মানুষ এখন সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত মানুষকে নিয়ে!

দেবাশিস বিশ্বাস

Lock down চলছে। আরো কতদিন চলবে তা কেউ জানেনা। আর 10 দিন? 1মাস? 3 মাস? 6 মাস? সবই সম্ভব। এর সাথে ঘুরছে আতঙ্ক, আর সামাজিক দূরত্ব পালনের নামে সমাজচ্যুত হয়ে যাওয়া। তা হোক, কিন্তু একদিন না একদিন এই lock down উঠবেই, তখন রোগ কেমন থাকবে, কতজন বেঁচে থাকবে বা অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন থাকবে সে সব না হয় তখন বোঝা যাবে। কিন্তু lock down উঠবেই, ধরাই যাক গোটা 2020 সাল lock down থাকলো এবং 2021 সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে মৃত্যুমিছিল টিছিল পেরিয়ে দেশ lock down মুক্ত হল। কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি এই সময়ে আপনি আপনার পাশের মানুষের থেকে কত দূরে চলে গেছেন? Social distancing এর নামের আড়ালে ফিরে আসবেনা তো অস্পৃশ্যতা নামক ভয়াবহ অভিশাপ? এটাও কোনো উদ্ভট কল্পনা নয়, এর লক্ষণ কিন্তু স্পষ্ট। এর অনেক উদাহরন আমার নিজের দেখা ঘটনা থেকেই দিতে পারি, অনেকেই পারেন। যে হাত আপনি ছেড়ে দিয়েছেন নিজে বাঁচার তাগিদে, সেই হাত ই কিন্তু আপনাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য খুব দরকার ছিল। করমর্দন ছেড়ে নমস্কার ধরেছেন, ভালো করেছেন, কিন্তু নমস্কার টা দূর থেকে করেও কেটে পড়া যায়।
ভেবে দেখেছেন মানুষ এখন সবচাইতে বেশি আতঙ্কিত “মানুষ” নিয়েই। কোথায় কি রোগ হল বা হলনা আপনি আপনার বাড়ির দীর্ঘদিনের পরিচারিকা কে বিদায় দিলেন, প্রথমে বললেন সবেতন ছুটি দিলেন, তার কিছু কাল পরেই বললেন সারা মাস কাজ করেনি, কেন পুরো পয়সা দেব? বিনা দোষেই যে মানুষটি ঝড় জল বৃষ্টি রোদ উপেক্ষা করেই রোজ সকালে খবরের কাগজ দিয়ে যেতেন, তাঁকে বিদায় দিলেন। এরকম বহু অন্যায় করলেন আপনার নিজের ভিতরে বসবাস করা এক অদ্ভুত হিংস্রতা থেকে। এবং অনেকেই নিজেই শুধু বিদায় দিলেন তাই নয়, অন্যের বাড়িতেও খবর কাগজ, পরিচারিকা গায়ের জোরে বন্ধ করলেন। ভাবলেন আগে তো Covid থেকে বাঁচি, তারপর অন্য কিছু। সরে গেলেন সমাজ থেকে।
আমার চিন্তা, যে সমাজ তৈরি হল বা হচ্ছে সবার গোচরে বা অগোচরে, সেই সমাজে একটু বয়স্ক, অসুস্থ, দুর্বল বিশেষ করে যাঁরা প্রতিবন্ধী, তাঁরা বাঁচতে পারবেন তো? আপনি পড়ে থাকবেন, বিপদে কাতরাবেন, কেউ এগিয়ে আসবেনা। একলা চলার মতন মনের জোর বেশিরভাগ মানুষের নেই, তাঁদের অন্যের সহযোগিতা লাগে। এবং এটাই স্বাভাবিক। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, হাতি, ভেড়া, হরিণ ইত্যাদির মতন, বাঘ, সিংহ এদের মতন একা বাঁচতে পারেনা। নৃ তত্ত্ব বিদ রা সংশোয়াতীতভাবে প্রমান করেছেন, মানুষ প্রথমে শিখেছিল “আমরা”, পরে শেখে আমি। বড় নির্দয়, হৃদয়হীন হয়ে যাচ্ছে সমাজ, যেখানে অভুক্ত ক্লান্ত বিপর্যস্ত মানুষ রেলে কাটা পড়লেও বহু বহু মানুষ বলছে, ওরা নিশ্চিত মাল খেয়েছিল, না হলে রেল লাইনে কেউ শুতে যায়? এরকমই হয়ে যাবে দুনিয়া, ও তো বুড়ো, ওকে বাইরে বেরোতে কে বলেছিল? ও তো চোখে দেখেনা বা হাঁটতে পারেনা তার আবার বেড়াতে যাবার শখ কেন?
