তাল কেটেছে সম্ভবত একটি ফোনে, কণাদ দাশগুপ্তের কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

গত কয়েকদিন ধরেই বেলুনে গ্যাস ভরছিলেন তিনি৷ শুক্রবার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে গ্যাসভরা বেলুন উড়িয়ে দেবেন, বারংবার এমনই গর্জন করেছিলেন তিনি৷ তিনি মানে রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়৷

কিন্তু তেমন কিছু হওয়া তো দূরের কথা, রাজ্যপাল যখন বিধানসভার অধিবেশন কক্ষের নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাষন দিচ্ছিলেন, মনে হয়েছে শাসক তৃণমূলের কোনও নেতা বক্তৃতা দিচ্ছেন৷ অবিকল এক কথা, এক তথ্য, এক সুর৷

এতদিন ধরে একটা ‘বিদ্রোহী’ ইমেজ তৈরি করার পর সেই ধনকড় সাহেবই কেমন অবলীলায় এদিন রাজ্যের পাশে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রকে দুষে বলে গেলেন, “ভিন্ন মতকে প্রত্যাখ্যান করাই নতুন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। CAA, NRC এবং NRP-এর নামে বিভেদ সৃষ্টি করছে কেন্দ্রীয় সরকার।” একই সঙ্গে CAA আইন প্রত্যাহার করতে কেন্দ্রের কাছে আর্জিও জানান তিনি৷ CAA বিরোধী আন্দোলনে যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের জন্য দুঃখ প্রকাশও করেছেন রাজ্যপাল। লোকসভায় তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে সরস্বতী পুজোয় বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন হুগলির বিজেপি সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়। এ দিন লকেটের অভিযোগ খারিজ করেছেন রাজ্যপাল। রাজ্যে সব উৎসব একই রকম ভাবে পালিত হয়েছে বলে জানিয়ে দেন তিনি।

তাই প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে একেবারে শেষমুহুর্তে ধনকড়ের বেলুনে কে ফুটিয়ে দিলো পিন ? সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজের স্ট্যাণ্ড অনড় ছিলেন রাজ্যপাল৷ রাজ্যের পাঠানো বক্তৃতার খসড়া হুবহু পড়বেন না, একপ্রকার ঠিকই করে রেখেছিলেন৷ সাংবিধানিক ঘেরাটোপে থেকে যতখানি হাঁটা যায়, ততখানি হাঁটতে তিনি তৈরি৷ ঘনিষ্ঠমহল সূত্রে জানা গিয়েছে, বিশেষত আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে রাজ্যকে খোঁচা দেওয়ার ভাষাও তাঁর তৈরি ছিলো৷

কিন্তু তাল কেটেছে সম্ভবত রাতের দিকে আসা একটি ফোনে৷ দুয়ে দুয়ে মেলালে এটাই স্পষ্ট হচ্ছে ওই ফোনের পরই রাজ্যপালের পশ্চাদপসরন শুরু৷ জানার সুযোগ নেই ফোনের ওপারে কে ছিলেন, কথার বিষয়বস্তুই বা কী ছিলো? তবে ধরে নেওয়াই যায়, ওই ফোনই রাজ্যপালকে টেনে ধরেছে৷ ওই ফোনই রাজ্যপালকে ‘শাসক দল’-এর নেতা বানিয়ে দিয়েছে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারনা৷

টানা ৭দিন ফুটেজ খাওয়ার পর শুক্রবার রাজ্যপাল সাহেব বাজেট অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে বললেন:

◾ আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, বিগত বছরে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ ছিলো৷
◾ পশ্চিমবঙ্গের কোথাও কোনও গুরুতর অশান্তির ঘটনা ঘটেনি৷
◾ সারা রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুন্ন ছিলো৷
◾ দুর্গাপুজোর আনন্দোৎসব কার্নিভালের মধ্য দিয়ে যার পরিসমাপ্তি ঘটে, দীপাবলী, ছটপুজো, ঈদ ও বড়দিন-সহ সকল ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের উৎসব চিরাচরিত উৎসাহ ও উদ্দীপনা সহকারে উদযাপিত হয়েছে৷
◾গত এক বছরে শান্তি-শৃঙ্খলা ছিল শান্তিপূর্ণ।
◾কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
◾জঙ্গলমহল রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নের শরিক হয়েছে।
◾মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বের জন্য এটা সম্ভব হয়েছে।
◾আমাদের প্রিয় দার্জিলিং আজ শান্তিপূর্ণ।
◾ যদিও স্বার্থান্বেষিরা গণ্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করেছে।
◾ সংখ্যালঘুদের স্কলারশিপে দেশের শীর্ষে বাংলা। ২ কোটি ৩ লক্ষ সংখ্যালঘু পড়ুয়া উপকৃত হয়েছেন।
◾সবুজ সাথী প্রকল্পে ১ কোটি সাইকেল দেওয়া হয়েছে।
◾ ৬০ লক্ষ ২৮ হাজার জন কন্যাশ্রী পেয়েছেন।
◾সারা রাজ্যের ৭ কোটি ৭১ লক্ষ মানুষের কাছে ২ টাকা কেজির চাল পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
◾নির্মল বাংলা প্রকল্পে ২২৭৫টি জন-শৌচালয় তৈরি হয়েছে।
◾স্বামী বিবেকানন্দ কর্মসংস্থান প্রকল্পে ১৩,৩২৫ যুব উপকৃত হয়েছেন।
◾১০০ দিনের কাজে কর্মদিবস তৈরি হয়েছে ৩৩ কোটি ৮৩ লক্ষ।

এমন কথাই টানা বলে গেলেন৷ রাজ্যপালের বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ দেখেও বোঝা যায়নি, তিনি ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ সব বলছেন৷ প্রশ্ন অজস্র ঘুরে বেড়াচ্ছে চারধারে৷ তবে আপাতত ওনার বিপ্লবের সমাপ্তি৷ পরে আবার দেখা যাবে৷

রাজনৈতিক মহলই শুধু নয়, রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই এখন একটাই কথা, রাজ্যপাল কেন এমন করলেন? রাজ্যপাল জানতেন এমন কথা উঠবেই৷ তাই রাজভবনে ফিরেই “সাফাই”- টুইট করেন ধনখড়। তিনি লেখেন, ‘‘সংবিধানের মর্যাদা রেখেই আজকে ভাষণ দিয়েছি আমি। আমার আশা, সকলেই সংবিধানের প্রতি আনুগত্য দেখাবেন। এ ভাবেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বাড়িয়ে মানুষের সেবা করা যায়।’’

আর একটা কথা, বিধানসভা থেকে ফেরার সময় রাজ্যপালকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন-প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সংসদীয় মন্ত্রী কি প্রথা ভাঙবেন ? কণাদ দাশগুপ্তের কলম

Previous articleমারধরের জেরে প্রাণ হারালেন এক ব্যক্তি, তদন্তে নিমতা থানার পুলিশ
Next article‘বেহুলা’: নাম মাহাত্ম্যে অন্যরকম শিল্প উৎসব বেহালায়