Monday, August 25, 2025

অধিকারীদের দলে থাকার পরিস্থিতি আর নেই: কণাদ দাশগুপ্তর কলম

Date:

Share post:

কণাদ দাশগুপ্ত

সৌমেন্দুতেই শেষ নয়, এখনই নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট না করলে বাকি অধিকারীদেরও দলের কঠোর সিদ্ধান্তের মুখে পড়তে হবে৷ শিশির অধিকারীর মতো অভিজ্ঞ এবং পোড়খাওয়া রাজনীতিকের পক্ষে তা কখনই সুখকর হতে পারেনা৷ এটা দ্রুত বুঝতে হবে কাঁথির অধিকারী- পরিবারকে৷

পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা সভাপতি শিশির অধিকারী, জেলার সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারী এবং কাঁথি পুরসভার অপসারিত প্রশাসক সৌমেন্দু অধিকারীকে এখনই মনস্থির করতে হবে, তাঁরা কোন পথে হাঁটবেন, দলের সঙ্গেই থাকবেন, না’কি, থাকবেন না৷ একুশের ভোটের বেশি দেরি নেই, তাই শান্তিকুঞ্জের বাসিন্দাদের বিষয়টিকে ঝুলিয়ে রাখার মতো সময় দল দেবে না বলেই ধারনা৷
তৃণমূলের সঙ্গে থাকতে হলে দলে থেকে যাওয়া বাকি অধিকারীদের এখন শুনতে হবে অথবা বলতে হবে দলের সঙ্গে শুভেন্দু অধিকারীর ‘বেইমানি’র কথা৷ শুভেন্দু সম্পর্কে দলের মনোভাবকে চোখ বন্ধ করে সমর্থনও করতে হবে৷ শুভেন্দু এখন দলের শত্রু, অধিকারীদেরও তেমন নজরেই দেখতে হবে বাড়ির ছেলেকে৷ একই বাড়িতে থেকে এই কাজ চালিয়ে যাওয়া আদপেই সহজ নয়৷ ভোট যত এগিয়ে আসবে,লড়াই ততই তীব্র হবে৷ জানা নেই, শুভেন্দুর বিরুদ্ধে তৃণমূলের বিরোধ যে শুধুই রাজনৈতিক আঙ্গিনায় সীমাবদ্ধ থাকবে, এমন নাও হতে পারে৷ আইন-আদালত যদি এই লড়াইয়ে জড়িয়ে যায়, তখন সেই কাজও সমর্থন করতে হবে৷ মোটের উপর, দলে থাকতে হলে তৃণমূল যে নজরে শুভেন্দুকে দেখবে, অধিকারীদেরও সেই নজরেই দেখতে হবে এবং দলের কথাই বলতে হবে৷ তাই নিশ্চিতভাবেই দোলাচলে রয়েছেন অন্য অধিকারীরা৷
আর তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইলে দল ত্যাগের আগে সব পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বাড়ির ছেলে শুভেন্দু যে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন, বাকি অধিকারীদের তা অনুসরণ করতে হবে৷ অবশ্য তাঁরা সে পথে নাও যেতে পারেন৷ তবে ইস্তফা না দিলে আরও তীক্ষ্ণ হবে তৃণমূলের আক্রমণ, প্রতি পদে কথা শুনতে হবে, যে কথাগুলো শুভেন্দুকে বলতে পারছে না তৃণমূল৷ কারন, শুভেন্দু দল বদলের আগেই নীতিগত প্রশ্নে বঙ্গ-রাজনীতিতে বিরল নজির গড়ে সব পদে ইস্তফা দিয়েছেন৷ বাকি অধিকারীদের কিন্তু এই পথ অনুসরণ করা ভয়ঙ্কর ‘বিপদের’৷ তাহলে এক ধাক্কায় গোটা পরিবারই ‘শক্তিহীন’ হয়ে পড়বেন৷ এমনটা নিশ্চয়ই তাঁরা চাইবেন না৷
ফলে, সিদ্ধান্ত নেওয়া আদৌ সহজ নয়৷ তৃণমূলও এই ইস্যুতে ‘নীরব’ থেকেও ‘ব্যবস্থা’ নেওয়ার যে কৌশল নিয়েছে, তাতে বল চলে গিয়েছে ওই পরিবারের কোর্টেই৷