অদ্ভুত কি জানেন? এই সামাজিক আঘাত কিন্তু দরিদ্র, শ্রমিক, মজুরদের কোনোভাবেই প্রভাব ফেলবেনা, কারন তাঁরা মৃত্যুর সাথে লড়াই করে করে বাঁচতে শিখে গেছে, তাঁদের বেঁচে থাকার জন্য কোনো WHO/ICMR এর পরামর্শের দরকার পড়েনা। তাঁরা জানেন বাঁচতে গেলে দল বেঁধেই বাঁচতে হবে, একা বাঁচা যাবেনা। তাই তাঁরা কেউ কারো হাত তো ছাড়েই নি, বরং এই দুর্দিনে একজন আরেকজনের হাত আরো জোরে চেপে ধরে রেখেছেন। তাঁরা জাত, ধর্ম, পার্টি, ইউনিয়ন এসব ধুয়ে মুছে সাফ করে আরও কাছাকাছি এসেছেন। এছাড়া অতি ধনীদের কোনো সমস্যা কোনোকালেই হয়নি, এবার ও হবেনা, তাঁরা চির অসামাজিক, টাকাই তাঁদের ক্ষমতা, এই সময়ে নানান অছিলায় তাঁরা টাকার যোগান আরো বাড়িয়েছেন এবং তাকেই আঁকড়ে ধরেছেন। এরপর আসছেন কিছু মধ্যবিত্ত কিন্তু সাহসী মানুষ, যাঁদের মনের জোর প্রচণ্ড, মৃত্যুর ভয় ও তেমন নেই। এই অংশটা এতদিন যে কোনো বিপদে অন্যের সমস্যায় ঝাঁপিয়ে পড়তো, নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করতে পারেন। এঁরা এই রোগটাকে কোনো গুরুত্ব ই দেননি, পুরো ঢপ বাজি ভেবেছেন এবং দুঃখের কথা এঁরাই অন্য লোকের ব্যাঙ্গের কারণ হয়েছেন, যেন এঁদের বাহাদুরি র জন্যই সবার বিপদ। এই মানুষ গুলোও এই বিপদের সময় নিজের ক্ষমতা অর্থাৎ সাহস সঞ্চয় করেছেন, তাঁরা বুঝে নিয়েছেন আশে পাশের সব্বাই ভয়ে কাঁপলেও তাঁদের যখন কিছুই হলনা, তাঁদের আত্মবিশ্বাস আরো আরো জোরালো হয়ে গেছে এবং এইজাতীয় মানুষেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে নিয়েছেন। Covid মধ্যবিত্ত সমাজকে স্পষ্ট দুইভাগে ভেঙে দিয়েছে। একদল রোগটিকে প্রচণ্ড গুরুত্ব দিয়েছেন, আরেকদল এই রোগটিকে বড় কোনো সমস্যা মনেই করেননি।
দুর্ভাগ্যের কথা আতঙ্কিত মানুষগুলো এই সময়ে কেবল গুজব আর আতঙ্ক সঞ্চয় করেছেন। তাঁদের যেটুকু মনের জোর ছিল, তাও আজ তলানিতে।
সবাইকে একসঙ্গে এক বিচ্ছিন্ন জগতে নামতে হবে বেঁচে থাকলে। যেখানে কেউ কারো নয়। আপনার বয়স্ক পিতাকে বা প্রতিবন্ধী ভাইকে ঠেলে ফেলে দেবে অন্যরা। কেউ এগিয়ে আসবেনা সাহায্য করতে। সাহায্যের হাত এমনিতেই কমে আসছিল, যে কটা টিকেছিল সেগুলো ও ভেঙ্গে গেছে।
বড় ক্ষতি হয়ে গেল

Previous articleমদের হোম ডেলিভারি কীভাবে করবেন জানেন কি?
Next articleপাক অধিকৃত কাশ্মীর উদ্ধারে প্রস্তুত ভারতীয় সেনা: ভি কে সিং