ্য নয়। নে, আবার নেংটি ইঁদুর হয়ে যা। মুনি এ কথা বলামাত্রই সেই ‘বাঘ’ ফের ইঁদুর হয়ে গেলো।

একটু পাল্টে নিন। মুনি মানে এখানে জনগণ, ছেটানো জল মানে ভোট আর ইঁদুরের রঙ গেরুয়া।

হঠাৎ ফুলে ফেঁপে ওঠা বঙ্গ-বিজেপিকে অবলীলায় পাঁচ-সাত বছর আগের বিজেপি বানিয়ে দিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মোদি হাওয়ায় ডানা ভাসিয়ে বাংলার বিজেপি ইদানিং নিজেদের ‘বাঘ’ ভাবতে শুরু করেছিলো। সেই বাঘই ছেটানো জলে ‘পুনর্মুষিক ভব’। একুশের ভোটের আগে ফের শূন্য থেকে শুরু করতে হবে গেরুয়া-ব্রিগেডকে। আর ফের শুরু করার উদ্যোগের প্রথম কাজই হবে দলে এসে হঠাৎ নেতা হয়ে ওঠা ভিন দলের লোকজন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজা-উজির মারা বাস্তব-বোধহীন বাঘ হয়ে ওঠা তথাকথিত দলপ্রেমিকদের ফের ইঁদুর বানানো। এই শ্রেনির লোকজনই নানা রকম মন্তব্য করে একটু একটু করে বাংলার সাধারন মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে বিজেপিকে। তবে এ কাজ সহজ নয়। এই মুহূর্তের বঙ্গ-বিজেপি গ্যাস খেয়ে বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছে। পিঠ থেকে নামার সমূহ বিপদ। এই বিপদের কিছুটা আঁচ সম্ভবত তিন উপনির্বাচনের ফল দেখে অনুভব করতে পেরেছে আদি বিজেপির নেতারা।

কেন এমন হলো?

কারন একটাই। খেটেখুটে বড়লোক হওয়া আর লটারি লেগে বড়লোক হওয়ার মধ্যে একটা বেসিক ফারাক আছে। 2019-এর লোকসভা নির্বাচন ছিলো মোদির হাওয়ার ভোট। মোদি-শাহদের প্রচারের বন্যায় ভেসে গিয়েছিলো বাংলা। সে সবের একটা এফেক্ট আছে। সেই এফেক্টেই বাংলায় 18 আসন জিতেছিলো বিজেপি। বিজেপির অতি বড় ভক্তও বলবে না, সংগঠনের জোরে ওই ফল পেয়েছে গেরুয়া শিবির।

কিন্তু সমস্যা হলো, বঙ্গ-বিজেপির দিলীপ ঘোষ থেকে পাড়ার ভোম্বল, সবাই একযোগে ভাবতে লাগলেন, ওসব মোদি-ফোদি নয়, আমাদের দেখেই লোক দলে দলে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। আমাদের ‘গঠনমূলক’ কাজেই “উনিশে হাফ, একুশে সাফ’ হবে তৃণমূল। ছোট-বড় সব বিজেপি নেতা-কর্মীই এর পর থেকে ‘ধরাকে সরা’ ভাবা শুরু করলেন। অসংলগ্ন, বোধ-যুক্তিহীন কথায় ভাসাতে লাখলেন সোশ্যাল মিডিয়া। যারা ছোটবেলায় পাঁচজনকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ায় ছোট করে সরস্বতী পুজোও করেনি, তাঁরাই নিজেদের ‘মহা-সংগঠক’ ভাবতে লাগলেন। প্রচারসর্বস্ব চরিত্রের ভিড়ে হারিয়ে গেলো প্রকৃত বিজেপি সংগঠকরা, সঙ্ঘ-পরিবারের প্রকৃত সেবকরা। নব্যদের হাতে দলের কিছুটা রাশ চলে যাওয়ার ফলে, এরা নিজেদের স্টাইলে বিজেপি করা শুরু করলেন, যার সঙ্গে বিজেপির আদর্শগত কোনও মিলই নেই। এসবের নিট ফল, এক এক করে একাধিক পুরসভা বিজেপির ‘দখলে’ এলো এবং চলেও গেলো। বাংলার মানুষ দিনের পর দিন দেখেছে ‘এক জোড়া বন্ধু’ কীভাবে নাকে দড়ি দিয়ে বিজেপিকে নাচাচ্ছে এবং বিজেপিও নাচছে। আর তারই ফাঁকে পরিকল্পনা করেই জেলায় জেলায় ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রকৃত বিজেপি নেতা-কর্মীদের। নেতৃত্ব চলে এসেছে সদ্য অন্য দল থেকে আসা লোকজনের হাতে। তাদের সঙ্গেই এসে বিজেপিতে যোগ দিয়েছে সেই সব মুখ, যারা একদিন অন্য দলে থাকার জন্য সেই দলকেই প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলার মানুষ। সেসব না থামিয়ে, পদ্ম- নেতারা সমানে বলে গিয়েছেন, “বিজেপি দরজা বড় করেছে, সবার জন্য দরজা খোলা”। এসবের মাশুল বিজেপিকে দিতে হবে না, তা আবার হয় নাকি। বঙ্গ-বিজেপির কপাল ভালো, ভোট-টা মাত্র তিন কেন্দ্রের ছিলো। আজ যদি 294 আসনের ফল প্রকাশ হতো, তখনও কি খাতা খুলতে পারতো বঙ্গ-বিজেপি ?

এখান থেকে শিক্ষা নিতেই হবে গেরুয়া বাহিনীকে। পদ্ম-নেতাদের মাথায় রাখতে হবে, রাজ্যে যে কটা হাতে গোনা আসনকে 100% ‘সেফ’ বলে বিজেপি এতদিন ভেবে এসেছে, সে তালিকার প্রথমেই ছিলো খড়্গপুর-সদর। সেই আসনই হাসতে হাসতে কেড়ে নিয়েছে তৃণমূল। খড়্গপুরের কপালই যদি এমন হয়, তাহলে রাজ্যে বিজেপির ‘সেফ-সিট’ কোনটা?

যে কোনও রাজনৈতিক দলেরই আলটিমেট লক্ষ্য, ক্ষমতায় আসা। একুশ বছর আগে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া তৃণমূল কংগ্রেসেরও সেটাই স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নে তৃণমূল যে ত্যাগ, তিতিক্ষার পথ পেরিয়েছে, তার একাংশও কি বিজেপি করেছে ? গত 23মে বঙ্গ-বিজেপি লোকসভায় 18 আসন পেয়েছিলো। সেই হনিমুন পিরিয়ড আজও কাটেনি।

তিন উপ-নির্বাচন যদি সম্বিত ফেরাতে পারে, তাহলে একুশের ভোটে 294 আসনে অন্তত প্রার্থী দিতে পারবেন দিলীপবাবুরা। বিজেপিকে মনে রাখতে হবে, এত কিছুর পরেও নীরবে বিধানসভায় নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে তৃণমূল। এবার আরও সংহত তৃণমূলের সামনে দাঁড়াতে হবে বিজেপিকে।
ইঁদুর থেকে ‘সৎ’-বাঘ হতে ফের শূন্য থেকেই শুরু করতে হবে বিজেপিকে।

Previous articleসবুজ ঝড়ের পরেও সিপিএম বলল মানুষ তৃণমূলকে চায় না
Next articleহেলমেট পরা বোলারকে দেখুন