আমাদের মতো চচ্চড়ির মশলা দিয়েই বিরিয়ানি করেছেন প্রদীপদা, শ্রদ্ধা জানালেন মানস ভট্টাচার্য

ভারতীয় ফুটবলের আরও এক মহীরুহের পতন হলো৷ প্রদীপদা যে আর আমাদের মধ্যে নেই, এই কথা ভাবতেই পারছিনা। খবরটা যখন প্রথম পেলাম, তখন কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ভাবছিলাম এই মানুষটা আমাদের জন্য, আমাদের ফুটবলের জন্য কত কী করে গিয়েছেন।

খেলোয়াড়ি জীবনে প্রদীপদা বিরাট মাপের খেলোয়াড় ছিলেন৷ যদিও
তাঁর খেলা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি।
তবে প্রদীপদার কোচিং জীবনের বেশ কিছুটা সময় আমি তাঁকে পাশে পেয়েছিলাম। তাঁর চোখে আমি প্রথম পড়লাম ১৯৭৩ সালে৷ এই মানুষটা আমার কাছে তখন স্বপ্নের মতো ছিলেন। আমি শুনেছি, ভেঙ্কটেশদার পরে এত বড় মাপের খেলোয়াড় ভারতীয় ফুটবলে আর আসেনি। আমি প্রথম তাঁকে দেখেছিলাম এক বিকেলে, একটা স্কুটারে৷ আমি তখন ক্যালকাটা জিমখানায় প্র্যাকটিস করছি বিজিপ্রেস মাঠে। ওটাই প্রথম তাঁকে দেখা। কোনওদিন ভাবিনি এই মানুষটির কোচিংয়ে একদিন আসতে পারবো, ভাবিনি এনার কাছে প্র্যাকটিশ করেই আমি মোহনবাগান বা ভারতীয় দলে খেলার সুযোগ পাবো। এটা তখন কোনও স্বপ্নেও আমার ভাবনায় আসেনি৷ কিন্তু এই স্বপ্ন সফল হয়েছিলো৷

প্রদীপদা খেলোয়াড় হিসেবে কেমন ছিলেন? এর উত্তর একটাই, মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল বা মহামেডানে না খেলেই তিনি আপন দক্ষতায় ভারতীয় ফুটবলে নিজের জায়গা পাকা করেছিলেন৷ এটা কম বড় কথা নয়। তিন প্রধানের খেলোয়াড়রাই ভারতীয় দলে জায়গা পেতেন। প্রদীপদা সেই প্রথা ভেঙেছিলেন ইস্টার্ণ রেল থেকে সরাসরি ভারতীয় জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়ে ৷
রহিম সাহেবের খুব প্রিয় ছিলেন প্রদীপদা। কোচ হিসাবে আমি প্রদীপদাকে পাই ১৯৭৭ সালে, আমি মোহনবাগানে যোগ দেওয়ার করার পর। সে বছরই আবার পেলের সঙ্গে খেলার সুযোগ আমার হয়েছিলো।

প্রদীপদার কোচিংয়ের প্রথম পর্বের অভিজ্ঞতাটা আমার খুব ভাল ছিলো না। পর পর হেরেছি৷ আইডিয়ার কাছে আমরা হেরে গিয়েছিলাম প্রথম ফেডারেশন কাপে৷ কলকাতা লিগেও ইস্টবেঙ্গলের কাছে হেরে সেবার লিগ পাইনি আমরা। দারুণ চাপের মধ্যে ছিলো মোহনবাগানের খেলোয়াড়েরা। কিন্তু এই প্রদীপদার হাত ধরেই আস্তে আস্তে সেখান থেকে আমরা বেরিয়ে আসি। আর তারপর আমরাই জ্বলে উঠি৷ ডুরান্ড, রোভার্স, আইএফএ শিল্ড পর পর জিতে নতুন নজির তৈরি করেছিলাম।

আজ মনে পড়ছে, এই প্রদীপদাই আমাদের নিয়ে সে বছর বলেছিলেন, “চচ্চড়ির মশলা দিয়ে কি আর বিরিয়ানি তৈরি করা যায়?” কিন্তু প্রদীপদা বর্ষশেষে সেই চচ্চড়ির মশলা দিয়েই বিরিয়ানি তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন৷ প্রদীপদা
কোনও সময় হারতে চাইতেন না, সবসময় জেতার মধ্যে থাকতে চাইতেন। আর বড় ম্যাচের আগে ‘ভোকাল টনিক’ দিয়ে আমাদের সেই কথাটাই বোঝাতেন৷ ওই মানের ভোকাল-টনিক ভারতীয় ফুটবলের অন্য কোনও কোচ দিয়েছেন বলে আমার জানা নেই৷

