গেরুয়া-জমানায় নিরাপদ নন রামচন্দ্রও, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

গোটা দেশ দেখেছে গেরুয়া-জমানায় নিরাপদ নন রামচন্দ্রও৷

দেশবাসী দেখেছে,
কীভাবে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহকে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে তোলা হয়েছে পুলিশের গাড়িতে৷ তাঁর ‘অপরাধ’, বেঙ্গালুরুতে নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের প্রতিবাদে পথে নেমেছিলেন৷ সেই সময়ই আটক করা হয় এই ঐতিহাসিককে৷

প্রায় সব ক’টি নিউজ চ্যানেলেই দেখা গিয়েছে, রামচন্দ্র গুহ যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, সেই সময়ই কয়েকজন পুলিশ এসে তাঁকে ধরে। এক পুলিশকে তো রামচন্দ্র গুহকে ঘুষি মারার ভঙ্গিতেও দেখা যায়। সবাই শুনেছেন,
আটক করার সময় সাংবাদিকদের রামচন্দ্র গুহ বলছিলেন, “আমি গান্ধীজির পোস্টার হাতে নেওয়ার জন্য এবং সংবাদমাধ্যমে সংবিধান নিয়ে কথা বলায় জন্য পুলিশের হাতে আটক হয়েছি”। তাঁকে বলতে শোনা যায়, “কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশমতো কাজ করছে পুলিশ। আমরা পক্ষপাতমূলক নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করছি সুশৃঙ্খলভাবেই। সবাই শান্তিতে প্রতিবাদ করছে। তা সত্ত্বেও আমাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে”৷ নাগরিকত্ব সংশোধিত আইনের প্রতিবাদে পথে নামায় সর্বসমক্ষে নিগৃহীত হলেন তিনি৷

এ ছবি এ মুহূর্তে বিক্ষিপ্ত কোনও ছবি নয়৷ মোদি-শাহের যুগলবন্দিতে তৈরি হওয়া সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন কেন দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে লাঞ্ছিত করলো, সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার অবস্থানে কেন্দ্র আর নেই৷ এই মুহূর্তের কেন্দ্রীয় পলিসি, নাগরিকত্ব আইন নিয়ে কোনও প্রতিবাদ করা যাবে না৷ মুখ বন্ধ করে থাকতে হবে৷ কথা বলার ইচ্ছা হলে, বলতে হবে ওই বৈষম্যমূলক আইনের পক্ষে৷ না হলে রামচন্দ্র গুহকে শুধুমাত্র টেনে-হিচঁড়ে পুলিশের গাড়িতে তুলে ‘ট্রেলার’ দেখানো হয়েছে, ‘পিকচার আভি বাকি হ্যায়’৷

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সেইসব ঘটনার সঙ্গে কী ভয়ঙ্কর মিল৷
ওখানেও তো সেদিন শুরু হয়েছিলো এভাবেই….

যুগে যুগেই এটা অবধারিত যে বুদ্ধিজীবীরাই জাগিয়ে রাখেন জাতির বিবেক৷ জাগিয়ে রাখেন তাদের লেখার মাধ্যমে, সাংবাদিকদের কলমের মাধ্যমে, গানের সুরে, শিক্ষালয়ে পাঠদানে, চিকিৎসা, রাজনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের সান্নিধ্যে এসে একটা দেশ, একটা জাতিকে শাসকের অন্যায়, নীতিহীন নিষ্পেষন থেকে রক্ষা করে৷ তাই একটি জাতিকে নির্বীজ করার প্রথম উপায়, সেই দেশকে বুদ্ধিজীবী শূন্য করে দাও। 25 মার্চ রাতে বাংলাদেশে সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল অতর্কিতে৷ তারপর ধীরে ধীরে, পরাজয় অনিবার্য জেনে ডিসেম্বরের 10 তারিখ থেকে 15 তারিখের মধ্যে দ্রুতগতিতে সেই প্রক্রিয়া প্রায় শেষ করে ফেলে পাকবাহিনী আর রাজাকার-রা৷

1971- এর ডিসেম্বর মাসে, স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে পাকিস্তান বাহিনী যখন বুঝতে শুরু করে যে তাদের পক্ষে বাংলাদেশের যুদ্ধে জেতা অসম্ভব, তখন তারা সদ্যগঠিত বাংলাদেশকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল এবং পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করে৷ সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী 1971-এর 14 ডিসেম্বর রাতে ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানী বাহিনী, তাদের দোসর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একে একে তুলে এনে নির্মম নির্যাতনের পর আটক এবং গ্রেফতার করা বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো।
শহিদ হওয়া শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা জানলে চমকে যেতে হয়! বাংলাদেশ সরকারের তথ্য বলছে, বুদ্ধিজীবী-শূন্য করার ঘৃণ্য খেলার শিকার হয়েছিলেন,
◾শিক্ষাবিদ – 991 জন
◾সাংবাদিক – 13 জন
◾চিকিৎসক – 49 জন
◾আইনজীবী – 42 জন
◾অন্যান্য (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী এবং প্রকৌশলী) – 16 জন

