শোভাবাজার, কুমোরটুলির মৃৎশিল্প ও শিল্পী

প্রিয়াঙ্কা চৌধুরী (শিক্ষিকা)

বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য হল তার শিল্পচর্চা। বাঙালির আবহমান কালের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তার শিল্পচর্চার শাখা প্রশাখা বহুধা বিভক্ত ও বৈচিত্র্যময়। এমনকি কালক্রমে, তথাকথিত মার্জিত বা শহুরে সংস্কৃতি, যাদের কাছে একসময় লৌকিক সংস্কৃতি ব্রাত্য ও বর্জিত ছিল – তারাও মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।

আরও পড়ুনঃকরোনা অবহেই দুর্গা প্রতিমার বরাত পেল কুমোরটুলি

বাঙালি চর্চিত একটা উল্লেখযোগ্য শিল্পচর্চা হল, মৃৎশিল্প। এখানে শিল্পী তার কৃষ্টিকে রূপ দেন মাটি দিয়ে। মৃৎশিল্পের এই কৃষ্টিপর্বের আবার নানান পদ্ধতি রয়েছে, যার সাহায্যে মাটির প্রলেপের উপর ফুটিয়ে তোলা হয় স্থাপত্যকে। মাটির জিনিস গড়ার দুটি পন্থা আছে – প্রথমটা হল, মাটি দিয়ে জিনিস গড়ে, তাকে আগুন পুড়িয়ে পোক্ত করা হয়; আর দ্বিতীয় পদ্ধতিটা হল, কাঁচা মাটির জিনিসকে রোদে শুকিয়ে পোক্ত করা। প্রথমটার একটা প্রচলিত নামও আছে – পোড়ামাটির বা টেরাকোটার জিনিস। কলকাতার, কুমোরটুলি ও কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পীরা দ্বিতীয় পদ্ধতিটাই অবলম্বন করে চলেন।

আরও পড়ুনঃকরোনা আবহেও কুমোরটুলির শিল্পীদের পাশে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার সার্বজনীন দূর্গাপুজো কমিটি

কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীঃ
পশ্চিমবঙ্গের কারিগরি শিল্প ও তার ঐতিহ্যের একটা অনন্য প্রধান অংশ হল, মৃৎশিল্প। যার খ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বের কাছেও বাংলার ঐতিহ্যকে ঔজ্জ্বল্য দান করছে। তাই দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে, কুমোরটুলি কলকাতার ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটা। যদিও কলকাতাবাসী ও কলকাতাপ্রেমীদের কাছে এটা তাদের আবেগের অপর নাম। দেখা যায়, কুমোরটুলির প্রায় শতাধিক পরিবার কয়েক পুরুষ ধরে এই মৃৎশিল্পকে অবলম্বন করে জীবনযাপন করছেন। মাটির প্রতিমা নির্মাণ তাদের জীবিকার প্রধান উপজীব্য; তবে তা শুধুমাত্র অর্থের বিচার্য নয়, তা বহুগুণ বেশি মূল্য রয়েছে শিল্পের স্বতন্ত্রতার নিরিখে। মৃৎশিল্পীরা এখানে পরিচিত, মূলত ‘কারিগর’ নামে। তাদের কারিগরিতে ফুটে ওঠে বাঙালির দেব দেবীর চিরন্তন রূপ, যা একাধারে বাঙালির ঐতিহ্যকে বহন করছে, অন্যদিকে ফুটিয়ে তুলছে বাঙালির সামাজিক অবস্থানকে। এই কাঠামো তৈরির কয়েকটি ধাপ এ প্রসঙ্গে নির্দেশ করা যেতে পারে – কারিগরেরা মূর্তি নির্মাণের প্রথম ধাপে বাঁশ ও খড় দিয়ে ছাঁদ গড়েন, তারপর তার উপর পড়ে মাটির প্রলেপ আর শেষে তুলির টানে রঙের বাহারে সম্পূর্ণ হয়, প্রতিমার মৃৎ-অবয়ব। বর্তমানে ‘থিম’ শব্দটায় বাজার ছেয়ে গেছে।

আরও পড়ুনঃহাতে কাজ নেই, গ্রামের বাড়িতে ফিরছেন কুমোরটুলির কারিগররা!

