খেলা দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তবে জঙ্গলমহল সফরে চুনী গোস্বামীর অদম্য মানসিকতা দেখেছিলাম

সোমনাথ বিশ্বাস

ফের একজন অভিভাবক হারালো ময়দান। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে চলে গেলেন বাংলা ক্রীড়া জগতের দুই নক্ষত্র। প্রথমে পিকে ব্যানার্জি। এবার ময়দান হারালো চুণী গোস্বামীকে। দুই কিংবদন্তির ফুটবল শৈলী সামনে থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। চুণী গোস্বামী তো আবার ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেট, হকি, লন টেনিসও সমান পারদর্শী ছিলেন। তাঁর বর্ণময় খেলোয়াড়ি জীবনের সিংহভাগই জড়িয়ে আছে মোহনবাগানের সঙ্গে।

তবে এসবই বাবা-কাকাদের মুখে শোনা। তাঁর সম্বন্ধে আরও কিছুটা জেনেছি বই পড়ে। কিছু গল্প আবার জেনেছি আমার পেশায় যুক্ত সিনিয়রদের থেকে। খেলা না দেখলেও, রক্ত মাংসের মানুষটিকে খুব কাছ থেকে দেখার বা কথা বলার সৌভাগ্য বেশ কয়েকবার হয়েছে। তবে ওই যে, কিংবদন্তির ক্রীড়া শৈলী চাক্ষুস না করার আফসোসটা রয়েই যাবে।

চুণী গোস্বামীর মতো ব্যক্তিত্ব শুধুমাত্র একজন বড়মাপের খেলোয়াড়ই নন, তিনি নিজেই একজন প্রতিষ্ঠান। প্রয়াণকালে তাঁকে নিয়ে বা তাঁর খেলোয়াড়ি দক্ষতা নিয়ে বিশেষ কিছু লেখার বা বলার ধৃষ্টতা বা দুঃসাহস দেখানো আমার সাজে না। কারণ সেটা আমি সামনে থেকে দেখিনি।

তাই তাঁর সঙ্গে কয়েক মুহূর্ত কাটানোর একটা ছোট্ট অভিজ্ঞতা পাঠকদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। বিষয়টি অবশ্যই চুণী গোস্বামীর সংকল্প-অদম্য জেদ-দৃঢ় মানসিকতার। সত্তর বছর বয়সেও তাঁর সেই ইচ্ছাশক্তি দেখে জীবনে চলার পথে আমিও অনেকাংশে অনুপ্রাণিত হয়েছি। কারণ, ওই বয়সের একজন মানুষের এমন অদম্য জেদ পরিচয় বহন করে খেলোয়াড়ি জীবনে তাঁর দৃঢ় মানসিকতার।

সাল ২০১১। মাস ঠিক মনে নেই। জুলাই কিংবা অগাস্ট হবে।
ক্রীড়া সাংবাদিকতার সুবাদে তখন এক ঐতিহাসিক অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল বহুচর্চিত জঙ্গল মহলে। কয়েক ঘন্টার ওই ছোট্ট সফরে গিয়েছিলেন চুণী গোস্বামীও। জঙ্গল মহল যাওয়ার পথেই আকস্মিক একটি ঘটনায় সামনে থেকে পরিচয় ঘটেছিল চুণী গোস্বামীর জেদ ও দৃঢ় মানসিকতার সঙ্গে।

ঠিক তার কয়েক মাস আগে রাজ্যে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পালা বদল ঘটেছিল। দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম জমানাকে ধুলিস্যাৎ করে ক্ষমতায় এসেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের “মা-মাটি-মানুষের” সরকার। যে সরকারের প্রথম ক্রীড়ামন্ত্রী ছিলেন মদন মিত্র। মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় এবং মদন মিত্রের উদ্যোগে তথাকথিত মাওবাদী অধ্যুষিত জঙ্গল মহলে একটি প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ আয়োজিত হয়েছিল। খেলাটি হয়েছিল জঙ্গল মহল একাদশের সঙ্গে সেবার সন্তোষ ট্রফি চ্যাম্পিয়ন বাংলা দলের (IFA একাদশ) মধ্যে।