এই পরিকল্পিত গণহত্যাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে “বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড” নামেই পরিচিত। 1971- এর 14 ডিসেম্বরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের স্মরণে প্রতিবছর 14 ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয় “শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস”।

ক্ষমতার আর সংখ্যাগরিষ্ঠতার গর্বে মদমত্ত ইয়াহিয়া খানের বিশ্বস্ত সহচর
মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি, ওই বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী।
25 মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনার সাথে একসাথেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পাকিস্তানী সেনারা অপারেশন চলাকালীন খুঁজে খুঁজে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে 25 মার্চের রাতেই হত্যা করা হয়। তবে, পরিকল্পিত হত্যার ব্যাপক অংশটি ঘটে যুদ্ধ শেষ হবার মাত্র কয়েকদিন আগে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের প্রশিক্ষিত আধা-সামরিক বাহিনী আল-বদর এবং আল-শামস বাহিনী একটি তালিকা তৈরি করে, যেখানে এই সব স্বাধীনতাকামী বুদ্ধিজীবীদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একাত্তরের ডিসেম্বরের 4 তারিখ থেকে ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারি করা হয়। ডিসেম্বরের 10 তারিখ থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নেওয়া হতে থাকে। মূলত 14 ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন হয়। অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী, লেখক-সহ চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসরেরা জোর করে তুলে নিয়ে যায়। সেদিন প্রায় 200 জনের মত বুদ্ধিজীবীদের তাঁদের বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের চোখে কাপড় বেঁধে মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ অন্যান্য অনেক জায়গায় তৈরি করা নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে তাদের উপর বীভৎস নির্যাতন চালানো হয়। পরে তাদের রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে
নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

সংসদে যেহেতু গরিষ্ঠতা আছে, কেন্দ্র তথা বিজেপির তাই বদ্ধমূল ধারনা, নাগরিকত্ব আইন সবাই মুখ বন্ধ করে মেনে নেবে৷ প্রতিবাদ হলে প্রাথমিকভাবে পুলিশ আছে৷ বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির পুলিশকে
প্রতিবাদকারীদের
উপর নির্বিচারে নির্যাতন চালানো বা আটক- গ্রেফতারের ঢালাও অনুমতি দেওয়া আছে৷ এর পরের ধাপে আছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল৷ সঙ্গে আছে গোলা- বারুদ- ফৌজ৷ প্রতিবাদীদের কন্ঠরোধ করার হাতিয়ার তো রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে থাকেই৷

নাগরিকত্ব বিধি চুপ করে মেনে নেওয়াতে ব্যাকফুটে থাকা বঙ্গ- বিজেপি’র ‘ত্রাতা’ এখন কট্টর কমিউনিস্ট ঋত্বিক ঘটক৷ আর জাতীয়স্তরে 1971-এর বাংলাদেশে প্রয়োগ করা অপারেশন-সার্চলাইট৷ রামচন্দ্র গুহের প্রতিবাদ না-পসন্দ হওয়ায়, রাস্তা থেকে তাঁকে টানতে টানতে তোলা হয়েছে পুলিশ ভ্যানে ৷ কেন্দ্র আশাবাদী, এই ঘটনায থেকে দেশের শিক্ষিত-বুদ্ধিজীবী সমাজ
ভীত হবেন, শিক্ষা নেবেন৷ নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় ভারতের বুদ্ধিজীবী সমাজ আর অংশ নেবেননা৷ আর এরপরেও এই ধরনের প্রতিবাদ-বিক্ষোভে বুদ্ধিজীবী সমাজ পা মেলালে, হয়তো কেন্দ্র 1971-এর বাংলাদেশের ‘অপারেশন-সার্চলাইট’- কেই কপি-পেস্ট করবে৷ জানা নেই সঠিক, তবে রামচন্দ্র গুহ-কাণ্ডের পর সেই আশঙ্কা রয়েছে পূর্ণমাত্রায়৷

ক্ষমতা ধরে রাখতে সব শাসকদের মনোভাব বোধহয় এক সুরেই বাঁধা থাকে৷

Previous articleঅশান্তি থামাতে পুলিশের আশ্রয় জাতীয় সঙ্গীত
Next article“মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যে গভীর মর্মাহত”, টুইটারে জানালেন ধনকড়