আজ এখন কত কিছু মনে পড়ছে৷ স্মৃতি রোমন্থনে সব ব্যক্ত করতেও পারছি না। গত কয়েকদিন ধরে কীভাবে জীবনমরণ সংগ্রাম করে গিয়েছেন তিনি। অসুস্থতার সময়ে সামনে দাঁড়িয়ে যখন প্রদীপদাকে দেখছিলাম, তখনই ভাবছিলাম, এই মানুষটাই আমাদের বলেছেন, জীবনজুড়েই ফাইট করে যেতে হবে। শেষ রক্তবিন্দু থাকতে থাকতে কিছু একটা করে দেখাতে হবে৷ লড়াইয়ের মধ্য থেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে৷ এবং প্রতিপক্ষকে বুঝিয়ে দিতে হবে, যে তুমি মাঠে আছো। এই কথা আজও আমি মেনে চলি প্রতিটি পদক্ষেপে৷

প্রদীপদা আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। খুব খারাপ লাগছে। ওনাকে দ্রোণাচার্য বলা হয়৷ সত্যি, ভারতীয় ফুটবলে তিনিই একমাত্র দ্রোণাচার্য। ওনার কোচিংয়ে প্রচুর ফুটবলার উঠে এসেছে। কিন্তু আমি এবং বিদেশ বসু তাঁর কাছে সারাজীবন উপকৃত থাকবো। আমার মনে আছে যখন আমাদের মানস-বিদেশ জুটি তেমন সাফল্য পাচ্ছিলো না । দল ভালো খেলছিল না, তখন প্রদীপদা পুজোর ছুটির সময়েও সব ফেলে আমাকে আর বিদেশকে নিয়ে মোহনবাগান মাঠে প্র্যাকটিস করিয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, পুজোর সময়ও বাড়িতে থাকতে দেবেন না। উনি বলেছিলেন, আমিও পুজো দেখবো না, তোদেরও পুজো দেখতে দেব না। কারণ তোরা ভালো ফুটবল খেলিসনি। তোরা হেরেছিস ডুরান্ড -রোভার্সে। তোদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আর তোদের দু’জনকে যদি ভালো তৈরি করতে পারি, তাহলে আমার দল ফের ভালো খেলবে।

১৯৭৯ আমি সর্বোচ্চ গোলদাতার সম্মান পেয়েছিলাম। কলকাতা লিগ জিতেছিলাম। আইএফএ শিল্ড জিতেছিলাম। ডুরান্ড জিতেছিলাম প্রদীপ দার কোচিং-এ৷ আমার এটা বড় পাওনা। প্রদীপদা সব সময় একটু তুক-তাকে বিশ্বাস করতেন। যেদিন খেলা থাকতো এক জামা, এক প্যান্টে আসতেন। এই তুকটা আমার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। আমিও যখন মোহনবাগানে খেলতাম, আমিও একটা পুরনো জামা, পুরনো প্যান্ট পরে আসতাম। আমাকে দেখে বিদেশ আর অন্য বন্ধুরা কিছুটা রসিকতা করতো। কিন্তু আমি ছাড়িনি, এই তুকের ফলও পেয়েছি৷ প্রদীপদার ডান হাতে অনেক তাবিজ থাকতো।মাঠে নামার আগে ওই তাবিজগুলো আমাদের গায়ে একবার স্পর্শ না করে দিলে হয়তো আমরা গোল করতে পারবো না, এই ধারণা ওনার ছিল। এবং উনি আন্তরিকভাবেই আমাদের গায়ে ওসব স্পর্শ করাতেন। আমরা সাফল্যও পেতাম৷ অত্যন্ত ভালো ও বড় মনের মানুষ ছিলেন প্রদীপদা। জিতলে বাড়িতে নিমন্ত্রন করে আমাদের খাওয়াতেন। প্রদীপদা ছোট-বড় বিভেদ করতেন না। প্রদীপদা সবাইকে একসূত্রে গেঁথে দলের কোচিং করানোর চেষ্টা করতেন। অনেক তরুণ ফুটবলারকে নিয়ে এসেছিলেন তার সুযোগ্য কোচিংয়ে। তাদের বেশিরভাগই সফল হয়েছিলো৷ আর কোনও কোচ এত সংখ্যক সফল ছাত্র পেয়েছিলেন কি’না সন্দেহ৷

প্রদীপদা যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। তাঁর শোকস্তব্ধ পরিবারকে সমবেদনা জানাই। আর আমার মতো প্রাক্তন ফুটবলারদের তরফ থেকে তাকে শতকোটি প্রণাম জানাই। আমাদের ওপর যেন তাঁর আশীর্বাদের হাত সব সময় থাকে।

অনুলেখন : সুপর্ণা দে

Previous articleএন আর এসে রোগীর আত্মীয়দের থাকা নিষিদ্ধ
Next articleদেশাইয়ের মুত্র থেরাপি কিংবা গোমুত্র থেরাপি, কোনোটাতেই মান্যতা দেয়নি বিজ্ঞান