বর্তমান রাজনৈতিক আবহে কিছুটা হলেও হয়তো সঠিক, ‘ছুৎমার্গ- রাজনীতি’র জেরে কাঁথির গোটা অধিকারী পরিবার সম্ভবত বিজেপি- মুখী৷ অধিকারী-পরিবারের ঘনিষ্ঠ সূত্রও তেমনই বলছে৷ শুভেন্দুবাবু ছাড়া ওই পরিবারের আর কেউই দল ছাড়েননি, দলের বিরুদ্ধে মন্তব্য করেননি৷ তা সত্ত্বেও জেলা রাজনীতিতে অধিকারী- পরিবারকে ব্রাত্য করে কাঁথি বা পূর্ব মেদিনীপুরে তৃণমূলের ব্যাটন এখন রামনগরের বিধায়ক অখিল গিরি’কে দেওয়া হয়েছে৷ অধিকারীদের সঙ্গে গিরিদের বিরোধ দীর্ঘদিনের৷ সেই ঝাল মেটানো আর বর্তমান অস্থিতিকর পরিস্থিতি সামাল দিয়ে দলকে পূর্বের অবস্থায় ফেরানো, এক কথা নয়৷ শুভেন্দু অধিকারী দল ছাড়ার পর ওই জেলায় দলের স্টিয়ারিং অখিল এবং তাঁর পুত্রের হাতে৷ জেলা রাজনীতিতে অখিল গিরিও পুরনো হলেও অধিকারীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এঁটে ওঠা তাঁর পক্ষে সহজ নয়৷ শুভেন্দুর পর বাকি অধিকারীরাও যদি দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে অন্য সুরে কথা বলে ভোট ময়দানে নেমে পড়েন, সেক্ষেত্রে তার মোকাবিলায় অখিলবাবু কতখানি সফল হবেন, তা নিয়ে জেলা তৃণমূলের অন্দরেই প্রশ্ন আছে৷ ওদিকে এটাও ঠিক,জেলা তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের একাংশ চাইছেন না, জেলায় দলের রাশ আর অধিকারী-বাড়িতে থাকুক৷ কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভায় আন্তরিকভাবেই যোগ দেওয়া আর জেলার পরিবর্তিত নেতৃত্ব মেনে নেওয়া এক নয়৷ ফলে তৃণমূলকেও অন্যরকম ভাবতে হবে৷ না হলে একুশের ভোটে আশাজনক ফল পেতে নাও পারে শাসক দল৷

