ভাষণ শেষ না করে রাজ্যপালের বিধানসভা ঘটনা নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন৷ কিন্তু তার থেকেও বড় যাত্রাপালা, দলের এক ‘Symptomatic- কমরেড’-কে ‘বাঁচাতে’ পদ্ম-ফৌজের solidarity-প্রদর্শন৷
শুক্রবার বিধানসভায় যে কাণ্ড বিজেপি বিধায়করা করলেন, তা পুরোটাই স্ক্রিপ্টেড৷ হাওলা- কেলেঙ্কারিতে নাম থাকা জনৈক ধনকড়ের পাশে দাঁড়ানো হয়তো সম্ভব নয়, তবে এদিন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের ‘ত্রাতা’ হিসাবে বিজেপি বিধায়কদের এই নাটক নিঃসন্দেহে অভিনব৷ এতদিন ধনকড় একাই বোঝাতেন তিনি বিজেপি’র Activist, এবার দল হিসাবে বিজেপি বোঝালো, দলও আছে ভক্তের পাশে৷
গত বছরও এমনই হয়েছিলো৷ বিধি অনুসারে রাজ্য মন্ত্রিসভার পাঠানো চূড়ান্ত করা ভাষণ পাঠ করতে রাজি ছিলেন না রাজ্যপাল ৷ সঙ্গে বায়না ছিলো, ওনার ভাষণ পাঠের লাইভ ছবি টিভিতে দেখাতে হবে৷ গত বছর সুবিধা হয়নি বিধায়ক- স্বল্পতার কারণে৷
এবারও প্রথম থেকে ভাষণ পাঠে রাজি ছিলেন না, এবারও টিভিতে জ্যান্ত-ছবি দেখানোর বায়না ছিলো ৷ তবে এবার জোর ছিলো ৭০+ বিধায়কের৷ আর ওই জোরেই চিত্রনাট্য লেখা হয়েছে, দিল্লির পরিচালকরা স্ক্রিপ্টে ছাড়পত্রও দিয়েছেন৷ তারপরই যাত্রাপালায় নেমে পড়লেন গেরুয়া-বিধায়করা৷
সফল হবেন না জেনেও বেশ কয়েকদিন ধরেই ভাষণ নিয়ে রাজ্যের সঙ্গে বিবাদে নেমেছিলেন রাজ্যপাল৷ তবে সবটাই ছিলো মুখে মুখে, বাস্তবে এক আনা প্রতিবাদও শুক্রবার করতে পারলেন না৷ মন্ত্রিসভা যে ভাষণে সিলমোহর দিয়েছে সেই ভাষণই যে পড়তে হবে, তা জানতেন ধনকড়৷ বড় জোর নিজের দু-চারটে লাইন ভাষণ পাঠের সময় ঢুকিয়ে দিতে পারতেন৷ তেমন কাণ্ড করলে শাসক দলের তরফে একটু হট্টগোল করা ছাড়া আর কিছু করার ছিলোনা৷ তবে লাইভ সম্প্রচার হলে ধনকড় সাহেব নিশ্চিতভাবেই একটা চান্স নিতেন লাইভ- পারফরম্যান্সের৷ কিন্তু বিষয়টিতে পেরেক পুঁতে দেন স্পিকার৷ রাজ্যপাল বিধানসভার কাজে হস্তক্ষেপ করছেন, এই অভিযোগ জানিয়ে লোকসভার অধ্যক্ষকে চিঠি দেন বিধানসভার স্পিকার৷ থেমে থাকেননি ধনকড়ও৷ তাঁর ভাষণ ‘লাইভ’ না হওয়াকে এমার্জেন্সির সঙ্গে তুলনা করে ধনকড় স্পিকারকে লিখলেন, “স্পিকার রাজ্যপাল পদের অপমান করেছেন৷ আমার ভাষণ সম্প্রচার বন্ধ করে জরুরি অবস্থা ফিরিয়ে এনেছেন”৷
