সুশান্তর আত্মহত্যা: যা দেখলাম আর নিজে যা বুঝলাম

মৃত্যুঞ্জয় পাল

সুশান্ত সিং রাজপুত ও আত্মহত্যা।

সুশান্ত সিং রাজপুত এক অসাধারন অভিনেতা ও বলিউডের উদীয়মান তারকা।
যেকোন অল্প বয়সের প্রতিশ্রুতিমান যুবকের মৃত্যু সবসময় বেদনাদায়ক।
গতকাল যখন খবরটা সবাই জানতে শুরু করেছে তখন আমরা ত্রাণ নিয়ে হাসনাবাদে।বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ১২ টা।তারপর খবরটা জানলাম।
এই মৃত্যুটা নিয়ে ফেসবুক আর টিভির চ্যানেলগুলোতে দেখছি বিভিন্ন মতামত।তবে মোটামুটি যেটা দেখলাম দুটো বিষয় নিয়ে সবাই একমত।
এক:ডিপ্রেসন থাকলে মানুষের সাথে কথা বলা উচিত।

দুই:কাপুরষরা আত্মহত্যা করে আর যারা আত্মহত্যা করবে তাদের আমাদের ঘৃণা করতে হবে।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখি যারা এই জ্ঞান দিচ্ছে তাদের ৯৯.৯৯% কোনদিন মানসিক রুগীকে হ্যান্ডেল করতে হয়নি।জানেই না মানসিক রোগটা কি।
আমাদের জীবনে আর ৪-৫ টা রোগের মতোই যে মানসিক রোগ সেটার ধারনাই অধিকাংশ মানুষের নেই।
ভারতবর্ষের মানুষ মানসিক রোগ বলতে বোঝে পাগল।
আমাদের শরীরে রোজ অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে তার মানে এই নয়জে আমরা রোজ অসুস্হ হয়ে পড়ি।কারন শরীরের নিজস্ব মেকানিজম আছে লড়াই করার।সেরকমি আমরা ডিপ্রেশনে যাই আবার কাটিয়ে উঠি।যারা বলছেন আমাদের ডিপ্রশেন হয়না তাদেরো হয় এবং আপনারা কাটিয়ে ওঠেন।ঠিক এই কারনেই আমরা রুগী নই।

এবার যে মানসিক ভাবে অসুস্হ সে ডাক্তার না দেখিয়ে বন্ধুদের সাথে কথা বলবে আর রোগ সেরে যাবে।কি অসম্ভব ভালো যুক্তি।
মানে আপনার পেট খারাপ হলে এবার বন্ধুদের সাথে কথা বলুন।
আপনার অন্য কঠিন অসুখ হলে আপনার কাছের মানুষের যা দায়িত্ব থাকে মানসিক রোগের ক্ষেত্রে সেই দায়িত্বটা অবশ্যই একটু বেশি তবে এটা বুঝতে হবে তারা কেউ ডাক্তার নয়।

দ্বিতীয়ত ভারতবর্ষে মানসিক রোগ এখনো সোশ্যালি অ্যাকসেপটেড নয়।সোশ্যালি ছাড়ুন রুগীর পরিবার তথা নিজের কাছেই অ্যাকসেপটেড নয়।আমার মানসিক সমস্যা আছে এবং সেটার চিকিৎসার প্রয়োজন সেটা বুঝতে এবং বোঝাতে অনেক সময় চলে যায়।যদিও চিকিৎসা শুরু হয় সেটা যত সম্ভব সমাজ থেকে লুকিয়ে রাখার প্রবনতা।এডসে্র রুগীর চাইতেও খারাপ অবস্হা।

তৃতীয়ত ভারতবর্ষে মানসিক রোগের চিকিৎসার কোন পরিকাঠামোই তৈরি হয়নি সেভাবে। এক একজন ডাক্তার এক এক রকমের ওষুধ লিখতে পারে একই রুগীকে।৫-১০ মিনিটে রুগী দেখা শেষ।

তা আমি হঠাৎ এতো জ্ঞান দিচ্ছি কেন।কারন আমার মা একজন মানসিক রুগী ছিল আর যার চিকিৎসা আমি ৮ বছর ধরে ভারতবর্ষেের বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন ডাক্তারকে দিয়ে করিয়েছি।চাকরি থেকে ইস্তাফা দিয়ে একমাস চার দিন দক্ষিণ ভারতে ছিলাম।কখনো ভালো হয়েছে আবার খারাপ হয়েছে।ঐ আট বছরে আমার মা ৫ বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল।দুবার হাসপাতালে ভর্তি করে ভালো করে নিয়ে এসেছি।তিনবার বাড়িতেই ওয়াশ করে ভালো করে ফেলেছিলাম।শেষবার ২০১১ সালের ১৫ ই আগষ্ট।আমি তখন পূরীতে।মাকে আর ফেরাতে পারলাম না।সেই গ্লানি নিয়েই সরাজীবন বাচতে হবে।আমার এখনো মন হয় আমি কলকাতা থাকলে হয়তো মা বেচে থাকতো।
কারন শেষ আট বছর মা আমার কাছে সন্তানের মতো ছিল।কখনো বকতাম, কখনো পিছনে লাগতাম হাসাতাম,কখনো খাইয়ে দিতাম।মা কিছু করলে মোহনা বলতো মৃত্যুনকে ফোন করছি।আর মা বলতো আর করবো না।মার শুধু ডিপ্রেশন ছিল না।সাথে আরো অনেক ধরনের মানসিক সমস্যা।যেমন একজন মানুষের সুগার,প্রেসার আর থাইরয়েড একসাথে থাকতে পারে সেরকম আরকি।একজন সাধারণ রুগী সবধরনের চিকিৎসা পাওয়ার পরেও মারা যেতে পারে।সেরকম অধিকাংশ মানসিক রুগী যারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিকিৎসা করায় না।আর যারা চিকিৎসা করায় তারাও আত্মহত্যা করতে পারে কারন আগেই বলেছি মানসিক চিকিৎসার পরিকাঠামো খুব খুব খারাপ।
এবার কেউ যাতে আত্মহত্যা করে তাকে ঘৃণা করতে হবে?
আচ্ছা আপনি করলেন তার পরিবার কি করবে?
আমার মা আমার কাছে আমার লাইফ লাইন ছিল।আজো একইরকম ভালোবাসি।

এই লেখাগুলো লেখার সময় বুকের ভিতর দলা পাকিয়ে আসছে,গলা শুকিয়ে আসছে।অনেক স্মৃতি ভীড় করে আসছে।তবু লিখছি।কারন এই লেখাটা পরে যদি একজনেরো মানসিক রোগের প্রতি সচেতনতা তৈরি হয় আর যারা আত্মহত্যা করছেন তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ঘৃণার না থাকে সেটাই পাওনা।

সবশেষে বলি টাকা বা খ্যাতি থাকলেই সে ডিপ্রেশনের রুগী হবেনা এরকম কোন কথা নেই।তাহলে সুশান্ত সিং রাজপুত বা মার্লিন মুরে আত্মহত্যা করতো না।আবার যার কিছুই নেই সেও আত্মহত্যা করতে পারে যেমন একজন কৃষক।

ভালো থাকার উপায় নিজের মতো করে খুঁজে নিতে হবে।

Previous articleকোভিড হাসপাতালের বিরোধিতায় উত্তপ্ত কামারহাটি
Next articleদিল্লিতে সব বাসিন্দার করোনা পরীক্ষা হবে, সর্বদল বৈঠকে জানালেন অমিত শাহ