শিশিরবাবু এখনও পর্যন্ত দলের প্রতি অনাস্থার বার্তা দেননি, দলবিরোধী কথাও বলেননি, তা সত্ত্বেও তৃণমূলের একাংশের নিশানায় তিনিই৷ কয়েকদিন আগে কলকাতা থেকে কাঁথি গিয়ে সৌগত- ফিরহাদ শুনিয়ে এসেছেন “কাঁথি কোনও পরিবারের জমিদারি নয়”৷ এর পর গত শুক্রবার কলকাতায় এক জনসভায় সৌগত রায় বলেছেন, “এবার অধিকারীদের বাড়িতে ঢুকে মাইক বাজাবো”৷ এ সব কথার লক্ষ্য যে তিনি এবং তাঁর পরিবার, তা বেশ বুঝেছেন শিশির অধিকারী৷ এবং একই সঙ্গে বুঝেছেন, দল তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে সন্দেহের চোখে দেখছে৷ ওদিকে,দলের তরফে শিশিরবাবুদের আশ্বাস দেওয়াও অসম্ভব, যে ওই জেলায় শুভেন্দুর বিরুদ্ধে কোনও কথা বলা হবে না৷ এমন কথা তৃণমূল দেবেই বা কেন ? শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূলের বিরুদ্ধে তোপ দেগেই যাবেন, আর শিশিরবাবুদের দলে ধরে রাখতে সে সব সহ্য করে যাবে তৃণমূল, এমন হয় নাকি ? তৃণমূলের অভ্যন্তরে অনেকেই আজ শিশিরবাবুদেরও সন্দেহের নজরে দেখছেন৷ না দেখার কারনও নেই৷ মুকুল রায় তৃণমূল ত্যাগ করার পর তাঁর বিধায়ক পুত্র শুভ্রাংশু রায় প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, তিনি তৃণমূলেই থাকছেন৷ অথচ পরবর্তীকালে পরিস্থিতি তেমন থাকেনি৷ শুভ্রাংশুও বিজেপিতেই নাম লেখান৷ সেই দৃষ্টান্ত সামনে রেখে তৃণমূল আজ অধিকারী- পরিবারের বাকিদের সম্পর্কে এমন ভাবতেই পারে, ভাবনা অমূলকও নয়৷ আর হয়তো সেইসব ভাবনাই ছিটকে বেরিয়ে আসছে তৃণমূল নেতাদের কথায়৷ ওদিকে সেইসব মন্তব্যই ‘অন্য’ভাবে নিচ্ছেন শিশিরবাবুরা৷

আরও পড়ুন:সৌরভকে বিজেপিতে যোগ দিতে নিষেধ ‘কাকা’ অশোক ভট্টাচার্যের

কাঁথির শান্তিকুঞ্জের কড়া নজর ছিলো শুভেন্দু অধিকারীর গত বৃহস্পতিবারের রোড-শো তথা জনসভার দিকে৷ এই কর্মসূচি কাঁথি তথা গোটা জেলার মানুষের কতখানি সমর্থন পায়, সেটাই লক্ষ্য রাখছিলেন অধিকারীরা৷ পদযাত্রা বা সমাবেশ শেষে সম্ভবত স্বস্তি মিলেছে অধিকারী পরিবারের৷ কারন, বিজেপির এই কর্মসূচিতে যথেষ্ট লোক সমাগম হয়েছে৷ জমায়েত দেখে হয়তো বাড়তি উৎসাহ পেয়েছে শিশিরবাবুরা৷ অনেকেই মনে করছেন, পূর্ব মেদিনীপুরের ওই জমায়েতের আয়তন শুভেন্দুর দলবদলের সিদ্ধান্তে সিলমোহর দিয়েছে৷ ফলে অধিকারীরা হয়তো ভাবছেন, তৃণমূল ছাড়লেও এই সমর্থন হয়তো তাঁরাও পাবেন৷ এতে সম্ভবত কিছুটা আশ্বস্তও হচ্ছেন শিশিরবাবুরা৷