তখনও রাজ্যপালের আশা ছিলো, কিছু একটা সুবিধা পাবেন৷ হয় ভাষণে নিজের কথা ঢোকাতে পারবেন, না-হয় লাইভ-এর চান্স পাবেন৷ এর একটা পেলেই নটসূর্য-র স্টাইলে মাৎ করে দেবেন৷ কিন্তু কিছুই হবে না যখন বুঝলেন, তখন এসওএস পাঠালেন দলের শীর্ষস্তরে৷ শলা-পরামর্শ হলো৷ ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হলো, প্রিন্ট নিয়ে দিল্লি গেলেন বিরোধী দলনেতা৷ তাতে ছাপ্পা লাগালেন দুই ভাই৷ ঠিক হলো, রাজ্যপাল যখন বক্তৃতা দেওয়া শুরু করবেন, তখনই পদ্ম-ফৌজ চিৎকার শুরু করবেন, ওয়েলে নেমে ভাষণের “তীব্র” প্রতিবাদ করবেন৷ রাজ্যপালের এমনিতেই ফুটিফাটা প্রেস্টিজে আর একটা ‘চোট’ লাগবে৷ তিনি ‘বলিষ্ঠ প্রতিবাদ’ জানিয়ে কক্ষ ছেড়ে প্রস্থান করবেন৷
আরও পড়ুন- সব জল্পনার অবসান, উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পদ ছাড়তে চলেছেন তিরথ সিং রাওয়াত
সেই চিত্রনাট্য অনুসারে সবাই ‘অ্যাকটো’ করলেন৷ ভাষণ শুরুর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ‘বিজেপি বিধায়কদের অ-পরিষদীয় বিক্ষোভ’-এর জোরালো প্রতিবাদ জানিয়ে ধনকড় সাহেব উইংসের পাশ দিয়ে বেরিয়ে সোজা গাড়ি চেপে বাড়ি৷ শাসক দলের দিকে তাকিয়ে বিজেপির বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ তখন ‘দ্যাখ, কেমন লাগে’!
কিন্তু এই রামলীলায় ধনকড়ের ইজ্জত কতখানি রক্ষা পেলো ? রাজ্য মন্ত্রিসভার অনুমোদিত ভাষণের প্রতিবাদ করার সাহসই তো উনি দেখাতে পারলেন না৷ মুখের বিপ্লব বাস্তবে হলো কই ? প্রথামতো মন্ত্রিসভায় বাজেট ভাষণ পাশ হয়ে গিয়েছে, সুতরাং পড়া বা না-পড়ায় বিশেষ কিছু ফারাক নেই৷ আর তিনি কক্ষও ছেড়েছেন বিজেপি-বিধায়কদের হট্টগোলের কারণে, সরকারের লেখা ভাষণের ভাষার প্রতিবাদে নয়৷ ট্যুইট-বিপ্লবী ধনকড় শাসক দলের সঙ্গে সমুখ- সমরের গোল্ডেন-চান্স পেয়েছিলেন এদিন৷ ‘শত্রুর ডেরায়’ ঢুকে বিপ্লব করতেই পারতেন৷ একটু হট্টগোল হতো, এই যা৷ কেউ তো আর হাত-পা ভেঙ্গে দিতো না৷ কিন্তু ভাষণে তো উনি নিজের কথা, নিজের দলের কথা বলে যেতেই পারতেন৷ বিপ্লব দীর্ঘজীবী হতো৷ গোটা দেশ জানতো, ধনকড় বিধানসভায় ঢুকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে, মমতার সরকারকে৷ ধন্য ধন্য পড়ে যেত৷ সামনের বছর রাষ্ট্রপতি বা উপ-রাষ্ট্রপতি হওয়ার যে স্বপ্ন তিনি দেখছেন, তার একটু কাছে যেতে পারতেন৷ দিল্লির কাছে নম্বর বাড়াতে পারতেন৷ বাংলায় ধনকড়ের দলের লোকজনের কাছে হিরো হতে পারতেন৷ অথচ সেই সাহসই দেখাতে পারলেন না৷ ধন্য ধনকড় !
আসলে, মুখে বাঘ মারতে অভ্যস্ত রাজ্যপাল৷ নার্ভের লড়াই করার তাগদই নেই৷ ধনকড় সাহেব মন্ত্রিসভার পাঠানো ভাষণের প্রতিবাদ জানালেন কোথায় ? বিজেপি বিধায়কদের কাঠগড়ায় তুলে, বিজেপি-বিধায়কদের সাহায্য নিয়ে শেষ পর্যন্ত পালিয়েই গেলেন৷
‘যঃ পলায়েতে স জীবতি’, আপাতত৷
আরও পড়ুন- হাসপাতালের বেড থেকে লাইভে গানওয়ালা, সরকারি স্বাস্থ্যকাঠামো নিয়ে প্রশংসা রাজ্য সরকারের