ঐতিহ্যের সঙ্গে তার বিরাট বিবাদ চোখে পড়ে, কানে আসে। যদিও এটা কি মনে হয় না, পরিবর্তন যেখানে মহাকালের অমোঘ নিয়ম, সাবেকির পাশাপাশি এই ‘থিম’টা সেই পরিবর্তনের একটা অংশ মাত্র। বলা যেতেই পারে, আজ থেকে একশো বছর আগে যে ছাঁদে প্রতিমা বা তার চালচিত্র গড়া হত, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের প্রতিমায় তার স্বাভাবিক কিছু তফাত ঘটে গেছে, তবে আজ কেন গেল গেল রব কে জানে? যা হোক, বাঙালির আবেগ ও উৎসাহে এই বিষয় এতটুকুও বিচ্যুতি ঘটাতে পেরেছে বলে মনে হয় না। বরং, বাঙালির মহোৎসব, দুর্গাপুজোর কয়েক মাস আগে থেকে প্রতিমা গড়ার এক অন্য ব্যস্ততা পুজোর সাজো-সাজো রবকে আরও ঘনিয়ে তোলে। বলা বাহুল্য, প্রতিমা নির্মাণের পাশাপাশি কারিগরেরা অন্যান্য মাটির জিনিসেও তাদের পটুত্বের ছাপ রেখে চলেন সারা বছর।

আরও পড়ুনঃস্যানিটাইজার মেখে কুমোরটুলি থেকে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন উমা!

 

কুমোরটুলির গড়ে ওঠাঃ
১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধ জয়, ভারত তথা বাংলায় ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের সেই মাইলফলক। যার হাত ধরে গোবিন্দপুর গ্রামে এসে ব্রিটিশরা ফোর্ট উইলিয়াম স্থাপনের উদ্যোগ নেন। সেই সময়ের বেশিরভাগ জনবসতিটাই ছিল, সুতানুটি নামক আরেকটি গ্রাম কেন্দ্রিক। আর এ কথা্টা কারই বা অজানা, পরবর্তীতে এই সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলিকাতা নামক তিনটি গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠে সেদিনের শহর কলকাতা।

আরও পড়ুনঃবুদ্ধগয়ায় বসবে ১০০ ফুটের সোনালি বুদ্ধ, তৈরি হচ্ছে কুমোরটুলিতে!

ব্রিটিশ কর্মচারী হলওয়েল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নির্দেশে কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় কাজের-ভিত্তিতে স্থান-নাম দেন। যেমন – তেলিদের জন্য ‘কলুটোলা’, ছুতোরমিস্ত্রিদের জন্য ‘ছুতার পাড়া’, মদ বিক্রেতাদের জন্য ‘সুড়ি পাড়া’, গোয়ালাদের জন্য ‘আহেরিটোলা’ ইত্যাদি। আর ঠিক তেমন ভাবেই মৃৎশিল্পীদের জন্য ‘কুমোরটুলি’। (বাংলায় ‘টুলি’ বা ‘টোলা’ অর্থ পাড়া)

আরও পড়ুনঃভিন গ্রহের প্রাণীদের মর্ত্যে আগমন! প্রাকৃতিক বিপর্যয় উপেক্ষা করে কুমোরটুলি পার্কে মানুষের ঢল

 

প্রাথমিকভাবে, পশ্চিমবঙ্গের নানান প্রান্ত থেকে কুমোরেরা এসে জোটে এই কুমোরটুলিতে। আকারে নেহাত ছোট ছিল না এই কুমোরটুলি এক সময়। পরে, প্রতিবেশী বড়বাজারের ব্যবসায়ী পল্লীর আকার স্ফিত হতে শুরু করলে, কুমোরেরা অন্যত্র বাস দেখে। শুধু যারা, গঙ্গামাটির তৈরি জিনিস সুতানুটি বাজারে(পরে বড়বাজার) বেঁচে জীবিকা নির্বাহ করত, তারাই কুমোরটুলির মাটি আকড়ে আজও অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছে। পরে এরাই, মাটির প্রতিমা নির্মাণে মন দেয়। এক সময় এই মাটির প্রতিমা নির্মাণের একপেশে অর্ডার মিলত কলকাতার তথা পার্শ্ববর্তী এলাকার ধনী পরিবারের কাছ থেকে, আজ তা পাড়ার পুজো ছাড়িয়ে বিদেশের পথে পাড়ি দিয়েছে।

আরও পড়ুনঃদুর্গাপুজো নিয়ে কমিটিগুলিকে কী গাইড লাইন দিল ফোরাম?

 

অবশেষেঃ
যদিও ক্রমশ ছোট হতে থাকা এই কুমোরটুলির পরিধি, বাংলা ও বাঙালির কাছে অনেক বেশি চিন্তার কারণ হওয়া উচিত; কেননা আজও বাঙালির সবচেয়ে বড় আবেগের মৃন্ময়ী রূপ এই পল্লী থেকেই নিজের যাত্রা শুরু করেন, আশ্বিনের শিউলি গন্ধ মেখে, বাঙালির মহোৎসবের আঙ্গিনায়।

Previous articleমাদক নিয়ে সরব কঙ্গনাই একসময় হ্যাশের নেশা করতেন
Next articleরেলের বেসরকারিকরণ তথ্য ‘বিভ্রান্তিকর’, জল্পনায় জল ঢালল পিআইবি