বিদায় নিলেন বাংলা সিনেমার আভিজাত্য, শোকস্তব্ধ টলিপাড়া

তিনি শুধু অভিনেতা ছিলেন না। কারোও জন্য তিনি ছিলেন প্রাণের মানুষ, কারোর কাছে আবার পথপ্রদর্শক। বাংলার রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বারবার তাঁর কলম গর্জে উঠেছে। কখনও লেখায়, কখনও সটান রাস্তায়, মিছিলে, প্রতিবাদে, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতায়। আবার প্রয়োজনে ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচাতে প্রতিষ্ঠানের পাশেই।

টানা চল্লিশ দিন হাসপাতালে লড়াইয়ের পর চলে গেলেন বাংলা ছবির প্রবীণ মহাতারকা, অভিনেতা-নাট্যকার-বাচিকশিল্পী-কবি-চিত্রকর। অপু থেকে ফেলুদা, সেখান থেকে বাঙালির হার্টথ্রব সৌমিত্র, একনিমেষে শেষ হয়ে গেল একটা অধ্যায়। তার এই প্রয়াণে বাংলা সিনেমার এর যুগের অবসান ঘটল।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এমন একজন মানুষ, যিনি নিজেই নিজের আত্মজীবনীতে কাজ করছিলেন। গত বছর দেড়েকের বেশি সময় ধরে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় চলছিল কাজ। ছবির সব দৃশ্যের শুটিং শেষ করলেও, দেখে যেতে পারলেন না। আবেগঘন বার্তায় পরমব্রত বলেছেন, অনেকে ওনাকে গুরু মানেন, শিক্ষক বলেন, আমার কাছেও অবশ্যই তাই, আমার নিজের একান্ত নিজের উদয়ন মাস্টার, কিন্তু সব ছাড়িয়ে উনি ছিলেন একজন পরম বন্ধু! আজ জীবনের একটা অংশ চলে গেল। এই ক্ষতি ভাষার প্রকাশ করার জায়গা নেই।

আরও পড়ুন : কিংবদন্তির মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ বলিউডের

বর্ষীয়ান অভিনেতার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পরেই স্মৃতিতে ডুব দিলেন সাংসদ-অভিনেতা দেব। ‘সাঁঝবাতি’ ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছিলেন। টুইটারে দু’জনের একসঙ্গে ছবি পোস্ট করে তাঁর ‘ছানাদাদু’কে ভাল থাকার বার্তা দিলেন তিনি।

একই বার্তা দিয়েছেন মিমি চক্রবর্তী, অরিন্দম শিল, আবীর চট্টোপাধ্যায়রা।

অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষ লিখেছেন, ” বিদায় নিলেন বাংলা সিনেমার আভিজাত্য। আমরা হারালাম পথ প্রদর্শক,দর্শক হারালেন আপনজন..
টলিউড হারালো শিক্ষক। চির নিদ্রায় স্যার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ভাল থেকো জেঠু। ”

এই বছরের শুরুতেই নিজের বাবাকে হারিয়েছেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। এবার হারালেন জ্যেঠুকেও। পরপর দুটো ধাক্কা। তাঁর লেখায় ক্ষোভ, রাগ, দুঃখ স্পষ্ট।

ফেলুদা যে আর নেই, এটা যেন মানতেই কষ্ট হচ্ছে তাঁদের। তিনি বাংলা সিনেমার আভিজাত্য। অভিনেতা কৌশিক সেন জানিয়েছেন, পেশাদার অভিনেতা হওয়াই হত না, সৌমিত্র বাবু না থাকলে। মন থেকে সবসময় চাইতাম অভিনেতা হব। কিন্তু সমস্ত কিছুই ঘটল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আসার পর।

ফেলুদার “সোনার কেল্লা” অভিযানে সঙ্গে ছিল ছোট্ট মুকুল। ছবির শ্যুটিংয়ের সময় অভিনেতা কুশল চক্রবর্তীর বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর। তাঁর কথায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন, বাংলা ছবির একটা যুগের টর্চবেয়ারার। একসঙ্গে কাজের স্মৃতিচারণা করলেন তিনি। জানালেন, যখনই শ্যুট শেষ হত, সেট থেকে বেরোনোর আগে কুশলকে পর্যন্ত বলে বেরোতেন সৌমিত্রবাবু।

‘কাঁচ কাটা হীরে’ ছবি দিয়ে প্রথম জুটি হিসাবে তাঁদের পথচলা শুরু। সৌমিত্রর সেই সহ অভিনেত্রী লিলি চক্রবর্তী, এদিন অভিনেতার স্মৃতিচারণায় জানান, সবকিছু ছাপিয়েও থেকে যাবে ‘এতবড় মানুষটার সুন্দর ব্যবহারটা’।

অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার, তাঁর সঙ্গে একাধিক সময়ে এক মঞ্চে অভিনয় করেছেন। তাঁর কথায়, ওর সঙ্গে অভিনয় অন্য অভিজ্ঞতা। “একটি সংলাপকে কী করে শরীরে মধ্যে আয়ত্ত্ব করে, তাকে মনের সঙ্গে জড়িয়ে প্রকাশ করা যায়, সেই পন্থা শিখিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় । ধীরে ধীরে বন্ধু বানিয়ে নেওয়ার প্রবল ক্ষমতা ছিল তাঁর মধ্যে। ” জানিয়েছেন অভিনেতা।

অভিনেতার সঙ্গে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর শেষ স্মৃতি ‘বেলাশুরু’ এবং ‘বেলাশেষে’। তিনি লিখেছেন, এমন একজন কিংবদন্তির সঙ্গে কাজ করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। সৌমিত্র জেঠু যে আর নেই – এই কঠোর সত্যটা বিশ্বাস করতে পারছি না।

এদিন খবরটা পাওয়ার পর হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন রাজ চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, ‘বাংলা সিনেমা জগতের অপূরণীয় ক্ষতি। ওঁনার আত্মার শান্তি কামনা করি।’

আরও পড়ুন : চলচ্চিত্র জগৎ চিরকাল তাঁর ঋণ স্বীকার করবে: বুদ্ধদেব

সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছোট্ট মনখারাপ করা বার্তা, ভালো থেকো।

কিংবদন্তি এই তারকার প্রতি শোকজ্ঞাপন করেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে তিনি পিতৃপ্রতিম এক ব্যক্তিত্ব। বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমা ও নাটকে তার অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’

অভিনেত্রী জয়া এহসান লিখেছেন, পর্দায় তিনি যখন অভিনয়ের গরিমা ঝেড়ে ফেলে চরিত্রের আচরণ ফুটিয়ে তুলেছিলেন, ভারতবর্ষের শিল্পভুবনে সেটা শুধু বিস্ময়কর একটা ঘটনাই ছিল না, ছিল এক নতুন যুগের শুরু। বিশ্ব–চলচ্চিত্রের অভিনয়ের প্রথম সারিতেই তাঁর স্থান। কিন্তু অমন যে ইতিহাসের স্রষ্টা, অমন যে শিখরে ওঠা শিল্পী, মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন এক মহাসাগর। যে মহাসাগর অতলান্ত, কিন্তু শান্ত।
তাঁর মৃত্যু নেই!

Previous articleকিংবদন্তির মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ বলিউডের
Next articleব্রেকফাস্ট নিউজ