তৃণমূলের এক বড় নেতার ধারনা, অধিকারীদের অন্যবার্তা দিতেই মমতা এখন ওই জেলায় যাচ্ছেন না৷ মমতার সভায় শিশিরবাবু গরহাজির থাকলে একদম স্বচ্ছ হয়ে যাবে, অধিকারীরা আর তৃণমূলে নেই৷ তখন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে৷ কিন্তু মমতা শেষপর্যন্ত দেখে নিতে চাইছেন৷ কারন মমতা জানেন, সদলবলে অধিকারীরা বিরুদ্ধ পক্ষে যোগ দিলে, দল অসুবিধায় পড়বে৷ রাজনীতির খাতিরে ‘বিকল্প তৈরি করে নেব’ বলতে হলেও, তা যে সব সময় হয়না, তার টাটকা প্রমান অর্জুন সিং, নিশীথ অধিকারীরা৷ ওই দুই জেলা ব্যর্থ হয়েছে অর্জুন- নিশীথের মোকাবিলায়৷ শিশিরবাবুদের বিরুদ্ধে এখনই কড়া পদক্ষেপ না করে মমতা ওই পরিবারকে সুযোগ দিতে চাইছেন৷ অপরদিকে অধিকারী পরিবারও ভাবছে পরের পর সভা এড়িয়ে যাওয়ার পরবর্তী অভিঘাত। কিন্তু এভাবে তো দীর্ঘদিন চলতে পারে না৷ স্পষ্ট সিদ্ধান্ত শিশির অধিকারীদের নিতেই হবে৷ হয় তৃণমূলে থেকে পূর্ব মেদিনীপুরে দলের কর্মসূচি পালন করতে হবে, বিজেপির বিরুদ্ধে সরব হতে হবে, দল চাইলে শুভেন্দু বা তাঁর অনুগামীদের বিরুদ্ধে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে দলের বার্তা পৌঁছে দিতে হবে, শুভেন্দুর বিরুদ্ধে গ্রহণ করা দলের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হবে অথবা, বিজেপিতে যোগ দিন বা না দিন তৃণমূল ছাড়তে হবে, দলের পদ ছাড়তে হবে, নীতির প্রশ্নে সাংসদ পদও ছাড়তে হবে৷

বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, অধিকারী পরিবারের তৃণমূলেই থেকে যাওয়ার পরিস্থিতি আর নেই৷ দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন তাঁদের করতেই হবে৷ রাজনৈতিক মহলের অনুমান,দলের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত একটি কথা না বললেও ভোটের মুখে যে কোনও মুহুর্তেই জেলা তৃণমূলের শীর্ষ পদ খোয়াতে পারেন শিশির অধিকারী৷ অথবা ইস্তফাও দিতে পারেন৷ জানা নেই, হয়তো সেই ঘটনার জন্যই অপেক্ষা করছে শান্তিকুঞ্জ৷ তবে এটাও ঠিক, অধিকারীরা দল ছাড়লে এমনিতেই কিছুটা চাপে থাকা তৃণমূল অবিভক্ত মেদিনীপুরে বাড়তি চাপে পড়বেই৷ কলকাতা থেকে কিছু নেতা গিয়ে সভা করে তার মোকাবিলা করা যে কঠিন, সে কথা নিশ্চয়ই তৃণমূল বুঝছে৷

spot_img

Related articles

নির্বাচনী মামলা! পাল্টা হলফনামা দিতে নিজেই হাই কোর্টে অভিষেক

নির্বাচন সংক্রান্ত মামলা দায়ের হয়েছিল তৃণমূলের ডায়মন্ড হারবারের (Diamond Harbour) সাংসদ তথা তৃণমূল সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের...

পথ দেখায় বাংলা: মমতার পথেই গণেশপুজোয় অনুদান মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকারের!

বাংলা আজ যা ভাবে গোটা ভারত তা ভাবে কাল। এই স্বতঃসিদ্ধ বাক্যটি সম্প্রতি বারবার প্রমাণিত হয়েছে। ফের একবার...

“যেকোনও পুরুষ আমার চেয়ে হেমাকে বেশি পছন্দ করত”, ধর্মেন্দ্রর দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে মন্তব্য প্রকাশের

ধর্মেন্দ্র (Dharmendra) এবং তাঁর প্রথম স্ত্রী প্রকাশ কৌরের (Prakash Kaur) বিয়ে হয় ১৯৫৪ সালে। অভিনেতার বলিউডে অভিষেকের কয়েক...

নিয়োগ মামলা: ইডির তল্লাশি বিধায়কের বাড়ি, আত্মীয়ের বাড়িতে

নির্বাচন এগিয়ে এলেই বিজেপির তার তদন্তকারী সংস্থার অস্ত্রগুলোকে এগিয়ে দিতে থাকে। তদন্তকারী সংস্থা ইডি বা সিবিআই আজ পর্যন্ত...