নেতাজি ইন্ডোর থেকে সকাল ৬টায় রওনা দিয়েছিলাম আমরা ক্রীড়া সাংবাদিক ও চিত্র সাংবাদিকরা। একই সঙ্গে অন্য একটি গাড়িতে ছিল IFA একাদশের ফুটবলাররা। এবং আরও বেশকিছু গাড়িতে ছিলেন অতীতের একঝাঁক দিকপাল ফুটবলার ও প্রশাসনিক লোকজন। যার মধ্যে জ্বল জ্বল করছিলেন চুণী গোস্বামী। নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসার সমস্ত ব্যবস্থাই করেছিল রাজ্য সরকার ও ক্রীড়া দফতর। যেহেতু তখনও জঙ্গল মহলে টাটকা ছিল “মাওবাদী আতঙ্ক”, তাই প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিক কনভয় ছিল আমাদের সঙ্গে।

অনেকটা পথ। তারপর পশ্চিম মেদিনীপুর সার্কিট হাউসে পৌঁছে লাঞ্চ সেরে সময় মতো জঙ্গল মহলের একেবারে শেষপ্রান্তে প্রবেশ। খেলা শেষ হওয়ার পরই বেরিয়ে পড়তে হবে। ঝুঁকি না নিয়ে সন্ধ্যার আগেই এলাকা ছেড়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা, ইত্যাদি কারণে একটু দ্রুত যাওয়ার পরিকল্পনা থেকে বেশ দ্রুততার সঙ্গেই সারি ধরে যাচ্ছিল একাধিক গাড়ি। আর সেখানেই বিপত্তি। কোলাঘাট ঢোকার আগেই ছোট্ট দুর্ঘটনা। পরপর দুটি গাড়ির মধ্যে ব্রেক ফেল জনিত কারণে হালকা সংঘর্ষ। যার মধ্যে একটি গাড়িতে ছিলেন চুণী গোস্বামী। বাকিদের বিশেষ কিছু না হলেও দু-পায়ে ভালো রকমের চোট পান চুণী গোস্বামী। বেশ বোঝা যাচ্ছিল, তাঁর দাঁড়াতে প্রচন্ড অসুবিধা হচ্ছিল। বেশ যন্ত্রনাও ছিল।

অন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। কিন্তু নারাজ ছিলেন চুণী গোস্বামী স্বয়ং। কারণ, হাসপাতালে গেলে তাঁর জঙ্গল মহল যাওয়া হতো না। তাই কারও কথা না শুনে সেই চোট পাওয়া পা নিয়েই গেলেন জঙ্গল মহল। সারাক্ষণ ম্যাচ দেখলেন। উৎসাহিত করলেন দু’দলের ফুটবলারদের। সকলের মন জয় করলেন। তারপর সেই আঘাত পাওয়া পা নিয়েই রাত ১০ টায় আমাদের সঙ্গেই ফিরলেন কলকাতায়।

এই গোটা সফরকালে চুণী গোস্বামীর সঙ্গী থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। জিজ্ঞাস করেছিলাম, এতটা চোট নিয়ে এতো দূরে না এলেই হতো না? সোজাসাপটা উত্তর, পায়ের চোট সেরে যাবে, কিন্তু এমন ঐতিহাসিক ম্যাচ না দেখলে হৃদয়ে যে চোট লাগতো, তা সারার নয়। না আসতে পারার আফসোস টা থেকেই যেতো। সেই ছোট্ট একটা উত্তরেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, মাঠে নেমে হোক কিংবা মাঠের বাইরে ফুটবলের জন্য তিনি সবকিছু ত্যাগ করতে পারেন, কিন্তু কোনওকিছুর জন্য ফুটবলকে ত্যাগ করতে পারবেন না।

আসলে যুগ যুগ ধরে জিনিয়াসরা হয়তো এমনই হয়।ব্যতিক্রমী ছিলেন না চুণী গোস্বামীও। ছোট্ট ওই ঘটনার মধ্যে দিয়েই উপলব্ধি করেছিলাম, খেলোয়াড়ি জীবনে এমনই নিষ্ঠা-অদম্য জেদ-দৃঢ় মানসিকতা-দায়বদ্ধতাই তাঁকে কিংবদন্তি বানিয়েছিল। কোনও ম্যাজিক থেকে সাফল্য ধরা দেয়নি তাঁকে। প্রয়াণকালে কিংবদন্তিকে জানাই প্রণাম।
তাঁর মৃত্যুতে দেশ তথা বাংলা ক্রীড়া মহলে একটা যুগের অবসান ঘটলো।

Previous articleচুনীর সোনালী দিন
Next articleদেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বিনিয়োগে গতি আনার পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীর